E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি

২০১৬ নভেম্বর ০২ ২২:৪৯:৪১
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি

আরিফ মাহবুব


ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, মাধবপুর এবং ছাতক সহ দেশের বিভিন্নস্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা ও তাণ্ডবের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

একজন সিনিয়র মন্ত্রী আনিসুল হক আক্রান্ত এলাকায় না গিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের টেলিফোনে বকে দিয়ে বলেছেন, 'যা হবার হয়ে গেছে, আর যেন না হয়।' অপর একজন বিশিষ্ট নেতা জনাব হানিফ ঘটনার তিনদিন পর আক্রান্ত জায়গাগুলো পরিদর্শনে না গিয়েই তার দল আওয়ামী লীগ হিন্দুদের পাশে আছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে জনাব মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের জন্য কোনই প্রশ্নটা উত্থাপন করার প্রয়োজন ছিল না যদি না আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়টি বহাল তবিয়তে না থাকতো।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হবার পর মুসলমান ও হিন্দুদের যে দাঙ্গা হয়েছিল তা নিরসনে শ্রী করম চাঁদ গান্ধী দাঙ্গা আক্রান্ত এলাকা নোয়াখালীতে এসেও কোন প্রতিকার করতে পারেন নাই। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ঢুকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে ১৯৪৭ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাবার চেষ্টা চালিয়ে যায় একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ গ্রহণ করে। রজনীগন্ধা ফুলের সুবাসে শুরু হয় স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবিরের নেতাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলে অংশগ্রহণ। তারপরের ঘটনা বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন আছে কি ?

হিন্দুদের উপর এই তাণ্ডব কি সমগ্র বাংলাদেশ ও কুষ্টিয়াতে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে জামাত-শিবিরের নেতাদের আওয়ামীলীগে বরণ করে নেবার কুফল ?

পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মেই ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামি আছে তবে আমার মতে শুধু মাত্র হিন্দু ধর্মের মানুষরাই এই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার থেকে বেড়িয়ে আসতে পেরেছে সব চাইতে বেশী। যুগের সাথে তাল মিলে ধর্মীয় কুসংস্কারকে বিসর্জন দিয়ে প্রবাসে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্র সমাজের সিংহভাগ ছাত্রই আজ পৃথিবীর বিশাল আইটি কোম্পানি তথা মাইক্রোসফট, গুগল, ফেইসবুক, নভেলের মতন প্রতিষ্ঠানগুলোতে দাপটের সাথে রাজত্ব করছে, জায়গা করে নিয়েছে সিলিকন ভ্যালীর মত জায়গাতে। হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার গোঁড়ামি থেকে বেড়িয়ে আসতে রাজা রাম মোহন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও এই উপমহাদেশে অনেক গুণীজনদের অবদান ছিল। তারপরও ভারতে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি আজও প্রতীয়মান। অপর দিকে উপমহাদেশের মুসলমান সমাজ ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে তো পারেই নাই বরং দিন দিন বিভিন্ন ধর্মীয় আদর্শে বিভক্ত হয়ে অন্ধকার জগতের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশেই অকাতরে ধর্মান্ধদের চাপাতির নীচে প্রাণ দিচ্ছে আমাদের সমাজের, বিজ্ঞানী, লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, মুক্তমনা, প্রকাশক, পাদ্রী, ইমাম, শিক্ষক, বিদেশী অতিথি ও ধর্ম যাজকরা। আর এর সব কিছুর পেছনেই ইন্ধন যোগায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধানে সংযোজিত রাষ্ট্র ধর্ম। এই রাষ্ট্র ধর্মকে রক্ষার অজুহাতে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে উল্লাসের সাথে সময় অসময়ে রচিত হয় তাণ্ডব।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাক-ভারত ভাগা ভাগী হবার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকাতে শ্রী করম চাঁদ গান্ধী নোয়াখালী এসেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনই নাই বরং কোলকাতাতেই সাম্প্রদায়িক রেষারেষির জের ধরে এক দুষ্কৃতিকারীর গুলিতেই তিনি প্রাণ হারান।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সুপ্রসন্ন চিন্তা, প্রেরণা ও ডাকে বাঙালী জাতি মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম দেয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম নামক শব্দটি প্রবেশ করিয়ে দিয়ে এই দেশে ধর্মীয় শাসন ব্যবস্থার পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসে। সুযোগ বুঝে স্বাধীনতা বিরোধী জামাত শিবিরের কর্মী ও নেতারা সুকৌশলে স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলে ভীরে যেতে থাকে। আজ তারাই পাকি প্রেতাত্মা সেজে রাষ্ট্র ধর্ম রক্ষার অজুহাত তুলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রত্যন্তে অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব রচনা করছে। আর সেই সাথে সরকার পক্ষের লোকজন সুযোগ বুঝে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে।

১৯৪৭ সালের পর থকে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক সংখ্যা কমতে কমতে ৩১% থকে আজ ৭ % এসে দাঁড়িয়েছে। হিন্দুদের সম্পত্তি গ্রাসের আশায় ক্ষমতাবানরা পানির দামে তাদের তাদের সম্পত্তি (অর্পিত) গলোধাকরণ করে রাতের অন্ধকারে হুমকি ধমকি দিয়ে তাদের এই দেশ থেকে বিতাড়িত করছে। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে কাউকে আইনস্টাইন হবার প্রয়োজন হয় না।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে বাঙালী স্বাধীনতা লাভ করলেও কার্যত বর্তমানে রাষ্ট্র ধর্মের চাপে বাঙালী হিন্দুরা এখনও স্বাধীনতা লাভ করেনি। ইংরেজ শাসন আমল থেকেই বাংলার এই অংশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন আজ অবধি থেমে নেই, চিত্রটা সেই আগের মতই। পাকিস্তানের মুসলিমরা যতটা না ভারত বিদ্ধেষি ছিলো তার অধিক তারা ছিলো হিন্দু বিদ্ধেষি আর বাংলাদেশের মুসলমানরা বর্তমানে রাষ্ট্র ধর্মের সুবিধাটা পুরোপুরি ভোগ করছে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ অংশে হিন্দুদের উপর একটি পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া গেল একটি ব্লগে। একটু চোখ বুলিয়ে নিন...

১৯৪৭ সালে-৩১%
১৯৬১ সালে-১৯%
১৯৭১ সালে-১৬%

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর

২০১০ সালে-৮.৫%
২০১৬ সালে- ?

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ঠিক পর পরই হিন্দু ও মুসলমান বাঙ্গালীদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে তেমন একটা ভেদাভেদ লক্ষ্য করা যায় নাই, কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাঙালী সংস্কৃতিতে হিন্দু ও মুসলমানের দূরত্বটা বাড়তে থাকে সেই সাথে সংবিধানেও রাষ্ট্র ধর্ম সংযুক্ত হয় আর ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার লোভে বিচার বিভাগের রায় থাকাও পরও স্বাধীনতার স্বপক্ষের দল ক্ষমতায় থেকেও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম নামক এই অযৌগিক প্যারাগ্রাফটি বাতিল করতে পারেনি।

হিন্দুদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি থকে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করলেও ক্ষমতাবানরা এই অর্পিত সম্পত্তি স্বল্প দামে গলোধাকরণের তাগিদেই কি বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর এই অত্যাচার, নিপীড়ন আর তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে ? আজ এটা আমাদের অনেকেরই একটি ধারণা মাত্র।

লেখক: সুইডেন প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

১১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test