E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইতিহাস পাল্টানোর অধিকার আমাদের কে দিয়েছে!

২০১৬ নভেম্বর ১৭ ১৬:১১:২৮
ইতিহাস পাল্টানোর অধিকার আমাদের কে দিয়েছে!

মাহবুব আরিফ


সময় এসেছে কিছু বিষয় সহজ ভাবে অনুধাবন করার। শঙ্কা দিয়েছে,  দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ বুঝি আজ ধাবিত হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক এক অন্ধকার জগতে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে  কিনা কিংবা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে অঘটন ঘটছে কিনা তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

দেশের কোথাও কোথাও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্তর্কলোহ সৃষ্টি করে চলেছে সাম্প্রদায়িক উশৃঙ্খলতা, একটি জাতির মাঝে সৃষ্টি করে চলেছে ধর্মীয় উন্মাদনা ও তাণ্ডব, জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে মানুষ, ভিটা মাটি, জমিজমা, গোয়ালের গরু, খোয়ারের মুরগী, গাছের আম। এক টুকরো সংসার, একটি স্বপ্ন, বেঁচে থাকার আশা, সব কিছুই যে আজ আগুনে পুড়ে যায়, পুড়ে যায় একটি মানুষের স্বপ্নে গড়া মাতৃভূমি, পুড়ে যাচ্ছে মানুষের চোখের জল। স্বাধীনতার স্বপক্ষের নামধারী ধান্ধাবাজদের হাত ধরেই স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি আজ জায়গা করে নিচ্ছে স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলে। রাত দিন পরিশ্রম করে দেশের স্বার্থে দুই পা এগিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবার ধান্দাবাজ, হাইব্রিড ও দলীয় কোন্দলে তিন পা পিছিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামীলীগের হাইব্রিড ক্ষুধার্থ দলীয় শকুনেরা খাবলে খাচ্ছে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। সৎ ও মানবতাবাদী মানুষদের এখন দেশ ছেড়ে পালাবার পালা। উন্নয়নের ভিডিওতে ছেয়ে গেছে দেশের আনাচ কানাচ, কিন্তু গাছের নীচে খুজে পাওয়া যায় সর্বস্ব হারানো ক্ষুধার্থ সাঁওতাল। তাদের লাশ পড়ে থাকে স্বাধীন বাংলার মাঠে প্রান্তরে, সৎকার করার কাজে খুঁজে পাওয়া যায় না একজন পুরুষ মানুষ। ভয়ে গ্রাম ছাড়া সকল পুরুষ সাঁওতাল, গাছের নীচে জীবন কাটিয়েও অপমান সহ্য করতে না পেরে ফিরিয়ে দিচ্ছে সরকারী অনুদান, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিক আজ লজ্জিত, শঙ্কিত, নিশ্চুপ। বাংলাদেশটা কি আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হবার অপেক্ষায়!

মনে রাখতে হবে আজ যারাই নাসিরনগর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেবের ঘরে আবারও আগুন দিয়েছে, তারা এখন বুঝি পুরো দেশটাতেই আগুন লাগাবার সুযোগের অপেক্ষায়।

ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললেও অন্যায় হবে না, বাংলাদেশে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির চাইতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঝুঁকি বেশী। নাসিরনগরে বৃদ্ধা নিয়তি চক্রবর্তীর হত্যাকারীদের সামনে রাষ্ট্র আজ অসহায়। উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে অসহায় হিন্দুদের সান্ত্বনা দেয়া যায় কি? অসহায় রোহিংগাদের আশ্রয় না দিয়ে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশ কি আরও একটি অমানবিক কর্মের পরিচয় দিল? মানবতাকে ধর্মের আগে স্থান দিতে আমাদের অপারগতাটা কোথায় ? ধর্ম দিয়ে যারা মানুষের মৃত্যুকে কখনো বিভাজিত করে না, তাদের কাছে প্রতিটি ধর্মের বর্ণের মানুষই নিরাপদ। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে ধর্ম একটি ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবতাকে পরিস্ফুটিত করতে হলে আমাদের মনকে স্বচ্ছ করতে হবে প্রথমে। মানবতার কোন মানচিত্র, দেশ জাত, ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র থাকে না।

দলের ভেতরে মতের ভেদাভেদ মেটাবে কে? আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড: আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় বলেছি, আমি কখনোই বিশ্বাস করি না ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকা উচিত। এটা আমাদের কৌশল। আমরা সুযোগ পেলে, সময় পেলে ইনশাহআল্লাহ এটাকে সংবিধান থেকে তুলে দেবো।’ আবার দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতু-মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি একটি মীমাংসিত বিষয়। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেওয়ার ইচ্ছা সরকার বা আওয়ামী লীগের নেই'। একটি দল তো আর সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক দুই ভাগে বিভক্ত থাকতে পারে না। জিয়া এবং এরশাদের শাসন আমলটাই যদি বিচার বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করে থাকে তবে রাষ্ট্র ধর্ম কোন অজুহাতে বহাল থাকবে? মন্দির ভেঙ্গেও যদি একজনের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারাতে মামলা না হয়, তবে একজন রাজাকারকে কি রাজাকার বললেই একজন সাংবাদিককে ৫৭ ধারাতে বছরের পর বছর কোর্টে করতে হাজিরা দিতে হবে? অদ্ভুত এক নিয়মের বেড়াজালে আটকে আছে আমাদের শাসন ব্যবস্থা।

স্বাধীনতার স্বপক্ষের বুলি আওড়ানো ফটকাবাজ রাজনীতিবিদদের মানুষ এখন সহজেই চিনতে পারে। মানুষ এখন সব বোঝে, সব জানে, কিন্তু লজ্জায় কিছু বলে না। আওয়ামীলীগের মাঝে তারাই সব চাইতে দুর্নীতিবাজ, তারাই দলের ক্ষতি করে সব চাইতে বেশী, যারা নিজেদের দোষ অন্যের ঘাড়ে নিশ্চিন্তে চাপিয়ে দিচ্ছে। হাইব্রিড খুঁজে আনতে ঘরের বাইরে যাবার প্রয়োজন হয়না, নিজেদের চেহারাটা আয়নায় দেখলেই হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে দেশের আয় রোজগার, মানসম্মান জোগাড় করে আনছেন, আর কিছু দুশ্চরিত্র রাজনীতিবিদ গোঁফে তা দিয়ে হালুয়া রুটি খাচ্ছেন। বিষয়গুলো জনগণের কাছে এখন পানির মত পরিষ্কার।

সাঁওতালরা বহিরাগত! এই জমি তাদের খাস জমি না বলে জাতীয় পার্টির নেতা জনাব এরশাদ সাহেব হঠাৎ করেই নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন। এরশাদ সাহেবের হয়তো জানা নাই যে ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের মধ্যে সাঁওতালরা অন্যতম। সাঁওতালরা যে আর্যদের আগে থেকেই ভারতে আছে সে ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের মাঝে কোনই দ্বিমত নেই। সাঁওতালরা দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে বাস করে। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ি, চিরির-বন্দর, কাহারোল এবং রংপুর জেলার পীরগঞ্জে সাঁওতালরা অধিক সংখ্যায় বাস করে। রাজশাহী এবং বগুড়া অঞ্চলে কিছু সংখ্যক সাঁওতাল আছে।

প্রাচীনকাল থেকেই সাঁওতালরা এদেশে বসবাস করে আসছে। এই অল্প সংখ্যক সাঁওতালরা মোট ১২ টি গোত্রে বিভক্ত। তারা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আইনে গোত্র ও ভাষাকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব ও আন্তর্জাতিক ভাবেই চুক্তিবদ্ধ। আজ কি আমার সেটা ভুলে গিয়ে তাদের উৎখাত করার উল্লাসে নেমেছি! বিভিন্ন নেতা পণ্ডিতরা বক্তব্য দিচ্ছেন, এই এলাকাতে সাঁওতালদের জায়গাজমি কিছুই নাই, তারা অনাহুত। আসলেই কি তাই ? ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে ভাষাগত পরিচয়ে এরা অস্ট্রো-এশিয়াটিক। নৃতাত্ত্বিকদের ধারণায় এরা ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের অন্যতম। এক সময় এরা বাস করতো উত্তর ভারত থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত। আনুমানিক ৩০ হাজার বছর পূর্বে এরা ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল। আর সাঁওতালরা যে আর্যদের আগে থেকেই ভারতে আছে সে ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের মাঝে কোনই দ্বিমত নেই।

যাক পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়, অতি সূক্ষ্ম ভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক মতামতের বিভেদ দেখা যাচ্ছে। এ ভাবে চলতে থাকলে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো অতি সহজেই এই দেশকে অস্থির করে তোলার সুযোগ পেয়ে যাবে। মানবতা আজ বিপর্যয়ের মুখে, একে রক্ষা করুন। মানবতাকে ধর্মের আগে স্থান দেয়া হোক। জনগণ বঙ্গবন্ধু ও তার ধর্মনিরপেক্ষ দলকে আবার সেই রূপে ফিরে পেতে চায়।

লেখক : সুইডেন প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test