E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভাবনার সমুদ্র হয় ক্ষুদ্র প্রকাশনায়

২০১৬ ডিসেম্বর ১৩ ২০:০০:৪১
ভাবনার সমুদ্র হয় ক্ষুদ্র প্রকাশনায়

শেখর রায়


বাংলা ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গেলে দুই বাংলার সীমান্ত অস্বীকার করতেই হবে। কারণ আমাদের শিকড় এক। আমাদের প্রকাশ অভিন্ন, আমাদের উপলব্ধির মিল, আমাদের কামনা বাসনার জগতের মধ্যে আমরা একত্রে বসবাস করি। ফলে বাংলা বলতে কেউ কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য বলতে চাইলে, সম্পূর্ণ হয় না তার ইতিহাস। ঢাকা ময়মনসিং সিলেট চট্টগ্রাম ও অন্যান্য অঞ্চলের বঙ্গ মানসের সাহিত্য সংস্কৃতির উপলব্ধির প্রকাশ ব্যতিত, ভাষা গবেষণা পূর্ণ হয় না। এখানে যদিও আলোচনার ক্ষেত্রটি সীমিত এবং শুধু লিটল ম্যাগাজিন, তথাপি এই তথাকথিত ক্ষুদ্র পত্রিকা প্রকাশনা বস্তুতপক্ষে দুই বঙ্গের মনন ও বঙ্গ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে চলেছে। ইদানিং কালের তথ্যপ্রযুক্তি সেই কাজকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। স্বল্প পরিসরে এই প্রবন্ধ হয়ত এই আলোচনার বিভিন্ন দিক নির্দেশ করতে পারে, করতে পারে তার অপূর্ণ বাসনার মধ্য দিয়ে এক পূর্ণতার দিকে যাত্রা।

কল্লোল পত্রিকা দিয়ে ১৯২৩ এ যার বঙ্গ অভিযান শুরু হয়েছিল শহর কলিকাতা থেকে, সীমান্ত পত্রিকা দিয়ে ১৯৫২ এ যার যাত্রা চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে ধাবিত হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-র বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ঢাকার রক্তাক্ত রাজপথ ও ১৯৬২ তে শিলচরে বাংলাভাষা আন্দোলন অগুনতি বঙ্গ সন্তানের বলিদান ব্যর্থ হয়নি। পেয়েছি বাংলা ভাষার মর্যাদা, বাঙ্গালীর নিজের এক স্বাধীন দেশ, পেয়েছি বাংলাদেশ ১৯৭১ এ। কিন্তু মধ্যের এই ২০টি বছর লিটল ম্যাগাজিনের জন্য ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন এক সময়কাল। কারণ পাকিস্তান সরকারের বাংলা ভাষা বিরোধী উগ্র অবস্থান। উগ্র ইসলামের ব্যাপক প্রচারনা, বিভক্ত বাংলায় বাংলা ভাষা সংস্কৃতি চর্চার গতিপথ অবরুদ্ধ করে রাখে।

চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মাহবুব আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরী সম্পাদিত ১৯৪৭ থেকে সীমান্ত নামে লিটল ম্যাগাজিন ১৯৫২র বাংলার ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখে। ঢাকা থেকে ফজলে লোহানি সম্পাদিত অগত্যা প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ এ। বামপন্থী ধারার বাইরে গিয়ে কলকাতার সুনীল গাঙ্গুলি-শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মাতব্বরিতে গঠিত হাংরি জেনারেশন ও কৃত্তিবাস পত্রিকা গোষ্ঠী ১৯৬১ থেকে লোহানির অগত্যা পত্রিকার প্রভাবে প্রভাবিত হয় এবং যেখানে নব্য বুর্জোয়া ধ্যান ধারনা, নয়া শহুরে ইয়াংকি কালচারের হাতছানি থাকে। আর এদের থেকে প্রচারে ও মেধায় এগিয়ে থাকে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম ও কম্যুনিস্ট ভাবাদর্শের অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিন আন্দলেনের বিখ্যাত কবি লেখকেরা যাদের অভিযান শুরু হয় কবিতা ও পরিচয় পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ১৯২৩ থেকে। কাজী নজরুল, মোহিতলাল, অচিন্ত সেনগুপ্ত, সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসু ইত্যাদির রচনার সহজিয়া প্রকাশ বাংলা সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তোলে। পাশাপাশি এদের রচনায় ছিল সমাজ বদলের উদাত্ত আহ্বান।

ঢাকা ও সংলগন জেলাগুলি থেকে বেশ কিছু উজ্জ্বল লিটল ম্যাগাজিনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে তাদের মধ্যে যেমন যাত্রিক, যার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন আব্দুল আলেম চৌধুরী ও আহমেদ কবির ১৯৫৩ থেকে। চীন ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণআন্দোলনকে সামনে রেখে বাংলার প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিকেরা ভিড় জমাতেন যাত্রিকে। উৎকৃষ্ট লেখনী ও অভূতপূর্ব মেধার দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে ছিল যাত্রিকের পাতায়, পাতায়। যদিও পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের শ্যেন দৃষ্টি ছিল এই ধরনের অনেক লিটল ম্যাগাজিনের উপর। ষাটের দশকে ক্ষুব্ধ প্রজন্ম (১৯৬৩), যা ছিল কলকাতার ক্ষুধার্ত প্রজন্মের পাল্টা উত্তর। এরপর কণ্ঠস্বর (১৯৬৫), ছোট গল্প (১৯৬৬), সাম্প্রতিক (১৯৬৪), সপ্তক (১৯৬২), বক্তব্য (১৯৬৩), যুগপথ (১৯৬৩), কালবেলা (১৯৬৫), না (১৯৬৭), বহুবচন (১৯৭০), স্বদেশ (১৯৬৯), শব্দের বিকৃতি (১৯৬৯), শিল্পকলা (১৯৭০) ইত্যাদি। এইসব লিটল ম্যাগাজিন যেমন একদিকে জন্ম দিয়েছে প্রতিথজশা সাহিত্যিকের, তেমন জন্ম দিয়েছিল সমাজ ও শাসন ব্যবস্থা বদলের আকাঙ্ক্ষা। ১৯৭১ এ বাংলার মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র ও প্রেক্ষাপট তৈরিতে এই ক্ষুদ্র পত্রিকাগুলির বিশাল ভুমিকা ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ ও বাংলার বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ইসলামকে সামনে রেখে শুরু হয় নির্বীজকরণ প্রক্রিয়া। অগুণতি ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র থেকে সরাসরি শুরু হয় বঙ্গ সংস্কৃতি বিরোধী ইসলামী প্রচারনা।

মুক্তবুদ্ধি চর্চার আশ্রয় স্থল লিটল ম্যাগাজিন ও তার কবি লেখকেরা বহু ক্ষেত্রে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠে। আবার অন্ধকার নেমে আসে বাংলার প্রান্তে। এই বন্ধদশার আপাতঃ অবসান হয় বঙ্গবন্ধু কন্যার শাসন ভার গ্রহনে। শুরু হয় পুনরায় মুক্তবুদ্ধির চর্চা। জেলায় জেলায় উৎসাহিত নব্য লেখককুল ও প্রকাশিত হতে থাকে অগুনতি পত্রপত্রিকা। নবজন্ম ঘটে এক ঝাঁক আধুনিক কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিকের। চলে শিল্পকলার বিকাশ। উঠে আসে প্রতিশ্রুতিবান শিল্পীরা। লিটল ম্যাগের পাতায় প্রকাশিত হয় সব অনবদ্য ছবি, লিখিত হয় আধুনিক নাট্যকলা, শিল্পচর্চার সম্ভার। সারা বাংলাদেশে প্রবাহিত হতে থাকে মুক্তির শীতল বাতাস। জেলায় জেলায় সংগঠিত হয় লিটল ম্যাগ বই মেলা, ঢাকায় কেন্দ্রীয় একুশে বই মেলা যেখানে ছড়িয়ে থাকে শত শত লিটল ম্যাগাজিন, ভাস্বর হয়ে উঠে প্রতিশ্রুতিবান কবি লেখক শিল্পীরা। কিন্তু পুনরায় ভাটা পড়ে যায় সেই উৎসাহ উদ্দীপনায়। কারণ পরাজিত ইসলামী মৌলবাদ লালিত জঙ্গিবাদী শক্তির পুনরুথান। একের পর এক নির্মম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশক, লেখক, কবি ও চিত্রকরদের ভীত সন্ত্রস্ত করে চলে। তবু থেমে থাকে না মানুষ, থেমে থাকে না তার শিল্প সাহিত্য চর্চা এবং থামবে না বাঙ্গালি, থামবে না তার কলম।


লেখক : পশ্চিম বাংলার গণমাধ্যম কর্মী ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test