E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

সংখ্যালঘুদেরও সৎসাহস দেখাতে হবে

২০১৭ জানুয়ারি ১৭ ২৩:৪৮:৪৩
সংখ্যালঘুদেরও সৎসাহস দেখাতে হবে


মাহমুদুর বাসার

 

রবীন্দ্রনাথ গল্পের আকারে বলেছেন, ‘একবার ছাগলকূল ঈশ্বরের কাছে নালিশ করলো, ‘ঈশ্বর, বাঘ আমাদের খায় কেন? উত্তরে ঈশ্বর বললেন, বাপুরে তোমাদের দেখলে আমারই থেকে ইচ্ছা করে, কারণ তোমরা অতিশয় দূর্বল।’

ড. মহানাম ব্রত ব্রহ্মাচারী বলেছেন, ‘দূর্বলতাই পাপ।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিরই মনোবল ভেঙে গিয়েছিলো। একই সঙ্গে সংখ্যা লঘুদের মনোবলও মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো। এই বাস্তবতা অস্বীকার করে কোনো সত্যকেই উদঘাটন করা যাবে না। পাকিস্তান আমলে সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ছিলো, ১৯৭৫ এদেশের ১৫ আগস্টের পর পুনরায় এদেশের সংখ্যা লঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দর্শনে বিশ্বাস করতো, সংখ্যালঘুদের শত্রু ভাবতো। ১৫ আগস্ট পরবর্তী সরকারও সংখ্যালঘুদের শত্রু ভেবেছে। পাকিস্তান আমলে সংখ্যালঘুদের মনোবাল বলে কিছু ছিলো না, ৭৫ পরবর্তীকালেও সংখ্যালঘুরা বগ্নমনোবলে পরিণত হয়। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতিবাদ করার অভ্যাস কম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে তাদের প্রতি যে অবিচার হয়েছে তারা তার কোনো প্রতিবাদ করেনি। শুধ্ ুমুখ বুজে অন্যায় হজম করেছে, অন্যায় প্রশ্রয় দিয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি আঙ্গুল তুললেও তার প্রতিবাদ করা হয়। কিন্তু সংখ্যালঘুরা তাদের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি আঙুলও তোলেনি। করুণা ভিক্ষা করে বেঁচে থাকা যায় না। বেঁচে থাকার আরেক নাম লড়াই। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের লড়াকু মনোভাব নেই্, তাদের আপোস কামী মনোভাবই প্রধান। যখন সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা খারিজ করা হলো, তখন সংখ্যা লঘুদেরই প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো। কেননা সংবিধানকে পাকিস্তানি শাসকদের অনুকরণে মুসলমানীকরণ করা হয়েছিলো সংখ্যালঘুদের দমন করার জন্য। সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক দলিলে পরিণত করার ফলে সমাজে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের মাটি থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তি একেবারে উৎখাত হয়েছিলো, ব্যাপারটা এমন না হলেও সেদিন সাম্প্রদায়িক শক্তি পরাজিত হয়েছিলো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শুধু পাকিস্তানি শাসকদের পরাজয় ঘটেনি। পরাজয় ঘটেছিলো জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দর্শনের। তবে পরাজয়টি ছিলো তাৎক্ষনিক। ধর্ম নিরপেক্ষ শাসনকালের সীমা ছিলো মাত্র সাড়ে তিন বছর। এত অল্প সময়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার শেকড় উৎপাটন সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই সাড়ে তিন বছর সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়নি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে সংবিধান থেকে কেউ ধর্মনিরপেক্ষতা অপসারণ করতে পারেনি। জামাত-শিবির-মুসলিমলীগ মাঠে নামতে পারেনি। মনস্তাত্ত্বিক ভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসীরা দূর্বল ছিলো। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে চক্রান্তমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচ্ছিন্ন ভাবে হিন্দদের মন্দিরে হামলা হয়েছিলো। কিন্তু সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তখনো বুক ফুলিয়ে মাথা তুলতে পারেনি। তখন মাওলানা ভাসানীর মত প্রবাদ প্রতীম জননেতা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে কাবু করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানী সাম্প্রদায়িক দল গুলোকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী সরাসরি হিন্দুদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘হিন্দুরা, তোমাদের দশা বিহারীদের দশা হবে।’

একথা লেখা আছে শওকত ওসমানের ‘ইতিহাসে বিস্তারিত’ বইতে। তখন কমরেড মনিসিংহ ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ কখনো কোনো অবস্থায় সাম্প্রদায়িক, উস্কানিমূলক রাজনীতি করেননি। বাকশাল গঠন করার আগে বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মোকাবেলা করার জন্য শ্রদ্ধেয় মনিসিংহ ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মঙ্গে জোট গঠন করেছিলেন। তখন অপশক্তি শ্লোগান দিয়েছিলো, ‘মুজিব, মণি, মোজাফফর- এই তিন মীর জাফর।’ তাই নাকি? পরবর্তীকালে বিএনপির মঞ্চ থেকে শ্লোগান দেয়া হয়েছে, ‘ভারত যাদের মামার বাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।’ আমি যখন নব্বই দশকে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করি, তখন ছাত্রদলের ছেলেদের মুখে একটি শ্লোগান শুনেছিলাম, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম শেখ হাসিনার বাপের নাম।’ বিএনপির লোকদের মুখে শুনেছি, ‘জয়বাংলা জয় হিন্দ, লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি পিন্দ।’ একদিন পত্রিকায় দেখি বিএনপির জাঁদরেল নেতা সাকা চৌধুরী শেখ হাসিনাকে ‘মাসিমা’ বলে উপহাস করছেন। এসব সাম্প্রদায়িক উক্তি, মতামত, মনোভঙ্গির জন্ম হয়েছে’ ৭৫ পরবর্তী কালে। প্রতিটি উক্তির মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়কে গৃণা করার, অবজ্ঞা করার, উৎখাত করার ইন্ধন ছিলো। ঝুঁকি নিয়ে হলেও এসব সাম্প্রদায়িক শ্লোগানের বিরোধিতা করা উচিত ছিলো সংখ্যালঘুদের। প্রতিবাদ না করতে করতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মাটির তলায় সেঁধিয়ে গেছে। সাহস করে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখলে প্রতিবাদের ভাষা প্রখর হোতো। সংখ্যা লঘুরা এদেশে প্রতিবাদহীন প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিকূলতার মুখে এদেশের সংখ্যালঘুরা বুকটান করে ঘুরে দাড়াবার চর্চা কখনো করেনি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির চর্চা হয়েছে সাড়ে তিন বছর আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। ২১ বছর জামায়াত-শিবির অবারিত ভাবে এদেশে রাজনীতি করেছে। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে এদেশে তাতে বিএনপি জামায়াত সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক বিভেদের দৃষ্টি প্রয়োগ করেছে। এতে সংখ্যালঘুদের মনোবলের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে। একমাত্র অভিযোগ, হিন্দুরা নৌকায় ভোট দেয়। এমন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুরা তেমন কোনো প্রতিবাদ করেনি। করা উচিত ছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামীলীগের ওপর যে আঘাত নেমে এসেছিলো তা পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক ওপর এসেছে কিনা সন্দেহ। বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের ৩২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়, এরপর আবার জেলখানায় ৪ জন জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দলটি। এরপর আওয়ামীলীগকে কাঠগড়ায় দাড় করানো হয় হিন্দু ঘেঁষা দল হিসেবে। জয়বাংলা শ্লোগানের অবমূল্যায়ন শুরু হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার জঘন্য অপব্যাখ্যা শুরু হয় তখন। এক ফাঁকে বলা দরকার; বঙ্গবন্ধুর ৪ মূলনীতির অপব্যাখ্যা একশ্রেণির উগ্রবাম পন্ডিতরাও দিয়েছেন। তারা কখনো ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে এবং নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের পক্ষে কোনো কথা বলেননি। তাদের আওয়ামীলীগ বিরোধিতার যে কৌশল, এতে সম্প্রদায়িকতা বর্ধিত হয়েছে। অত্যন্ত ধারালো কৌশলে তারা বিএনপির রাজনীতি করে থাকেন। জনপ্রিয় কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী একটি বই লিখেছেন, নাম ‘বাংলাদেশে বামপন্থি রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা’ সেখানে দেখিয়েছেন, শ্রেণিরাজনীতির নামে কিভাবে এই সব উগ্রবাম পন্ডিতরা বিএনপি জামায়াতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সমর্থন করেছেন। ১৯৭১ সালে চীনের জঘন্য ভূমিকার পক্ষেও ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের ভূমিকা এখনো এমনই আছে। ১৯৭৯ সালে আওয়ামীলীগের সভাপতি হয়েছিলেন আবদুল মালেক উকিল। তিনি জিয়ার দূরভিসন্ধিমূলক ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দের রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রতিবাদ করতেন, বিএনপির লোকজনেরা এজন্য প্রবীণ, অভিজ্ঞ, বিদ্বান মালেক উকিলকে ‘ভগবান দাস’ বলে উপহাস করেছেন। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করা হয়েছিলো। এর প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো সংখ্যা লঘুদের। প্রবীণ, অভিজ্ঞ পার্লামেন্টরিয়ান সুরঞ্জিত গুপ্তকে ‘জলমহাল বাবু’ বলে উপহাস করেছে বিএনপির লোকেরা। এর প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো সংখ্যালঘুদের।
শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী হয়েই তিনি চট করে ক্ষমতায় চলে যাননি। অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। সাম্প্রদায়িক অস্ত্র দিয়ে তাঁকেও কম ঘায়েল করা হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের মত জঙ্গি সাম্প্রদায়িক দলকে, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোকাবেলা করেছেন। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক অপ-প্রচারের অস্ত্র দিয়ে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করা হয়েছিলো। বলা হয়েছিলো ‘নৌকায় ভোট দিলে আপনাদের সন্তানের নাম রহিম রাখতে পারবেন না, রাম রাখতে হবে।’ এই অপপ্রচারের প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো সংখ্যালঘুদের। ২০০১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া বলেছিলন, ‘আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে উলুধ্বনি বাজবে।’ একটি দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি এর চেয়ে অপমানজনক কথা আর কোনো দল বলেনি। এমন ন্যাক্কার অনেক কথার প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো সংখ্যালঘুদের। নাসির নগরের ঘটনায় সংখ্যালঘুরা যে প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছে, একজন মন্ত্রীর সেচ্চার কন্ঠে পদত্যাগ দাবি করেছে, আমি একজন সামান্য লেখক হয়ে এই প্রতিবাদকে স্বাগত জানাই। আমি চাই বিশ্বের প্রতিটি দেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা সৎসাহসী হোক, ধারালো প্রতিবাদী হোক। ড. মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘এদেশের সংখ্যালঘুদের মিন মিন করে বেঁচে থাকার অর্থ হয় না।’ আবদুল গাফফার চৌধুরীও তাই বলেছেন।

মাহমুদুর বাসার
কলাম লেখক, গবেষক।

(আরপি/এস/জানুয়ারি ১৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test