E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমার ভাঙ্গা রের্কড

২০১৬ অক্টোবর ০৭ ১০:২৩:৩১
আমার ভাঙ্গা রের্কড

মুহম্মদ জাফর ইকবাল :


দেশ কিংবা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষজন যখন হা- হুতাশ করে আমি সাধারণত সেগুলোকে খুব গুরুত্ব দিয়ে নিই না। সারা পৃথিবী এখন স্বীকার করে নিয়েছে নতুন পৃথিবীতে পার্থিব সম্পদ থেকেও বড় সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। কাজেই একটা দেশের তেল, গ্যাস কলকারখানা, সোনা, রুপা হীরার খনি না থাকলেও ক্ষতি নেই যদি দেশে মানুষ থাকে আর সেই মানুষের জ্ঞান চর্চার একটা সুযোগ থাকে।

সেই হিসেবে আমাদের দেশটি অসাধারণ এই দেশে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়ের সংখ্যাই চার কোটির মত।(পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের জনসংখ্যাই চার কোটি থেকে কম পুরো অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা দুই কোটি থেকে একটু বেশি!) কাজেই আমাদের দেশে আমরা যদি শুধু মাত্র স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের ঠিক করে লেখাপড়া করাতে পারি তাহলেই দেশটা অচিন্ত্যনীয় সম্পদশালী একটা দেশ হয়ে যাবে। আমি তাহলে কেন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হা হুতাশ করব?

আমাদের শুধু যে চার কোটি ছেলে মেয়ে স্কুল কলেজে লেখাপড়া করে তা নয়, এর মাঝে ছেলে আর মেয়ের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। সত্যি কথা বলতে কী আমরা মাঝে মাঝেই আবিস্কার করি মেয়েরা সংখ্যাতে যেরকম , লেখাপড়ার মানেও সেরকম ছেলেদের থেকে এগিয়ে থাকে। তুলনা করার জন্য পাকিস্তান নামক অভিশাপটির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি, মেয়ে হয়ে পড়াশোনার আগ্রহ দেখানোর কারণে সেই দেশে মালালা নামের কিশোরীটিকে মাথায় গুলি থেতে হয়েছিল। একটা নোবেল পুরস্কার দিয়ে সারা পৃথিবীকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্য করতে হয়েছিল।

লেখাপড়ায় ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের এগিয়ে আসা যে একটা দেশের জন্য কতো বড় আশীবার্দ সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। এখনো অনেকে অভিভাবক বিশ্বাস করেন, ভালো একটা ছেলে পেলে মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়া সায় ততই মঙ্গল এবং সে কারণে এইচ এসসি এর পর থেকে তাদের বিয়ে দেয়া শুরু হয়।

যদি সেটা না হতো তাহলে মোটামুটি গ্যারান্টি দিয়ে বলা যেতো আমরা আমাদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে স্কুল কলেজের মত সমান সমান ছেলে আর মেয়ে পেতাম। লেখাপড়া করছে এরকম মেয়েদের পেলেই আমি তাদেরকে বলি, ‘খবরদার লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বিয়ে করবে না!’(আমরা ধারনা অনেকে অভিভাবক সে কারণে আমাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না)

দুই.
জ্ঞান হচ্ছে সম্পদ তাই এই দেশের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করলেই দেশ সম্পদশালী হয়ে যাবে এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই, কিন্তু এই দেশের ছেলেমেয়েরা সত্যি সত্যি লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করেছে কী না সেই বিষয়টি নিয়ে শুধু দ্বিমত নয় ত্রিমত কিংবা চতুর্থ মতও আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি সত্যিকারের লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করছে কী না সেই বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত নয় ত্রিমত কিংবা চতুর্থ মতো আছে।

আমরা সত্যিকারের লেখাপড়ার বদলে এখন বিচিত্র এক ধরনের পরীক্ষা ভিত্তিক লেখাপড়া শুরু হয়েছে। জিপিএ ফাইভ পেলে আমাদের ধরে নেয়া উচিৎ তার একটা নির্দিষ্ট মানের লেখাপড়া হয়েছে কিন্তু আমরা সেটাও করতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি নেয়ার সময় আমরা আবিস্কার করি জিপিএ ফাইভ অনেকে সেখানে পাশ মার্কটুকুও তুলতে পারে না।

আমাকে একজন হিসেব করে দেখিয়েছেন একেবারে কোনো রকম লেখাপড়া না করেই ষাট থেকে সত্তর মার্ক পাওয়া সম্ভব। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা ২৫ মার্ক একেবারে ছাঁকা অবস্থায় একজন ছাত্র কিংবা ছাত্রীকে দিয়ে দেয়া হয়। পরীক্ষার হলে যদি একজন ছাত্র বা ছাত্রী এম.সি.কিউ এর উত্তর জানে সে তাদের নিজস্ব সিগন্যাল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলের সবাইকে সেটা জানিয়ে দিতে পারে। আজকাল নাকি তারও প্রয়োজন হয় না অনেক শিক্ষক নিজেরাই ছাত্র ছাত্রীদের পুরো উওরটুকু বলে দেন।

শুধু তাই নয় পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে সেগুলো স্মার্ট ফোনে চলে আসে তখন অভিভাবকেরা নিজেরাই যত্ন করে তাদের ছেলে মেয়েদের সেগুলো মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষা হলে ঢুকিয়ে দেন। কাজেই একজন ছেলে একেবারে কিছু না পড়েই প্র্যাকটিক্যাল আর এম.সি.কিউ মিলিয়ে ষাট নম্বর পেয়ে যায়। মূলত প্রশ্নের উত্তরে যদি কিছু না জেনেও একেবারে যা ইচ্ছা তাই লিখে দিয়ে আসে তাহলে ও সেখানে বেশ কিছু নম্বর দেয়ার অলিখিত নির্দেশ রয়েছে!

কাজেই আমরা মাঝে মাঝে যখন আবিস্কার করি একেবারে কিছুই জানেনা কিন্তু জিপিএ ফাইভ পেয়ে বসে আছে তখন অনুমান করে নিতে হয় নিশ্চয়ই এরকম কোনো একটি ঘটনা ঘটেছে। অথচ আমাদের দেশে লেখাপড়া ব্যাপারটি এরকম দিশেহারা অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। ভালো লেখাপড়া করার জন্য তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের দরকার : শিক্ষক, পরীক্ষা পদ্ধতি আর পাঠ্যবই।

এর মাঝে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে ভালো শিক্ষক না পাওয়া। রাতারাতি বাংলাদেশের সব স্কুলের শিক্ষকদের জাদুমন্ত্র দিয়ে ভালো শিক্ষক হিসেবে পালটে দেয়া যাবে সেটা আমরা কেউ আশা করি না। আমরা যদি একটা ভালো স্কুলের খবর পাই তাহলে একেবারে নিশ্চিতভাবে বলে দেয়া যায় সেই স্কুল একজন হলেও খুব ভালো শিক্ষক আছেন। আমাদের দেশের স্কুল কলেজগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হলেও কে কিছু কিছু ভালো শিক্ষকরা আছেন সে জন্য এখনো এই দেশটি লেখাপড়া হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে আমরা এই কথাগুলো আরো জোর দিয়ে বলতে পারছি না।

এখন মোটামুটি আমরা সবাই জেনে গিয়েছি স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে শিক্ষকদের অনেক ধরনের ট্রেনিং নেওয়ার পরও সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না, তাই তারা গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেন। ছেলে মেয়েদের তাই পাঠ্য বইটির সাথে সাথে আস্ত একটা গাইড বই মুখস্ত করতে হয়। আমি প্রায় নিয়মিতভাবে দেশের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে চিঠিপত্র, ই-মেইল পাই সেখানে তারা আমাকে তাদের শিক্ষদের নিয়ে ভয়ংকর ভয়ংকর অভিযোগ করে যার সবচেয়ে গুরুতরটি হচ্ছে টাকা পয়সা নিয়ে জোর করে প্রাইভেট পড়ানো এবং তাদের কাছে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে দেয়া!

অভিযোগগুলোতে সত্যতা আছে কারণ আমরা সবাই জানি একেবারে দুধের শিশুটিকেও আজকাল প্রাইভেট না হয় কোচিংয়ে পড়তে পাঠানো হয়। যে শিশুটির নিজে নিজে পড়ালেখা করার ক্ষমতা আছে তাকে প্রাইভেট আর কোচিংয়ে অভ্যস্ত করিয়ে আমরা তার আত্মবিশ্বাসের একেবারে বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিই। যে শিক্ষকেরা জেনেশুনে আমাদের ছেলে-মেয়েদের এভাবে সর্বনাশ করে যাচ্ছেন তাদেরকে কোনোভাবে ক্ষমা করা যায় না। ক্লাসে পড়াবেন না কিন্তু কোচিংয়ে পড়াবেন এই ভয়ংকর অভিশাপ থেকে আমরা কখন মুক্তি পাবো কে জানে?

পড়ালেখা করার জন্যে দরকার দুই নম্বর বিষয়টি হচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতি। দেশের শিক্ষার মান ভালো করার এটাই হচ্ছে সবচেয়ে সঠিক উপায়। প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়েই পরীক্ষায় ভালো করতে চায়। যদি পরীক্ষা পদ্ধতি খুব ভালো হয় তাহলে সেই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য ছেলে-মেয়েরা যখন প্রাণপণ চেষ্টা করে তখন নিজে থেকে যেটুকু শেখার তা শিখে নেয়। প্রশ্নগুলো এমনভাবে করতে হবে যেন সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে ভালো করে লেখাপড়া করার বাইরে আর কোনো শর্টকাট না থাকে।

এই দেশের আগের গদবাধা প্রশ্ন-পদ্ধতি পাল্টে যখন নতুন সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু করা হয়েছিল তখন আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে সত্যিকারের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হতে যাচ্ছে। কিন্তু যখন আবিস্কার করেছি প্রশ্নগুলোর জন্য গাইড বইয়ের উপর নির্ভর করতে শুরু করা হচ্ছে তখন বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার রাস্তা থাকল না। সবচেয়ে ক্ষোভ হয় যখন দেখি আমাদের দেশের প্রথম সারির খবরের কাগজগুলো একেবারে নিয়মিতভাবে গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে।

এত বড় বড় সংবাদপত্র তারা তো নিশ্চয়ই ভুল করতে পারে না, ভেবে দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়ে খবরের কাগজের গাইড বই মুখস্থ করে যাচ্ছে। বড় বড় জ্ঞানী-গুনি সম্পাদকের ভেতরে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নেই, বিন্দুমাত্র গ্লানি নেই যে তারা তাদের পত্রিকায় কিশোর, তরুণদের মানসিক বিকাশের মত কোনো লেখা না ছাপিয়ে তাদের বুদ্ধিমত্তাকে গলা টিপে শেষ করার জন্য গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছেন। এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি।

আমার হিসেবে লেখাপড়া করার জন্যে তিন নম্বর বিষয়টি হচ্ছে ভালো পাঠ্যপুস্তক। আমাদের ছেলে-মেয়েদের প্রায় সবাই এখন প্রাইভেট কোচিংয়ের হালে আটকা পড়ে আছে। এই হাল থেকে তাদের মুক্ত করে আনার সবচেয়ে সোজা পথ হচ্ছে চমৎকার কিছু পাঠ্যবই। যদি পাঠ্য বইগুলো খুব ভালো হয় তাহলে ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই কিছু পড়ে সেখান থেকে বিষয়বস্তু শিখে নিতে পারবে।

দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের জন্যে লেখা পাঠ্যবইগুলো নিয়ে সেরকম কিছু বলতে পারি না। আমি বিজ্ঞানের মানুষ অথচ আমি বিজ্ঞানের পাঠ্যবই দেখেছি তার অনেক বিষয় পড়ে আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারি না। স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা সেগুলো পড়ে কি বুঝবে। বইগুলোও ছাপা হয় এমন দায়সারা ভাবে যে সেগুলো দেখে মনের ভেতর নতুন বই দেখার যে আনন্দ হওয়ার কথা সেটাও হয় না।

শুধু তাই নয় অনেক পাঠ্যবইয়ের সাইজ ছোট করে ফেলা হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা সেই সংক্ষিপ্ত বই পড়ে কিছু বুঝে না, পুরানো বই খুঁজে বেড়ায়। আমার ধারণা যদি যত্ন করে একটি একটি করে সবগুলো পাঠ্যবই অনেক সুন্দর করে লেখা হয় তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই সেই পাঠ্যবই পড়ে নিজেরাই অন্য কারো সাহায্য নিয়ে তাদের বিষয়বস্তু শিখে নিতে পারবে। ভালো শিক্ষক, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং কিংবা গাইড বইয়ের মুখ চেয়ে বসে থাকবে না।

পাঠ্যবই নিয়ে কথা বলতে হলে পাঠ্যবই ছাপানোর যন্ত্রের কথাটিও একবার না বললেই হবে না। দেশের সব ছেলে-মেয়ের হাতে বছরের প্রথম দিন নতুন বই তুলে দেওয়ার মত অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা প্রতিবছরই ঘটে থাকে। আমার মনে হয় নতুন বই হাতে একটা শিশুর মুখের আনন্দের হাসিটুকুর মত সুন্দর একটা দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু নেই।

দেশের বেশিরভাগ মানুষ নতুন বছরে নতুন বইয়ের আনন্দটুকু শুধু দেখে আসছে কিন্তু এটি নিশ্চিত করার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত এনসিটিবি যে তাদের পুরো শক্তিটুকু বই ছাপানোর পেছনে ব্যয় করে ফেলেছে সেটি অনেকেই জানে না। এনসিটিবি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটা প্রকাশক এই কথাটি মোটেও অত্যুক্তি নয়। কোটি কোটি বই ছাপাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়।

সেখানে অনেকে এসে যে ভিড় করবেন ছেলে-মেয়েদের পাঠ্যবই ছাপানোর অতি মহৎ কাজের মাঝে যে বাণিজ্য এসে জায়গা করে নেবে না এবং সেখানে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি আর অপকর্ম ঘটতে থাকবে না সেটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। বই ছাপানোর এই বিশাল প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে যে অতি বিচিত্র চক্রান্তের কথা তার মাঝে নিশ্চয়ই অনেক সত্যতা আছে।

দেশের ভেতর বই ছাপানোর উপযুক্ত অবকাঠামো থাকার পরও যে সেগুলো ভারত কিংবা চীন থেকে ছাপিয়ে আনতে হচ্ছে তার পেছনেও নিশ্চয় অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলো আমরা জানি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি এনসিটিবির হাতে শুধু কারিকুলাম তৈরি করা, পাঠ্যবই লেখানো, সম্পাদনা করা এই ধরনের কাজগুলো রেখে ছাপানো এবং বিতরণের পুরো বাণিজ্যিক অংশটুকু অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।

লেখাপড়া নিয়ে যখনই আমি কিছু লিখি তখনই আমি আমার ভাঙ্গা রেকর্ডটাও বাজাই, কাজেই এবারো সেটা বাকি থাকবে কেন। এবারেও আমি আরো একবার বাজাই।

আমরা জানি বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর সামনে অঙ্গিকার করে এসেছিল যে শিক্ষার পেছনে দেশের জিডিপির শতকরা ছয়ভাগ খরচ করবে। আমরা এখন এটাও জানি শতকরা ছয় শতাংশ দূরে থাক লেখাপড়ায় পেছনে খরচ এখন তিন শতাংশও না দুই শতাংশ থেকে সামান্য একটু বেশি খরচ হয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতে সেটা চার শতাংশ অর্থাৎ আমাদের প্রায় দ্বিগুণ।

তাই আমাদের যখনই ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করি তখন গভীরে এক ধরনের মনোবেদনা নিয়ে লক্ষ করি আমরা আমাদের দেশে লেখাপড়ার মত বিষয়টিকে কত অবহেলা করি। আমি যতটুকু জানি সারা পৃথিবীতে লেখাপড়ার পেছনে যে দেশগুলো সবচেয়ে কম টাকা খরচ করে বাংলাদেশ হচ্ছে তার একটি।

আমার মাঝে মাঝে নিজেকে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে হয় সত্যিই আমি জেগে আছি কি না এবং সত্যিই এত কম টাকা খরচ করে আমরা আমাদের কোটি কোটি ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে যাচ্ছি ব্যাপারটি সত্যি কি না। আমাদের দেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে কত বেশি শক্ত হয়েছে অথচ এখনো আমাদের নীতি নির্ধারকরা দেশের লেখাপড়ার গুরুত্বটা বুঝে লেখাপড়ার পেছনে আরো একটু বেশি টাকা কেন খরচ করেন না আমি কিছুতেই সেটা বুঝতে পারি না।

যদি আমরা আমাদের লেখাপড়ার পেছনে পাশের দেশের ভারতবর্ষের সমান হারেও টাকা খরচ করতাম তাহলেই এই দেশে রীতিমত ম্যাজিক হয়ে যেত। স্কুলের বিল্ডিংগুলো ঠিক করা যেত। আরো অনেক বেশি দক্ষ শিক্ষক নেওয়া যেত, ক্লাসরুম আরো আধুনিক করা যেত, চমৎকার লাইব্রেরি করা যেত, বাচ্চাদের দুপুরে নাস্তা দেওয়া যেত, ঝকঝকে ছাপায় চার রঙ্গের পাঠ্যবই দেওয়া যেতো, হাওর অঞ্চলে বর্ষাকালে স্পীড বোটে করে ছেলে মেয়েদের স্কুলে আনা যেতো, পাহাড়ী অঞ্চলে স্কুলে স্কুলে হোস্টেল রাখা যেতো, ছেলে মেয়েদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা যেতো, স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য আধুনিক স্কুলবাস দেয়া যেতো, তাদের দলবেধে চিড়িয়াখানা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া যেতো-এই তালিকাকে আমি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে পারি। কিন্তু তালিকাটির দিকে তাকিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাসই ফেলতে হবে তাই তালিকাটি আর দীর্ঘ করতে চাই না।

আশা করে আছি কোনো এক সময় সরকার বুঝতে পারবে পদ্মা ব্রীজ কিংবা নিউক্লিয়ার শক্তিকেন্দ্র থেকেও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লেখাপড়া আর সত্যি সত্যি আমরা দেখব লেখাপড়ার জন্য বরাদ্দ তিনগুণ বেড়ে গেছে। তারপর চোখের পলকে আমরা এই দেশে একটা ম্যাজিক ঘটে যেতে দেখব। যতদিন সেটি না হচ্ছে ততোদিন আমি আমার এই ভাঙ্গা রেকর্ডটি বাজিয়েই যাই!

লেখক : কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, শাবিপ্রবি।

পাঠকের মতামত:

০৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test