E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভোট দিন পুরস্কার ছিনিয়ে নিন!

২০১৭ জানুয়ারি ১৮ ১৪:৪৯:৩২
ভোট দিন পুরস্কার ছিনিয়ে নিন!

সজল ফরাজি


বাংলা একাডেমির পুরস্কার কিভাবে দেওয়া হয় আমরা জানি। সাহিত্যে যখন একজনকে পুরস্কার দেওয়া হয়, তাকে সাহিত্যিক তো হতেই হয়। এর সঙ্গে আর কী হতে হয় সে সম্পর্কে আমরা অবহিত। কিছুটা রাজনীতি- রাজনীতি যখন, তখন আবার প্রশ্ন আসে কোন রাজনীতির ছত্রছায়ায় তার বিচরণ; কিছুটা আমলা; কিছুটা সম্পর্কজীবী। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সাহিত্যিক সমাজে এই পুরস্কার নিয়ে অসন্তোষ আছে। কবি-লেখকদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি অসন্তোষ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কারণ তাদের চোখে যে সমাজ ও রাষ্ট্রের নকশা, এর সঙ্গে সব সময়ই প্রতিষ্ঠানের বিরোধ থাকে।

এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার উৎস হলো- সাম্প্রতিক সময়ে দেখছি, স্বয়ং কবি-লেখকরাও পুরস্কার নিয়ে প্রকাশ্যে এই নোংরা খেলায় মেতেছেন; যা বড়ই বেদনাদার ও লজ্জার। প্রথম দশকের শুরুর দিকেই গ্রুপিং করে বেড়ান প্রথম দশকের জনৈক কবি তার এফবিতে একটা অনলাইন সাহিত্য পোর্টাল ‘পরস্পরের’ লিঙ্ক দিয়েছেন, (যেখানে তিনি সম্পাদনা পর্ষদের একজন)। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য এবার কাকে যোগ্য মনে করেন?’ ‘ভোট দিন পুরস্কার ছিনিয়ে নিন’। ভোট দেওয়ার জন্য অপশন দেওয়া হয়েছে : ময়ুখ চৌধুরী/আবু হাসান শাহরিয়ার/মাসুদ খান/সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। তার পরবর্তী এক স্ট্যাটাশে দেখা যায়- এখান থেকে আবার দুইজন নির্বাচিত হয়েছেন মাসুদ খান ও আবু হাসান শাহরিয়ার। আমরা হয়তো ভাবতে পারতাম বাংলা একাডেমির এখন এই দুইজনের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার পালা। কিন্তু প্রথম দশকের কবিটি মাসুদ খানকে বিজয়ী ঘোষণা করে তার হাতে পুরস্কার তুলেই দিচ্ছেন।

বাংলা একাডেমির পুরস্কারের জন্য অনেকেই যোগ্য হতে পারেন। হওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং না হওয়াই দুঃখজনক এবং বাংলা সাহিত্যের জন্য চরম দীনতা। সাহিত্যিকদের মধ্য থেকে কোনো চক্রের প্রকাশে যৌগ্যতার প্রশ্ন তুলে চারজনকে দাঁড় করিয়ে একজনকে বেছে নেওয়া; এমন কি কেউ করতে পারে বা করা উচিৎ? যৌগ্য অনেকেই থাকবেন। তার মধ্য থেকে একজনকে মনোনিত করা হবে। সাহিত্যিকদের মধ্যে এটা নিয়ে কৌতূহল থাকতে পারে, নোংরামি নয়। আর ভোট দিয়ে যে পুরস্কার ছিনিয়ে নেওয়া কথা বলা হচ্ছে, একজন কবির মুখ থেকে আমাদের এই কথা শুনতে হচ্ছে। এটা কোনো সৃস্টিশীল কবির ভাষা হতে পারে না। আমরা দেখছি কবি মাত্রই সৃষ্টিশীল নয়, রাজনীতীবাজ ও ধান্ধাবাজও হয়। কেবল সংখ্যাধিক্যের জন্য নয়, সম্ভবত এদের জন্যও কবিদেরকে কাকের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ঘরে কী বাইরে অবজ্ঞার শিকার হতে হয়। পুরস্কার কি ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়? ছিনিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন কেন আসবে? তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে, এটা মাসুদ খানের প্রাপ্য নয়। চক্রটি পুরস্কার দাবী করলেও তারাও তা-ই মনে করেন। ফলে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন। আবার উল্টোও হতে পারে- এটা মাসুদ খানের প্রাপ্য, কিন্তু যুগের পর যুগ তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে; এবার সময় এসেছে পুরস্কারটি ছিনিয়ে নেওয়ার। ‘ছিনিয়ে নেওয়া’ যদি কেবল কথার কথাও হয়, তাহলে প্রশ্ন থাকে-এরকম ভাষা রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে, সাহিত্যে না।

জনৈক কবির কথায়, তার ভাষা লক্ষ্য করা যাক- ‘‘গুণবান কবি মাসুদ খান ও উনপ্রাণ কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের মধ্যে একটা বেশ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো। 'পরস্পর'-এর পোলিং প্রযোজনায় এগিয়ে গেছেন মাসুদ খান। অর্থাৎ তাকে বিজয়ী বলা যায়।’’ একজন গুণবান! অপরজন উনপ্রাণ! এই দুইজনকে তিনি দৌড় প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছেন, তারা দৌঁড়াচ্ছেন আর তিনি ধারাভাষ্য দিচ্ছেন।

ধারাভাষ্যকার তার মতামত দিচ্ছেন, ‘‘আমরা চাই বাংলা একাডেমি একটা গ্রহণযোগ্য পুরস্কার হয়ে উঠুক।’’ বাংলা একাডেমি কিভাবে একটা গ্রহণযোগ্য পুরস্কার হয়ে উঠবে বুঝলাম না! আবার বলছেন- ‘‘এই পুরস্কার তুমি হেফাজত করো মাবুদ। আমিন।’’ পুরস্কারের জন্য হয়তো নিজেদের ঘরে ঘরে মিলাদও দিয়েছেন, মাবুদের কাছে কান্নাকটিও করেছেন। মাবুদকেও হাতে রাখছেন। যাতে করে কোনোভাবেই পুরস্কার পাওয়া কেউ ঠেকাতে না পারে। যেন অন্য কেউ আবার ছিনিয়ে নিতে না পারে। এদের প্রস্তুতি বেশ ভালোই, আশা করি পারবে না।

মাসুদ খান কেন যোগ্য, আর কেউ নয়। তিনি যাদেরকে দেশে রেখে গেছেন, সেই চক্রটি এ বিষয়ে কিছু বলেন নি। তবে তাদের কথায় এটা প্রতিয়মান যে, মাসুদ খানকে পুরস্কার পেতেই হবে। পুরস্কার পাওয়ার মধ্যেই তার কবিজীবনের স্বার্থকতা লুকিয়ে রয়েছে। মাসুদ খান রয়েছে সুদূর প্রবাসে। এই প্রশ্নটিও প্রাসঙ্গিক যে, কেন প্রবাসে তিনি? তিনি কি শাসক শ্রেণীর নিপীড়নে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন? না কোনো গোষ্ঠীর চাপাতি বা বন্দুকের নলের ভয়ে? তিনি এমনকি লিখেছেন বা বলেছেন? আমাদের জানা নেই, এমনটি হলে জানার কথা। জনৈক কবির কাছে আমাদের প্রশ্ন- এই ‘মাসুদ খানের’ জন্য এতো দরদ, ভালোবাসা, ও আবেগের উৎস কোথায়?

এইসব নোংরামি দেখে আমাদের সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠে। পরস্পর কর্তৃক নির্বাচিত কবি মাসুদ খানের এই চক্রটি কারা? যারা বাংলা একাডেমির কাছে তার গুরুর নাম প্রস্তাব করছেন পুরস্কারের জন্য। মাসুদ খান কি তাদের এই দায়িত্ব দিয়ে বিদেশে নিশ্চিন্ত আছেন। কিংবা আবু হাসান শাহরিয়ার কি তাকে টেণ্ডার দিয়েছেন। এটা কি কারো টেণ্ডার বা দায়িত্ব দেওয়ার বিষয় কিংবা যে কারো যেখানে সেখানে নাম প্রস্তাবের বিষয়? আমারা সব সময় প্রতিষ্ঠানকে গালি দিতে অভ্যস্ত- এই গেল, সেই গেল, কিছু হচ্ছে না। কিন্তু নিজেদেরকে আমরা কোথায় দাঁড় করাচ্ছি। সব প্রতিষ্ঠানের পুরস্কারই অপাত্রেও যায়, যেতে পারে। আবার দেখি বঞ্চিত হন মহৎ লেখকরা। কিন্তু লেখকরা যখন পুরস্কার পাওয়ার জন্য জনমত তৈরি করেন- এটা কতোটা হাস্যকর, নোংরামি ও তাদের দৈন্যদশার প্রকাশ তা একজন রুচিশীল মানুষমাত্রই বুঝতে পারেন। আমাদের এইসব মহান কবিরা বোঝেন না।

এখন এই প্রশ্নে আসা যাক, মাসুদ খান এবং আবু হাসান শাহরিয়ারদের জন্য এই জনমত ও মিলাদ কেন? পুরস্কার না পাওয়া তো আরো অনেক কবি-সাহিত্যিক রয়েছেন। ভোট দিলে চারজনের মধ্যে একজনকে বেছে দিতে হবে। এর বাইরের যারা রয়েছেন, তাদের নিয়ে জনৈক কবির কোনো বক্তব্য নেই। আর এটা যদি তার নিছক রসিকতা হয় তা-ও সাহিত্যের জন্য ভালো নয়।

সর্বশেষ আমাদের হয়তো রাব্বুল আল-আমিনের কাছে মোনাজাত করতে হবে, প্রয়োজনে এজতেমার আখেরি মোনাজতের মতো লোকজন জড়ো করতে হবে; সবাই মিলে প্রার্থনা জানাতে হবে যে, অনুগ্রহ করে রাব্বুল আল-আমিন যেন মাসুদ খানকে বাংলা একাডেমির পুরস্কার পাইয়ে দিতে। না হয় চক্রটি যদি রাজপথে নেমে যায়; আমরা তো এই প্রত্যশা করতেই পারি যে, বাংলা সাহিত্য যাতে দুষিত হয়ে না যায়।

লেখক : কবি ও সাহিত্যিক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test