E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফর এবং আমাদের ট্র্যাডিশন

২০১৬ সেপ্টেম্বর ২১ ২২:১৩:২৪
প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফর এবং আমাদের ট্র্যাডিশন

শীতাংশু গুহ :


এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্ক থাকবেন। সাথে বেশকিছু নেতানেত্রী, মিডিয়া কর্মী এবং অন্যান্যরা। দেশ থেকে যারা আসেন তারা যেমন এ সময়টা ব্যস্ত থাকেন; প্রবাসের আওয়ামী ঘরানার নেতাকর্মীরাও তাদের নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েন।

এ সপ্তাহান্তে জ্যাকসন হাইটসে দেখলাম অনেকেই ইতিমধ্যে মুজিব কোট নামিয়ে ফেলেছেন। আসলে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আসেন, প্রবাসের সাথে দেশের তখন একটা যোগসূত্র ঘটে। ব্যাপারটা মন্দ নয়; হৈ হুল্লার মধ্যে দিয়ে ক'টা দিন সবার ভালোই যায়। অনেকে আগেভাগেও আসেন, এবার যেমন দীপুমনি এসে গেছেন। বন্ধু সাংবাদিক সেলিম সামাদ ফেইসবুকে জানান দিয়েই এসেছেন।

বিএনপি বা বিরোধী শিবিরের লোকজনও তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা বিক্ষোভ, প্রতিবাদ করতে মাঠে নেমে পড়েন। এটা বোধহয় আমাদের দেশের ট্র্যাডিশন! স্মরণাতীত কালে মনে পড়ে না যে, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়নি! শেখ হাসিনা এলে বিএনপি-জামাত বিক্ষোভ করে; খালেদা জিয়া এলে আওয়ামী লীগাররা বিক্ষোভ করেছে, আমি নিজেও তাই করেছি। এবার লন্ডনেও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভালোই বিক্ষোভ হয়েছে। এতে আমেরিকায় বিএনপি উৎফুল্ল, হয়তো তাদের বিক্ষোভ কিছুটা জোরদার হবে। আর একটি গ্রুপও বিক্ষোভ করে, এরা সংখ্যালঘু, তবে তাদের বিক্ষোভ শুধু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা সেদিক থেকে ভাগ্যবতী, হিন্দুরা তার বিরুদ্ধে এখনো বিক্ষোভ করেনি, অন্তত: আমি দেখিনি। ভবিষ্যতে করবে না, এই গ্যারান্টি দেয়া যাবে না।

আসলে এসব করে লাভ কি? অন্য দেশের সরকার প্রধানদের বিরুদ্ধে আমরা কদাচিৎ এমনটা দেখি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানুষের কমতি নেই, কিন্তু তারা আমাদের মত বিক্ষোভ করে না। এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও নয়। অবশ্য ১৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বালুচরা জাতিসংঘের সামনে বিক্ষোভ করেছে। ওরা স্বাধীনতা চায়। রাজনীতির এই এক অবাক কান্ড; বালুচরা এখন মোদীজির সাহায্য চায়। এক বালুচ নারীনেত্রী তো মোদীজিকে দাদা হিসাবে 'রাখী' বাঁধতে চেয়েছেন। ক'দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি প্রধান দিলীপ ঘোষ নিউইয়র্ক এসেছিলেন। তিনি এই রাখী বন্ধনের ঘটনাটিকে 'মহান ভারতের' কাছে নির্যাতিত প্রতিবেশীদের আকাঙ্খার প্রতিফলন বলে এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন।

একটি পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে শ্রী দিলীপ ঘোষ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বেশ প্রশংসা করেছেন। একইসাথে বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত এবং সরকার কিছু করছেনা তাও এসেছে। কিছুটা সমালোচনা থাকলেও বিজেপি নেতারা সবাই এসময়ে শেখ হাসিনার পক্ষে। কংগ্রেস তো আছেই। বিজেপি ও কগ্রেস নেতাদের সাথে আলাপ করলে মাঝে মধ্যে মনে হয়, দিল্লি এখন আমাদের চেয়েও বেশি 'আওয়ামী লীগার'; শেখ হাসিনা কি জাদু করেছেন কে জানে? যাহোক, প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফর এবার অনেকটা সংক্ষিপ্ত। রবিবার বিকালে তিনি এসে পৌঁছলেও পুরো কোন উইক-এন্ড এবার প্রবাসীরা পাচ্ছেননা। কিন্তু তাতে কি? সন্ধ্যার পর হোটেলে বা আশেপাশে বা বাঙালী অধ্যুষিত এলাকায় জটলা সবারই চোখে পড়বে।

গতবার থেকে প্রধানমন্ত্রী একটি ৫তারা হোটেলে উঠছেন। নিরাপত্তার খাতিরে সেটি দরকার। ওই হোটেলে নিরাপত্তা একটু বেশি। যেকেউ যখন-তখন কোন রুমে যেতে পারেন না। তাই লবীতে ভীড় একটু কম থাকে। আগে প্রধানমন্ত্রী একটি ৪তারা হোটেলে উঠতেন। সেখানে প্রবাসীদের ভীড়ে হোটেল কর্মীরা পর্যন্ত হিমশিম খেতো এবং কখনো-সখনো সিকিউরিটি দিয়ে লবী থেকে আমাদের বের করেও দিয়েছ। কিন্তু তাতে কি, পরক্ষণেই আবার সেই ভীড় লেগে যেতো। সোমবার থেকে প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শুক্রবার চলেও যাবেন। তার জন্মদিনটি তাই এবার আর নিউইয়র্কে পালিত হবে না। পরপর কয়েকবার তাই হয়েছে। তখন প্রবাসে কেক কাটার একটি হিড়িক পরে যেতো, যেটা এবার সবাই মিস করবেন। যাহোক, প্রবাসীদের পক্ষে মাননীয় শেখ হাসিনাকে আগাম 'হ্যাপী বার্থ ডে' জানিয়ে রাখলাম।

২১ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর নাগরিক সম্বর্ধনা। এটি সাধারণত: হোটেলের বলরুমে হয়ে থাকে। এবারো তাই হচ্ছে। হাজার তিনেক মানুষ আসেন প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতে। ব্যাপক নিরাপত্তা থাকে। তারপরও এবার দেখলাম, মিডিয়ায় নাশকতার আশঙ্কার কথা এসেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় স্বয়ং বিষয়টি তদারক করে থাকেন, তদুপুরি এসএসএফ ও এফবিআই তো আছেই, তারপরেও সাবধানের মার্ নেই। প্রবাসে আগের মত এখন বাঙালী মাত্রই সজ্জন এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাবেনা। দুর্জনের সংখ্যাও কম নয়, দেশি-বিদেশী সন্ত্রাসীরা যে ওঁৎ পেতে নেই, কেজানে? আমরা নি:ছিদ্র নিরাপত্তা চাই। আমি একবার লিঙ্কন সেন্টারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্বর্ধনায় গিয়েছিলাম; সেখানে ষ্টেজে ৭/৮জন এবং বক্তা ৪/৫জন দেখে অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমাদের স্টেজে থাকেন প্রায় ১০০জন এবং বক্তা অর্ধশত। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, শেষমেষ প্রধানমন্ত্রী বা জয়কে তালিকা থেকে বক্তাদের নাম কাটতে হয়!

গতবার সম্বর্ধনা অনুষ্টানে দেশ থেকে আসা আমার এক পরিচিত সাংবাদিক বলেছিলেন, দাদা, আমরা তো মার্কিন মানের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলাম! তাকে হেসে বলেছিলাম, আমরা মার্কিন মুলুকে থাকলেও বাঙালীত্ব বিসর্জন দেইনি। যেমন প্রধানমন্ত্রী এলে আমরা এয়ারপোর্টে বিক্ষোভ করি, এটা বাঙালীর ঐতিহ্য। অন্য কেউ করেনা। প্রতিবারই এটা হয় এবং এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের ওপর বিরক্ত হন। কদাচিৎ প্রধানমন্ত্রী ওই বিক্ষোভ দেখার সুযোগ পান, কারণ তাকে অন্য গেট দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কখনো-সখনো আওয়ামী লীগ-বিএনপি মারামারি হয়। নিউইয়র্কে এ সপ্তাহের পত্রিকাগুলোতে একদিকে যেমন প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগতম বিজ্ঞপ্তিতে ভরপুর; অন্যদিকে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ কর্মসূচিও কম নয়।মাঝে মাঝে মনে হয়, এসব করে লাভ কি?

মিডিয়ায় দেখলাম, এয়ারপোর্টে বিক্ষোভ আছে; জাতিসংঘের সামনে তো আছেই। সম্বর্ধনাস্থলের বাইরে প্রতিবারই থাকে। 'শেখ হাসিনা যেখানে প্রতিরোধ সেখানে' কর্মসূচিও আছে। এসব বন্ধ হবে কবে? মূলত: আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপি এবং বিএনপি শাসনামলে আওয়ামী লীগ এটা করে থাকে। ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতারা চাইলে এটা বন্ধ হতে পারে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার, কারণ এতে কোন লাভ নেই বরং এতে নিজেদের বিদেশের কাছে হাস্যকর করে তোলা হয়। দেশে যেমন হরতাল একটি জাতীয় ব্যাধি, বিদেশে তেমনি সফররত সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ একটি ক্যান্সার। একথা বলছি না যে, প্রতিবাদ করা যাবেনা, তবে স্টাইল পাল্টানো দরকার। মুখে আমরা যতই বলি না কেন বিদেশীদের দেখাতেই জাতিসংঘের সামনে বিক্ষোভ, আসলে সংবাদ হিসাবে এর কানাকড়ি মূল্য নেই এবং একটি লাইনও স্থানীয় কোন মিডিয়ার আসে না।

বাঙালী মিডিয়া বা দেশে প্রকাশের জন্যে তো অন্য কর্মসূচি নেয়া যায়! শুধু শুধু বিক্ষোভ-টিক্ষোভ করে সময় ও অর্থ অপচয়ের কোন মানে হয়না! প্রধানমন্ত্রী এবার লন্ডন-কানাডা হয়ে নিউইয়র্ক এসেছেন। এ সময়ে আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণ এবং তাই এবারকার সফর ইঙ্গিতবহ। ধারণা করা যায়, সফর স্বল্প সময়ের হলেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ এবং লাভের পাল্লাটা ভারী হতে পারে। নিউইয়র্ক থেকে তিনি ভার্জিনিয়া যাবেন বৃহস্পতিবার এবং সেখান থেকেই দেশের উদ্দেশে রওয়ানা হবেন ২৫ তারিখ। প্রধানমন্ত্রীর এবারকার সফরে বঙ্গবন্ধুর খুনী এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা ছিলো বা আছে, যদিও কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে কানাডীয় সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পররাষ্ট্র সচিব ও প্রেস সেক্রেটারীর কথার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক লক্ষ্যণীয়। এখন দেখার পালা আমেরিকায় কি হয় !

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী কলাম লেখক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test