E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমার কেন আর দুর্ভাবনা নেই

২০১৬ নভেম্বর ১৮ ১০:০৯:২৭
আমার কেন আর দুর্ভাবনা নেই

মুহম্মদ জাফর ইকবাল


আজকাল বাংলাদেশে প্রতিবছর খুব হইচই করে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড আয়োজন করা হয়। এ বছরের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের একটি অনুষ্ঠানে আমার আমন্ত্রণ ছিল। সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়া এবং অনুষ্ঠান শেষে আবার ফিরে আসা যথেষ্ট ঝক্কির ব্যাপার। যাব কি যাব না, সেটা নিয়ে একটু দোটানার মধ্যে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত চলেই গিয়েছিলাম। গিয়ে অবশ্য খুব ভালো লেগেছে। বিশাল একটি আয়োজন বাংলাদেশে, এ রকম বড় আয়োজন আমার খুব বেশি চোখে পড়েনি।

তবে আমি আজকে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড নিয়ে লিখতে বসিনি। সেখানে যাওয়ার কারণে আমার যে একটি বিশেষ উদ্যোগ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে সেটি নিয়ে লিখতে বসেছি।

একটি নির্দিষ্ট সেশনে আমাকে কথা বলতে হয়েছে। দর্শকদের বেশির ভাগই তরুণ। কাজেই অনুষ্ঠান শেষে সেলফি তোলার আরেকটি সেশন শুরু হয়ে গেল। সেলফি সেশন যখন শেষ হয়েছে তখন লক্ষ করলাম তরুণদের ভিড়ে একজন বড় মানুষ আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি যখন ছাড়া পেয়েছি ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি যশোর শিক্ষা বোর্ডের সচিব, তাদের একটি উদ্যোগ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে আমার উৎসাহ আছে, তাই যখন কেউ শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে চান তখন আমি সেটা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনি। সচিব তার একজন সহকর্মীকে নিয়ে হলঘরের একটি কোনায় বসে আমাকে বললেন, যশোর শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে তারা একটি প্রশ্নব্যাংক তৈরি করেছেন, তারা সেটা নিয়ে একটু কথা বলতে চান।

আমি একটু অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। মাত্র কয়েক দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেকের সঙ্গে এ দেশের শিক্ষাবিদদের একটি সভা হয়েছে, সেখানে কিভাবে শিক্ষার মান বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যে কয়টি প্রস্তাব গুরুত্ব পেয়েছে তার একটি হচ্ছে একটি বড় প্রশ্নব্যাংক বানানো, যেখানে অসংখ্য সৃজনশীল প্রশ্ন জমা থাকবে। শিক্ষকদের একটি বড় অংশ যেহেতু নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারে না কিংবা তৈরি করতে চায় না, তাই তাদের যখন দরকার হবে তারা সেই প্রশ্নব্যাংক থেকে প্রশ্ন নিয়ে ব্যবহার করতে পারবে। এ মুহূর্তে শিক্ষকদের অনেকেই গাইড বই থেকে প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষা নেন। কাজেই ছেলেমেয়েরা শুধু পাঠ্য বইটি মুখস্থ করে না, পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে আরো কয়েকটি গাইড বই মুখস্থ করে। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, এ বছর যে জেএসসি পরীক্ষা হচ্ছে সেখানেও গাইড বই থেকে প্রশ্ন নেওয়া হয়েছে। এই গাইড বইয়ের প্রকাশকরা নিশ্চয়ই পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিতে পারে, ‘আপনার ছেলেমেয়েদের আমাদের গাইড বই মুখস্থ করান। কারণ এ দেশের পাবলিক পরীক্ষায় আমাদের প্রকাশিত গাইড বই থেকে প্রশ্ন নেওয়া হয়।’

যা-ই হোক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই সভায় কিভাবে প্রশ্নব্যাংক বানানো যায় সেটা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা হয়েছে; কিন্তু কেউ বলেনি যশোর শিক্ষা বোর্ড এরই মধ্যে সেটা তৈরি করেছে। যদি সত্যি সত্যি এত বড় একটি কাজ হয়ে থাকত উপস্থিত যারা ছিলেন তাদের কেউ না কেউ সেটা নিশ্চয়ই উল্লেখ করতেন। কাজেই খুব সংগত কারণে আমি যশোর শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের দিকে খুবই সন্দেহের চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা সত্যি সত্যি এটা তৈরি করেছেন, নাকি এটা তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন?

তারা বললেন, শুধু যে তৈরি করেছেন তা নয়, সেটা ব্যবহার করে তাদের এলাকার সব স্কুলে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে! কাজেই এ এলাকায় গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের বারোটা বেজে যাচ্ছে। শুনে আমি রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলাম। যশোর শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা দুজন বললেন, ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে একটি স্টল দেওয়া হয়েছে, বিশ্বাস না করলে আমি নিজের চোখে গিয়ে দেখে আসতে পারি।আমি নিজের চোখে দেখার জন্য সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে রওনা দিলাম।

২.
যশোর শিক্ষা বোর্ডের স্টলে তারা আমাকে প্রথমে একটি ভিডিও দেখালেন- ভিডিওটি শর্ট ফিল্মের কায়দায় তৈরি করা। পরীক্ষার জন্য একটি মেয়ে পড়ছে। পাঠ্য বই না পড়ে মুখ কালো করে মোটা মোটা গাইড বই মুখস্থ করছে। শুধু তা-ই নয়, স্কুল ছুটির পড়ে কোচিং সেন্টারে ভিড় করছে, সেখানে চালবাজ ধরনের একজন সবার হাতে মুখস্থ করার জন্য শিট ধরিয়ে দিচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা মুখ কালো করে নিরানন্দ এ জিনিসগুলো মুখস্থ করছে। আমার সবচেয়ে মজা লেগেছে, যখন ভিডিওতে দেখানো হয়েছে দরজার নিচ দিয়ে পেপারওয়ালা একটি ‘প্রথম আলো’ ঢুকিয়ে দিয়েছে। কঠিন চেহারার একজন মা পত্রিকাটি হাতে নিয়ে সেটি পড়ার কোনো চেষ্টা না করে সোজা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ‘পড়াশোনা পৃষ্ঠা’ নামে যে গাইড বইয়ের পাতা ছাপা হয়, সেটি কাঁচি দিয়ে কেটে তাঁর মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিলেন। এরপর সেটা মুখস্থ করার জন্য একটুখানি দাবড়ানি দিয়ে এলেন। হতভাগা মেয়েটি কোচিং সেন্টারের শিট, গাইড বই এবং প্রথম আলোর ‘পড়াশোনা পৃষ্ঠা’ মুখ কালো করে মুখস্থ করতে লাগল।

যারা এখনো জানেন না তাদের মনে করিয়ে দেওয়া যায়, আমাদের দেশে সব কটি বড় পত্রিকা দেশ, জাতি, সমাজ, শিক্ষা—এসব নিয়ে বড় বড় আলোচনা করে; কিন্তু তারা সবাই নিয়মিতভাবে তাদের পত্রিকায় গাইড বই ছাপায়; যদিও এ দেশে গাইড বই বেআইনি। গাইড বই ও পাঠ্য বইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী যারা জানেন না তাদের মনে করিয়ে দেওয়া যায় পাঠ্য বইয়ে একটি বিষয় সম্পর্কে লেখা হয়। গাইড বইয়ে শুধু প্রশ্ন ও তার উত্তর লেখা হয়। ছেলেমেয়েরা গাইড বই থেকে কোনো বিষয় সম্পর্কে জানে না, তারা শুধু কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর মুখস্থ করতে শেখে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেহেতু পরীক্ষানির্ভর হয়ে গেছে, তাই কোনো কিছু শেখার থেকে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে সবাই আগ্রহী। দেশের বড় বড় পত্রিকা অভিভাবকদের বোঝাতে পেরেছে যে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে হলে তাদের পত্রিকায় ছাপানো গাইড বইটি ছেলেমেয়েদের মুখস্থ করানো দরকার। দেশে যখন কোনো অন্যায়-অবিচার হয় তখন মাঝেমধ্যেই দেখি হাইকোর্ট নিজ থেকে এই অন্যায়-অবিচারগুলোতে হস্তক্ষেপ করে বিষয়গুলোর সুরাহা করে দেন। আমি স্বপ্ন দেখি, এ দেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার সর্বনাশ করা খবরের কাগজের এই গাইড বইগুলো হাইকোর্টের নির্দেশে কোনো একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। (স্বপ্ন যখন দেখছি তখন পুরোটাই দেখে ফেলি, আমি স্বপ্ন দেখি এ দেশের ছেলেমেয়েদের আলাদাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার অমানবিক এই নিয়ম বন্ধ করে হাইকোর্ট একদিন নির্দেশ দেবেন সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে)।

যা-ই হোক, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সেই ভিডিওর বিষয়বস্তুতে ফিরে যাই। সেখানে দেখানো হয়েছে, গাইড বইয়ের প্রকাশকরা বড় বড় বান্ডিল করে স্কুলে স্কুলে যাচ্ছে এবং দুর্নীতি পরায়ণ হেডমাস্টাররা সেই গাইড বই তাদের কাছ থেকে নিচ্ছেন এবং ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। যে স্কুলগুলো ভালো সেখানে গাইড বইয়ের লোকজন ঢুকতেই পারছে না এবং স্কুলের দারোয়ানের হুংকার শুনে প্রাণ নিয়ে পালাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ছে।

লেখাপড়ার ভূমিকাটি দেখিয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডের ভিডিওটিতে তারা প্রশ্নব্যাংকের মূল বিষয়টিতে ফিরে গেছেন। যারা সৃজনশীল প্রশ্ন করার বিষয়টি জানেন তারা শিক্ষকদের ট্রেনিং দিচ্ছেন। শিক্ষকরা এরপর সৃজনশীল প্রশ্ন করছেন এবং সেই প্রশ্নগুলো প্রশ্নব্যাংকে জমা হচ্ছে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধাঘণ্টা আগে নেট থেকে পরীক্ষার জন্য এক সেট প্রশ্ন নামিয়ে সেটা ছাপিয়ে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।

ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, পরীক্ষার শেষে ছেলেমেয়েরা নিজেরা নিজেরা কথা বলছে। যারা পাঠ্য বইটি পুরো পড়ে এসেছে, তারা বলছে, তাদের পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। যারা গাইড বই, কোচিং সেন্টার আর খবরের কাগজের শিক্ষাপাতা মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়েছে, তারা হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলছে, তাদের পরীক্ষা একেবারেই ভালো হয়নি। কারণ মুখস্থ করে আসা অসংখ্য প্রশ্ন ও উত্তর থেকে একটি প্রশ্নও ‘কমন’ পড়েনি!

৩.
ভিডিওটি কাল্পনিক এবং অবশ্যই যশোর শিক্ষা বোর্ড এটি তৈরি করেছে তাদের নিজেদের উদ্যোগটি প্রচার করার জন্য। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে, লেখাপড়ার একেবারে মূল সমস্যাগুলো তারা কিন্তু দেখাতে পেরেছে। এটি শুধু একটি প্রচারণামূলক ভিডিও হতে পারত, যদি তারা এর পেছনের কাজগুলো করে না রাখত। শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা আমাকে জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সব শিক্ষা বোর্ডের কাছে প্রশ্নের ব্যাংক বানানোর জন্য নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল এবং সেই নির্দেশনা পেয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ড তাদের প্রশ্নব্যাংক তৈরি করার উদ্যোগটি নিয়েছিল। প্রশ্ন করার জন্য একটি চমৎকার পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে, কর্মকর্তারা আমাকে সেটি দেখিয়েছেন এবং দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে অভিভূত করেছে সেটি হচ্ছে, প্রশ্নের সংখ্যা তারা আমাকে জানিয়েছেন, তাদের প্রশ্নব্যাংকে এরই মধ্যে এক লাখের মতো প্রশ্ন জমা হয়ে গেছে!

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যেহেতু সব শিক্ষা বোর্ডকেই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল, কাজেই হয়তো অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডও একইভাবে প্রশ্নব্যাংক তৈরি করে ফেলেছে কিংবা তৈরি করতে যাচ্ছে। আমি যেহেতু শুধু যশোর শিক্ষা বোর্ডের উদ্যোগটি দেখেছি, তাই শুধু তাদের কথাটিই বলছি। অন্যদের কথা জানলে সেটাও সমান আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে বলতাম।

আমাদের দেশে যখন প্রথম সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করা হয়েছিল তখন আমরা সবাই এটা নিয়ে খুবই আগ্রহী হয়েছিলাম। এটা বাংলাদেশের আবিষ্কার নয়, সারা পৃথিবীতেই এভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়—আমরা একটু দেরি করে শুরু করেছি। যখন এই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয় তখন আমরা অনুমান করেছিলাম প্রথম প্রথম এভাবে প্রশ্ন করতে শিক্ষকদের একটু অসুবিধা হবে; কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই ব্যাপারটি ধরে ফেলবে। শিক্ষকদের সে জন্য ট্রেনিং দেওয়া হবে এবং প্রথম প্রথম কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশ্ন তৈরি করে স্কুলগুলোতে পাঠানো হবে। আমরা আবিষ্কার করলাম, পরীক্ষার মান বাড়ানো থেকে পরীক্ষায় পাসের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে একটা ঝোঁক তৈরি হলো এবং যেনতেন পরীক্ষা হলে কিংবা প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেলেও সেটা নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা হতো না। এখানে ‘কারো’ বলতে আমি যে শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বোঝাচ্ছি তা নয়, আমাদের দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদের কথাও বলছি। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আমি কাউকে তেমন সোচ্চার হতে দেখিনি এবং আমি চেষ্টা করেও বড় বড় শিক্ষাবিদের এটা নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করাতে পারিনি। তখন যা হওয়ার কথা তা-ই হতে লাগল, গাইড বই থেকে প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হলো এবং সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির যেটুকু ভালো ফল নিয়ে আসার কথা ছিল, ঠিক ততটুকু খারাপ ফল আনতে শুরু করল। দুর্ভাগা ছাত্রদের পুরো বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে কুৎসিত গাইড বই মুখস্থ করা শুরু করতে হলো।

অন্য সবার মতো আমিও বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবেছি এবং আমার মনে হয়েছে, এ সমস্যার সবচেয়ে সহজ আর কার্যকর সমাধান হচ্ছে একটি প্রশ্নব্যাংক। সেখানে ১০০-২০০ প্রশ্ন থাকবে না, আক্ষরিক অর্থে লাখ লাখ প্রশ্ন থাকবে। শিক্ষকরা তাদের প্রয়োজনে সেখান থেকে প্রশ্ন নামিয়ে পরীক্ষা নিতে পারবেন। ছাত্রছাত্রীরা সেখান থেকে প্রশ্ন নামিয়ে নিজেদের যাচাই করতে পারবে (যেহেতু একই সঙ্গে প্রশ্ন আর তার উত্তর নামিয়ে সেটা মুখস্থ করার কোনো সুযোগ থাকবে না, তাই সেটা কখনোই গাইড বই হয়ে যাবে না)! ছাত্রছাত্রীরা যখন আবিষ্কার করবে তাদের পরীক্ষার প্রশ্ন আর কোনো গাইড বই থেকে আসছে না কিংবা কোনো কোচিং সেন্টারের মডেল টেস্ট থেকে আসছে না তখন রাতারাতি এই বাণিজ্যগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

কিন্তু উদ্যোগটি সহজ নয়, ব্যক্তিগতভাবে করাও সম্ভব নয়। এটি করা সম্ভব শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। তাই যখন আমি আবিষ্কার করেছি, আমি যে বিষয়টি নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম যশোর শিক্ষা বোর্ড হুবহু সে বিষয়টিই করে রেখেছে, তখন আমার আর আনন্দের সীমা ছিল না। (আমার ছাত্র আর শিক্ষকরা মিলে এ ধরনের একটি উদ্যোগ বেশ আগেই নিয়েছিল, যশোর শিক্ষা বোর্ডের উদাহরণটি দেখে তাদের উৎসাহ শতগুণে বেড়ে গেছে)।

কাজেই আমি অনুমান করছি, যশোর শিক্ষা বোর্ডের উদাহরণটি দেখে এ রকম একই ধরনের উদ্যোগ অনেকেই নেবে। সব শিক্ষা বোর্ড যদি এরই মধ্যে এটা না করে থাকে নিশ্চয়ই তারাও এ কাজ শুরু করবে। (এবং হ্যাকাররা অবশ্যই এটা হ্যাক করে ফেসবুকে দেওয়ার চেষ্টা করবে; কিন্তু সেটা অন্য ব্যাপার! প্রযুক্তির সমস্যা আমাকে কখনোই দুর্ভাবনায় ফেলে না)।

কাজেই বলা যেতে পারে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা, সঠিকভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন করা—তার একটি চমৎকার সমাধান বের হয়ে গেছে।

সৃজনশীল পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর এটাকে নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যারা এ সম্পর্কে ভাসা ভাসাভাবে জানেন, তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় প্রশ্ন হচ্ছে—এ রকম আমরা সৃজনশীল পরীক্ষা নিচ্ছি কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের আমরা কি সৃজনশীলভাবে পড়াচ্ছি? এ প্রশ্ন শুনে আমি হাসব, না কাঁদব বুঝতে পারি না। কারণ প্রশ্নের বেলায় ‘সৃজনশীল’ শব্দটি একটি নাম ছাড়া আর কিছু নয়। এর প্রকৃত নাম ‘কাঠামোবদ্ধ’ শব্দটি একটা কটমটে বলে এই নাম দেওয়া হয়েছিল।

যা-ই হোক, যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নব্যাংক, সেই প্রশ্নব্যাংকে প্রশ্ন জমা দেওয়ার পদ্ধতি এবং সেই প্রশ্ন ব্যবহার করে পরীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়াটি দেখে আমার সব দুর্ভাবনা একেবারে কেটে গেছে। তারা একটি চমৎকার উদাহরণ তৈরি করেছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এখন সেই উদাহরণ অন্য সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে। সে জন্য বলছিলাম, লেখাপড়া নিয়ে এখন আমার আর কোনো দুর্ভাবনা নেই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test