E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জাপানে শামসুজ্জামান খানের স্মৃতি, কিছুকথা

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ০৪ ০৬:৩৬:২০
জাপানে শামসুজ্জামান খানের স্মৃতি, কিছুকথা

প্রবীর বিকাশ সরকার


ভূমিকা: আগেই বলে দিতে চাই যে, এই নিবন্ধটি উল্লেখিত প্রতিপক্ষকে সমালোচনা বা গালাগাল করে কোনো কার্য হাসিল করা বা পুরস্কার-পদক পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয় কোনোভাবেই সুতরাং ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। সমালোচনা করার ক্ষমতাও আমার নেই, নেই পুরস্কার পাওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাও। এখানে যা বলতে চাই তা হলো: বাংলাদেশের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারবলে অধিষ্ঠিত সর্বক্ষমতার অধিকারী দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সম্পর্কে কিছু বলা। যিনি সম্প্রতি কিছু ঘটনা ঘটিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। অবশ্য এতে আমার কিছু যায় আসে না। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু তুলে ধরাই মূল লক্ষ্য, অন্যকিছু নয়।

সংযুক্ত ছবি দেখে সবাই এই ভদ্রলোককে চিনতে পারছেন। তিনি স্বনামধন্য লোক গবেষক এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক। জানি না কী যোগ্যতাবলে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের মহা পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। বিশ্বস্ত কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, তিনি প্রধান মন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ। তিনিই তাঁকে এই পদে নিযুক্ত করেছেন। এখন তো আমরা বুঝতে পারছি প্রধান মন্ত্রী কী লোককে এই পদে বসিয়েছেন এবং যাঁর স্বৈরাচারী কার্যকলাপে যারপরনাই কী রকম বিব্রত হচ্ছেন। যাক, এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাদের বলা না-বলায় কী আসে যায়!

এহেন শ্রদ্ধেয় গুরুজনস্থানীয় ভদ্রলোক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে আমার সর্বসাকুল্যে তিনবার সাক্ষাৎ হয়েছে। ২০০৮ সালের ৮ জুন তারিখে প্রথম সাক্ষাৎ আমার গ্রন্থ ‘জানা অজানা জাপান’ প্রথম খণ্ডের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সময় ঢাকা জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে। তিনি আমন্ত্রিত অন্যতম অতিথি এবং বক্তা ছিলেন। ঢাকার অনুজপ্রতীম এক বন্ধুর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ ঘটে জাপানে ২০০৯ সালে। সেই অনুজপ্রতীম বন্ধুর অনুরোধ ছিল তাঁকে যেন জাপানে একটু সময় দিই। তিনি টোকিও মহানগর ঘুরে দেখতে চান এবং জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী। তৃতীয়বার সাক্ষাৎ ঘটে ২০১১ সালে বাংলা একাডেমীতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে।

প্রথম সাক্ষাতের সময় সেই প্রকাশনা অনুষ্ঠানেই আগত আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেছিল, শামসুজ্জামান খানকে তুমি চেনো কী করে? তোমার তো তাঁকে চেনার কথা নয়!
আমি উত্তর দিলাম, আমার এক অনুজপ্রতীম বন্ধু তাঁকে আমন্ত্রণ করার কথা বলাতে রাজি হয়েছি যদিও তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ নেই, মাঝেমধ্যে তাঁর কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ পত্রিকায় পড়েছি।

বন্ধুটি বললো, তুমি তাঁকে যা ভাবছো বা তোমার অনুজপ্রতীম বন্ধু তোমাকে যা বুঝিয়েছে তিনি সেরকম কোনো লেখক বা গবেষক নন। সুবিধাবাদী লোক। আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদীদের অন্যতম তিনি। আর তিনি কী জানেন জাপান সম্পর্কে! সুদীর্ঘকাল তুমি বাইরে আছো এদেশের লোকদের তুমি চেনো না! এরপর আর কোনো সম্পর্ক রেখো না, নিজের স্বার্থ ছাড়া এরা আর কিছু বোঝে না। কাজ আদায় করবে তারপর ভুলে যাবে।

সেদিন বন্ধুটির এমন কথায় আমি খুব ধাক্কা খেয়েছিলাম। মনে মনে ক্ষুদ্ধও হয়েছিলাম। কিন্তু তার কথাই নির্ভেজাল সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তীতে! প্রকাশনা অনুষ্ঠান শেষে আমি জাপানে ফিরে এসে অবশ্য শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখিনি। প্রয়োজনও পড়েনি।

২০০৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি জাপান সফরে এলেন। অনুজপ্রতীম বন্ধুটির অনুরোধে আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এক রোববারে তাঁর অবস্থানরত হোটেলে যাই। তিনি আমাকে দেখে খুব খুশি হন এবং আমারও ভালো লাগে। এতবড় জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা আমার মতো সামান্য এক প্রবাসী শ্রমিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী হয়েছেন---আমি আনন্দে বর্তে গেলাম! আমি টোকিওর কোথায় কোথায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া যায় একটা পরিকল্পনা করেছিলাম সেই অনুযায়ী সকালবেলা তাঁকে নিয়ে রওয়ানা হলাম মেট্রো ট্রেনে চড়ে। জাপানে বিদেশি অতিথিরা এলে পরে সাধারণত অফিসিয়াল গাড়িতে চড়িয়ে গন্তব্যস্থলে নিয়ে যায় আমন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ফলে সাধারণ জাপানিদের দৈনন্দিন জীবনযাপন দেখা হয়ে ওঠে না তাঁদের। তাই তাঁকে জাপানের জনজীবনটা বোঝাবার জন্য মেট্রো ট্রেনেই চড়িয়ে টোকিও ঘোরালাম। যেসব জায়গায় কোনো বাঙালিই তাঁকে নিয়ে যাবে না, জাপানিও নিয়ে যাবে না। কারণ তারা সেইসব ইতিহাস জানে না। আমি খুঁজে খুঁজে বের করেছি। আমার পছন্দসই ব্যক্তিরা এলে তাঁদের আগ্রহে আমি নিয়ে যাই।

সেদিন ট্রেনে এবং শহরে ঘুরতে ঘুরতে কত তথ্যই না তাঁকে দিলাম! জাপান-বাংলার নানা সম্পর্কের ইতিহাস বললাম, জাপানি-বাঙালি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বন্ধুত্বের কথা বললাম, রবীন্দ্র-ওকাকুরা-জাপান সম্পর্কের ইতিহাস বললাম। বঙ্গবন্ধুর জাপানি শুভাকাক্সক্ষীদের আওয়ামী লীগ মনে রাখেনি সেসব দুঃখজনক কথাও বললাম। তিনি শুনে নিজেও দুঃখপ্রকাশ করলেন। তারপর বললেন, তোমার ‘রবীন্দ্র-জাপান সম্পর্ক’ নিয়ে পাণ্ডুলিপি থাকলে দিও। অধ্যাপক কাজুও আজুমা অসাধারণ কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্য নিয়ে! ১৯৮৯ সালে জাপানে যখন আসি তখন সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। এবার দেখা করতে চাই। তুমি চেষ্টা করে দেখো।

আমি বললাম, আজুমা স্যার এখন মৃত্যুপথযাত্রী। হাসপাতালে শয্যাশায়ী দীর্ঘদিন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, দুটো কিডনিই নষ্ট। সপ্তাহে দুদিন ডায়ালাসিস করতে হয়। নড়তেচড়তে পারেন না। লিকুয়িড খাবার খাওয়ানো হয়। যেকোনো সময় চলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি মাদাম কেইকো আজুমার সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি বলেছেন, ডাক্তার একদম নিষেধ করেছেন বাইরের কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথাবলা। আমিই শুধু মাঝেমধ্যে দেখে আসি। স্যারের সঙ্গে আমার দুদশকের বেশি বন্ধুত্ব। কেইকো মাদামের কাছে আমার জাপানি স্ত্রী বাংলা শিখেছে। তবুও মাদাম চেষ্টা করছেন যদি অনুমতি মেলে তা হলে জানাবেন।

আজুমা স্যারের এই অবস্থার কথা শুনে শামসুজ্জামান খান খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমার কেন জানি না তাঁকে বেশ কোমল এবং সংবেদনশীল মনে হলো। সেদিন তাঁকে আমি সন্ধ্যারাত পর্যন্ত সময় দিলাম, প্রথমেই নিয়ে গেলাম ইকেবুকুরো শহরে যেখানে রয়েছে বাংলাদেশের শহীদ মিনার। তারপর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিতাভস্ম সংরক্ষিত আছে বলে কথিত বিখ্যাত রেনকোওজি বৌদ্ধমন্দিরে নিয়ে গেলাম। সেখানে মন্দিরপ্রাঙ্গণে স্থাপিত নেতাজির স্মারক-ভাস্কর্য দেখে খুব আবেগাপ্লুত হলেন। স্যালুট জানালেন। ভিজিটর বুকে মন্তব্য লিখলেন কাঁপা-কাঁপা হাতে। সেখান থেকে গেলাম শিনজুকু শহরে অবস্থিত ইতিহাসখ্যাত ‘নাকামুরায়া’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ছিল জাপানে আশ্রিত মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর শ্বশুরবাড়ি এবং তাঁর পরিচালিত ভারতীয় কারি রেস্টুরেন্ট ‘ইনদো নো মোন’ বা ‘ভারতের তোরণ’। তিনিই ১৯২৭ সালে জাপানে প্রথম ভারতীয় কারি প্রচলন করেন। নিজেই পাচক ছিলেন। সেইসব অনেক ইতিহাস আমি কিছু তাঁকে বললাম। দোকানের প্রবেশদ্বারের পাশে শোকেসে সাজানো রাসবিহারী বসুর পারিবারিক একাধিক ছবি দেখে তিনি খুব আনন্দিত হলেন! বললেন, ভেরি রোমান্টিক! থ্যাংক ইউ প্রবীর!

রাসবিহারীর রন্ধনকৃত ভারতীয় চিকিন কারি আজও জাপানে সমানভাবে জনপ্রিয়। একই খাবার আজও পরিবেশিত হচ্ছে নিয়ম মেনে ‘নাকামুরায়া’র রেস্টুরেন্টেও। তাঁকে আমন্ত্রণ জানালাম সেই কারির স্বাদ গ্রহণ করার জন্য। একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে।

নাকামুরায়াতে মধ্যাহ্নভোজ সেরে পাশেই বিখ্যাত গ্রন্থবিতান ‘কিনোকুনিয়া’তে গেলাম। বহুতলবিশিষ্ট এই গ্রন্থবিতানটি বহু পুরনো এবং বিদেশি পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থ পাওয়া যায়। তিনি কিছু বই দেখলেন। সেখান থেকে গেলাম কুদানশিতা শহরে যেখানে রয়েছে ইয়াসুকুনি জিনজাÑÑশিন্তোও ধর্মীয় মহামন্দিরে। বিশাল সুদশ্যমান মন্দিরপ্রাঙ্গণ দেখে তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন। হাঁটতে হাঁটতে আমি তাঁকে এর ইতিহাস বললাম। বললাম, এখানেই স্থাপিত আছে ঐতিহাসিক টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালখ্যাত বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের একটি খুব সুন্দর স্মৃতিফলক। তিনি অবিভক্ত ভারতের প্রাক্তন নদীয়া বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন কলকাতায়। বিচারপতি পালের স্মৃতিফলকের সামনে দাঁড়িয়ে শামসুজ্জামান খান বাক-রহিত হয়ে পড়লেন! বললেন, কী সম্মানই না দিয়েছে জাপানিরা এই বাঙালিকে প্রবীর! আমি অবাক হচ্ছি!

এখানে তাঁর বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। তারপর নিয়ে গেলাম প্রাঙ্গণের মধ্যেই অবস্থিত চমৎকার একটি যুদ্ধ জাদুঘর ‘ইউশুউকান’-এ। আমি তাঁকে বললাম, এই জাদুঘরটি নিয়ে বিতর্ক আছে, তা থাক। আমি দেখাবো কীভাবে জাপানিরা তাদের বীর যোদ্ধাদেরকে উপস্থাপন করেছে! যাঁরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এত শৈল্পিক, তথ্য ও চিত্রসম্বলিত জাদুঘর এশিয়ায় নেই বলেই আমার বিশ্বাস! এবং সেই জাদুঘরের বিভিন্ন নিদর্শন দেখে তাঁর দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল! অভিভূত হয়ে গেলেন তিনি! আমি বললাম, স্যার, আমাদের এরকম একটি মুক্তিযুদ্ধ স¥ারক জাদুঘর রাজধানী ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলেই করতে হবে। তিনি আমার কথায় সায় দিলেন। এবং কাঁপা-কাঁপা হাতে কীসব নোট করলেন কাগজে। দীর্ঘক্ষণ তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জাদুঘরকে উপভোগ করলেন।

সেখান থেকে বেরোতে-বেরোতে বিকেল হয়ে গেল। তাঁকে নিয়ে গেলাম উয়োনো উদ্যানে। এটা জাপানের প্রথম আধুনিক উদ্যান। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, হেঁটেছিলেন। উদ্যানসংলগ্ন সুবিখ্যাত কানয়েইজি বৌদ্ধমন্দিরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল ১৯১৬ সালে। তাতে প্রায় ৩০০ বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ওওকুমা শিগেনোবু। উদ্যানসংলগ্ন শিনোবাজুইকে নামক জলাশয়ের কাছে রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িটিতে দিন দশেক ছিলেন সেখানে নিয়ে গেলাম। যদিও বাড়িটি ১৯২৩ সালে মহাভূমিকম্পে এবং বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্ষত্রিগ্রস্ত হয়েছিল। পুনরায় নির্মাণ করা হয় কিছুটা অদলবদল করে। এই বাড়িটি ছিল দেশ-বিদেশখ্যাত জাপানি ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা জগতের ‘নিহোনগাকা’ চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের, যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯০৩ সালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। বর্তমানে বাড়িটি ‘তাইকান মেমোরিয়াল হল’ নামে সুপরিচিত। সেদিন ৫টায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর ভেতরে প্রবেশ করা যায়নি। ফটকের সামনে তাঁর ছবি তুললাম।

উয়েনো থেকে ট্রেনে চড়ে ফিরে এলাম হোটলে। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। হোটেলের লবিতে রেস্টুরেন্টে আমরা বসলাম। দুজনে বিয়ার পান করতে করতে আমি যেসব প্রস্তাব এবং অনুরোধ তাঁকে করেছিলাম তা নিম্নরূপ:

১. প্রসঙ্গ অধ্যাপক কাজুও আজুমার সম্মাননা:
আমি তাঁকে বললাম, স্যার, আপনি তো কাজুও আজুমা সম্পর্কে জানেনই। নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি বিগত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালি ও বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করে আসছেন, অনুবাদ করে আসছেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক, মুহম্মদ আবদুল হাই, আনোয়ার পাশা, মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা বাংলা থেকে সরাসরি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানে জনমতসংগ্রহ ও অর্থতহবিল গঠনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় তাঁর দোভাষী এবং সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। বাংলাদেশেও গিয়েছেন একাধিকবার। তিনি তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞ এবং ভারত-জাপান শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়কে এগিয়ে নেবার জন্য মূল্যায়নস্বরূপ বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ পদক; পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দুবার ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ ভূষিত হয়েছেন। জাপানের রাষ্ট্রীয় পদক অর্জন করেছেন। ডি লিট পদবীসহ আরও অনেক পুরস্কার, পদক ও সম্মাননায় সম্মানিত হয়েছেন। একমাত্র বাংলাদেশ থেকেই তিনি কোনো সম¥ান পাননি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, বঙ্গবন্ধুর বড়মাপের ভক্ত। বাংলা একাডেমী থেকে একটা সম্মান তাঁকে প্রদান করার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ অবিবেচক, অকৃতজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত হবে তাঁর মৃত্যুর পর। আগে বলেছি আপনাকে যে, তিনি এখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। বাংলা একাডেমীর মহা পরিচালক হিসেবে বিষয়টি বিবেচনা করুন। আমি তাঁর অনেক দলিলপত্র নিয়ে এসেছি। এগুলো আপনাকে দিতে চাই।

আমি ব্যাগ থেকে একগাদা কাগজপত্র তাঁর সামনে রাখলাম। তিনি সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে আমি এগুলো নিয়ে যাবো। তবে এখন কথা দিতে পারছি না। দেশে ফিরে আলাপ-আলোচনা করে তোমাকে আমি জানাবো। তাঁকে সম্মানিত করা জরুরি আমিও মনে করছি।

ফলাফল: শামসুজ্জামান খান দেশে ফিরে যাওয়ার পর আমি কয়েক দফা ফোনে যোগাযোগ করি। মেইলও করি কিন্তু উত্তর পাইনি। ফোনেই কথা হয়। তিনি বললেন, বিষয়টি আমরা বিবেচনা করছি। তবে প্রবীর, বাংলা একাডেমী তো বিদেশিদেরকে কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা দিতে পারে না। আইন নেই।
আমি তাঁর কথায় আকাশ থেকে পড়লাম! বলে কী! বিদেশিদেরকে বিবেচনা করে না সম্মানের জন্য এরকম প্রতিষ্ঠান কী এই ২১ শতকে কোনো দেশে আছে! আমি বেকুব হয়ে কিছুক্ষণ বোবা ছিলাম! তারপর বললাম, ঠিক আছে। অন্য কিছু একটা প্রদান করুন। সময় নেই কিন্তু!
তিনি বললেন, আমরা যেটা দিতে পারি সেটা ফেলোশিপ।
আমি বললাম, তা হলে তাই দিন। যদি সেটা সম্মানজনক হয়ে থাকে।
তিনি জবাবে বললেন, দ্রুতই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। তুমি আবার ফোন দিও।

কয়েকদিন পর আমি আবার ফোন দিলে তিনি বললেন, ফেলোশিপই প্রদান করা হয়েছে অধ্যাপক আজুমাকে। আমি তাঁকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিলাম।
তিনি বললেন, ফেলোশিপের প্রামাণ্য সদন তো পাঠাতে চাই কীভাবে পাঠাবো?
আমি বললাম, আপনি জাপান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তারা এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আজুমা স্যারের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। তাঁর সহধর্মিণী গ্রহণ করবেন।
তিনি বললেন, তা হলে তাই করি।

আমি এই সুসংবাদটা সঙ্গেসঙ্গে মাদাম কেইকো আজুমাকে ফোন করে জানাই। স্যারকে জানাতে অনুরোধ করি। মাদাম শুনে খুব আনন্দিত হন। আমাকে বার বার ধন্যবাদ দেন। আমি বলি ধন্যবাদ দেবেন বাংলা একাডেমীকে মাদাম আমাকে নয়। আমি চেষ্টা করেছি মাত্র আজুমা স্যারের যথার্থ মূল্যায়নের জন্য। একাডেমী থেকে প্রামাণ্য দলিলপত্রাদি জাপান দূতাবাস হয়ে আসবে স্যারের নামে। পাওয়ার পর একটি চিঠি দিয়ে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে ধন্যবাদ জানিয়ে দেবেন।

তারপর দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় কোনো খবর নেই ফেলোশিপের কাগজপত্রের! আমি মেইল করে, টেলিফোন করে কয়েকবার ব্যর্থ হই। ব্যস্ততার কারণেই হোক অথবা অন্যকোনো কারণেই হোক শামসুজ্জামান খান মেইলের উত্তরও দেন না, টেলিফোনও ধরেন না। কেইকো মাদামকে মাঝেমাঝে ফোন করে জিজ্ঞেস করি কোনো কাগজপত্র ঢাকা থেকে এসেছে কিনা? তিনি হেসে জানান, না। কিছুই আসেনি।

গত ৩ মাস আগেও শেষবার কেইকো মাদামকে জিজ্ঞেস করেছি, বরাবর হেসে উত্তর দিয়েছেন, কিছুই আসেনি।
এখন ভাবি, এলেইবা কী! আজুমা স্যার তো ২৯১১ সালের ২৮ জুলাই ইহলোকত্যাগ করে চলে গেছেন পরবারে। তিনি তো স্বচক্ষে দেখে যেতে পারলেন না!

এই হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের দায়দায়িত্বের নমুনা।

২. প্রসঙ্গ বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র:
আজুমা স্যার প্রসঙ্গে তাঁকে একটি বিশেষ অনুরোধ করেছিলাম। সেটি হলো, স্যার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে প্রায় একই সময়ে দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। একটি হচ্ছে, কলকাতার সল্টলেকে ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন’ এবং অন্যটি হচ্ছে সিলেটের বড়লেখা শহরে ‘বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা। কলকাতা এবং সিলেটে গিয়ে দুটোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন অসুস্থ অবস্থাতেই। দুটো প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল ২০০৭ সালে। তিনি গভীর আশা-প্রত্যাশা নিয়ে অধীর প্রতীক্ষায় ছিলেন দুটোরই শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু কলকাতায় যথারীতি উদ্বোধন হলে আজুমা স্যার সেখানে উপস্থিত হন। বাংলাদেশেরটা হয়নি। খবর পেলেন যে, বাংলাদেশ প্রকল্পের জন্য প্রদত্ত সাড়ে ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে দারাদ আহমেদ, যাকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য! এই দুঃসংবাদে অসুস্থ কাজুও আজুমা এতই আঘাতপ্রাপ্ত হন যে, তাঁর বাকশক্তি হারিয়ে যায়! তিনি আর কথাই বলতে পারেননি। কী করবেন তাও জানেন না। তাঁর সহধর্মিণী কেইকো আজুমা এখানে-সেখানে যোগাযোগ করলেন বটে কাজ কিছুই হয়নি। পত্রিকা মারফত জানতে পারলেন টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পলাতক দারাদ। এই সমস্যার একটা সমাধান চেয়ে তিনি প্রধান মন্ত্রীর কাছে দু-দুবার দুটি চিঠি পাঠান। তারও কোনো উত্তর আসেনি। আজুমা স্যার অব্যক্ত বেদনা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

আমি শামসুজ্জামান খানকে অনুরোধ করলাম, এই ঘটনায় বাংলাদেশের যে মান-সম্মান খোয়া গেল জাপানিদের কাছে তাকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করুন। প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আপনি কাছের মানুষ। একবার তাঁকে বলুন এই সমস্যার সমাধানকল্পে তিনি যেন একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনি বললেন, এই বিষয়ে আমি বিশেষ কিছু জানি না। তবে আমি চেষ্টা করে দেখবো।
আমি আশ্বস্ত হলাম।

ফলাফল: আজ পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে সৌজন্যতার খাতিরেও একটি সদুত্তর আমি পাইনি! তিনি একটি বার্তা দিয়ে বলতে পারতেন, প্রবীর, আমি চেষ্টা করেছি বা কিছুই করতে পারিনি বলে দুঃখিত! কোনো কিছুই তিনি জানাননি। হয়তো বিষয়টা তাঁকে নাড়াই দিতে পারেনি! সত্যিই যদি তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন এবং অধ্যাপক আজুমাকে শ্রদ্ধা করতেন তা হলে একটা চেষ্টা তিনি করতেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

৩. প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠান:
আমি তাঁকে বলেছিলাম, ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবর্ষ। আপনি জানেন জাপানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রায় শতবর্ষের সম্পর্ক। ১৯৬১ সালে তাঁর শততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে প্রায় সাড়ে তিন বছর লাগিয়ে বিপুল উদ্যোগ-আয়োজন করা হয়েছিল জাপানে তাঁর ভক্তদের দ্বারা। এবারও আমরা সীমিত পরিসরে উদযাপন করতে যাচ্ছি সার্ধশত জন্মবর্ষ কবিগুরুর। আপনি হয়তোবা জানেন না, অধ্যাপক কাজুও আজুমা, অধ্যাপক ড.ৎসুয়োশি নারা ছাড়াও আরও কতিপয় অধ্যাপক ও গবেষক রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করছেন জাপানে। তাঁদেরকে বাংলাদেশে পরিচিত করা গেলে একটি স¥রণীয় ঘটনা হবে। বাংলা একাডেমী থেকে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন। আমি জাপানি রবীন্দ্রভক্তদেরকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।

তিনি সঙ্গেসঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন, বললেন, এটা একটা দারুণ কাজ হবে প্রবীর! সবসময় এই সুযোগ আসে না। তুমি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করো আমি উদ্যোগ নেব একটি অনুষ্ঠান করার জন্য। এটা খুব ভালো প্রস্তাব।

ফলাফল: না, সে ব্যাপারেও তিনি কিছুই আমাকে জানাননি। কী মনে করে সেদিন তিনি আমার প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিলেন একমাত্র তিনি আর তাঁর বিধাতাই জানেন! আমি নিজেও কিছু পরিকল্পনা করেছিলাম, যেমন রবীন্দ্রনাথের বেশকিছু দলিলপত্র, প্রায় ৬০টি দুর্লভ আলোকচিত্র যেগুলো জাপানে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত প্রদর্শিত করবো। তা হলে বাংলাদেশিরা বুঝতে পারবেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জাপানিরা কেন এত মাতামাতি করেছে, যা বাঙালিরাও করেনি! সেই পরিকল্পনা আমার ভেস্তে গেল!

৪. প্রসঙ্গ প্রবাসীদের সাহিত্যকর্ম, পত্রিকা-সাময়িকী প্রকাশনা এবং গ্রন্থাদির সংরক্ষণ:
আমি তাঁকে আরেকটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বহু বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, প্রান্তে পূর্ববাংলা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নাগরিকরা নানা উপলক্ষে অভিবাসী হয়েছে। শ্রমিকের সংখ্যাই অধিক। তবে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে অনেক অভিবাসীও বিদেশে বসবাস করছেন। তাঁদের মধ্যে আছে কবি, লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, গায়ক-গায়িকা, শিক্ষক ইত্যাদি। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠন গঠন করে বিদেশে স্বদেশের সংস্কৃতি, ঐহিত্য ও ইতিহাসকে তুলে ধরে আসছেন। জাপানও তার ব্যতিক্রম নয়। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনচিত্র, প্রতিপক্ষ বিদেশির সঙ্গে ভাববিনিময়, পত্রপত্রিকা প্রকাশ, গ্রন্থলেখা ইত্যাদি বহু-বহু কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলোকে সংগ্রহ করে বাংলা একাডেমী তার ভবনের অভ্যন্তরে একটি সংরক্ষণশালা গড়ে তুলতে পারে। এইসব দলিলপত্রাদি অবশ্যই ভাসমান জিনিস নয়, এগুলোর মূল্য অত্যধিক স্বদেশীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং অভিবাসীর ইতিহাস লেখার প্রেক্ষাপটে। প্রবাসীদের লেখালেখিতে বিধৃত আছে স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর-গভীর অনুরাগ। অন্যদিকে এগুলো বাংলাদেশে মুদ্রিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের অর্র্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করেছে বহুলাংশে স্বীকার করতেই হবে। সুতরাং প্রবাসীদের সামগ্রীক অবদানকে ছোট করে দেখার বা অবহেলা করার সুযোগ নেই। ‘প্রবাসীদের সাহিত্য ও প্রকাশনা সংরক্ষণশালা’ নামে একটি কক্ষ প্রতিষ্ঠা করুন এবং প্রতি বছর বইমেলাতে প্রদর্শন করুন। আমার বিশ্বাস হয় না, বিশ্বের আর কোনো দেশের অভিবাসীরা এত বিপুল পরিমাণ সাহিত্যসৃষ্টি এবং প্রকাশনা করতে পেরেছে!

আমার প্রস্তাব শুনে তিনি বললেন, এটাও একটা ভালো প্রস্তাব। আমরা চিন্তা করে দেখবো।

অনুরূপ, তাঁকে আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশে একটি অনুবাদ একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দেশবিদেশের সাহিত্য ও ইতিহাস গ্রন্থের অনুবাদ হতে থাকবে অবিরাম। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহ অনুসারে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। বাংলা একাডেমী এই উদ্যোগটি গ্রহণ করতে পারে।

তিনি সাড়া দিয়ে বলেছিলেন, তুমি ঠিক বলেছো। অনুবাদটা জরুরি। দেশীয় সাহিত্য ও ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে বিদেশি গ্রন্থের অনুবাদের বিকল্প নেই। আমরা এটা ভেবে দেখতে পারি।

আমি বললাম, স্যার, আমি একজন সাধারণ কায়িক শ্রমিক, আমি এভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির কথা ভাবি। সেই ভাবনা থেকেই আপনাকে এই প্রস্তাবগুলো করলাম। কাজ করার ইচ্ছে থাকলে আপনি অনেক কাজ করতে পারেন। আপনি যেহেতু প্রধান মন্ত্রীর একজন সুঘনিষ্ঠ শুভাকাক্সক্ষী তাঁর সঙ্গে আলাপ করুন, তিনি আপনাকে হতাশ করবেন না বলে আমার একান্ত বিশ্বাস। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং নিজেও লেখালেখি করেন। আপনি চেষ্টা করে দেখুন। আপনি সফল হবেন। একটা অসামান্য সুযোগ আপনি পেয়েছেন তাঁর কাছ থেকে আর সেটা হলো বাংলা একাডেমীর মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক। এই সুযোগ হারাবেন না। সুদূরপ্রসারী কিছু প্রকল্প স্থাপন করে জাতিগঠনে অবদান রাখুন। স্মরণীয় হয়ে থাকুন।

সেদিন বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শামসুজ্জামান খান মাথা নেড়ে নেড়ে নীরবে সায় দিয়েছিলেন আমার কথায়। আমি খুব আশ্বস্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, আমি তাঁকে বোঝাতে পেরেছি আমার চিন্তাগুলো।

ফলাফল: বলাবাহুল্য মাত্র, উপরোক্ত প্রস্তাবগুলোর মতো প্রবাসীদের সাহিত্য এবং অনুবাদ একাডেমীর ব্যাপারেও তাঁর কাছ থেকে আর কোনো সাড়া-শব্দ আমি পাইনি। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ঘটনাটি আমার কাছে অর্থহীন স্বপ্ন হিসেবেই থেকে গেল বলে ধরে নিলাম।

এবং সেটা যে আসলে একেবারে মাঠেই মারা গেছে সেটাও দ্রুত অনুধাবন করতে সক্ষম হলাম ২০১১ সালের দিকে যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম তাঁর অফিসে একদিন আমার এক আত্মীয় অভি দাসকে নিয়ে। তাও তাঁকে সরাসরি টেলিফোনে ধরতে না পেরে আমার সেই বহুদিনের চেনা অনুজপ্রতীম বন্ধুর মারফতে সাক্ষাতের সুযোগটি পেয়েছিলাম।

দারোয়ানের মাধ্যমে আমার ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে দিয়ে অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাঁর কক্ষে যখন প্রবেশ করলাম তখন তিনি অন্য মানুষ! জাপানে দেখা হাবাগোবা ভদ্রসজ্জন মানুষটি যেন শামসুজ্জামান খান নন! বুদ্ধিদীপ্ত এবং চৌকস!

সেদিন আমাকে বসতে তো বললেনই না ‘কেমন আছো’, ‘কবে এলে’ এমন সৌজন্যতাও প্রদর্র্শন করলেন না! বুঝলাম তিনি ব্যস্ত না থাকলেও এখন ব্যস্ত! এবং আমার উপস্থিতি অনভিপ্রেত। আমি মনে মনে ধাক্কা খেলেও তাঁকে বুঝতে না দিয়ে, বললাম, বেশি সময় নেব না স্যার। আপনি খুব ব্যস্ত। আমি খুব দ্রুত জাপানে ফিরে যাবো। আমার একটি পাণ্ডুলিপি এই প্যাকেটে আছে সময় করে দেখবেন ‘জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক’ বিষয়ে। আপনি জাপানে বলেছিলেন যদি কোনো লেখা থাকে দিও। খুব দুর্লভ দলিলপত্র ঘেঁেট এই পাণ্ডুলিপিটি তৈরি করেছি ‘রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্র্ষের সম্পর্ক নামে। প্রকাশ করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, আপনাদের সম্পাদকমণ্ডলীর অনুমতি পেলেই করবেন। প্রকাশ না করলেও ক্ষতি নেই।

এইকথা বলে তাঁর হাতে প্যাকেটটি তুলে দিলাম। অভিকে বললাম একটি ছবি তোলো। তারপর সালাম জানিয়ে দ্রুত চলে এলাম।

জানি না, সেই পাণ্ডুলিপিটা তিনি কী করেছেন। হয়তো ডাস্টবিনে চালান করে দিয়েছেন নতুবা শতশত ফাইলের সঙ্গে কোনো তাকে ঘুমুচ্ছে! বইটি অবশ্য ২০১১ সালেই প্রকাশিত হয়েছে বাংলা এবং পরে ইংরেজি অনুবাদও। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানসহ আরও একাধিকজন আলোচনাও করেছেন। সম্প্রতি পর্যালোচনা করেছেন ভারতের খ্যাতিমান লেখক, গবেষক এবং গ্রন্থালোচক সুরজিৎ দাশগুপ্ত।

বইপ্রকাশনা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র রাগ বা দুঃখ কোনোটাই নেই। আমি বেদনাহত হয়েছিলাম তাঁর দায়িত্বহীনতা এবং আচরণে! আমি জাপানে অফিস ফেলে, অনেক টাকা খরচ করে তাঁকে পুরো একটি দিন সময় দিয়েছিলাম! অনেক কথা বলেছিলাম, কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম সবই অর্থহীনতায় পর্যবশিত হয়েছে দেখে দুঃখ পেয়েছিলাম। কাউকে সেসব কথা কখনো বলিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সময়টা অনুকূলে তাই দুঃখময় অনুভূতিটা লিখে যাওয়া ভালো কারণ তাতে করে ভষ্যিতে যারা শামসুজ্জামান খান হবেন তাদেরকে সাবধান হতে সহায়তা করবে। এটা আমার দায়িত্বও বটে! তিনি হয়তো এসব কথা অস্বীকার করবেন সঙ্গত কারণেই। তাতে আমার কিছু যায় আসে না কারণ আমাকে যাঁরা চেনেন, জানেন তাঁরা অক্ণ্ঠুচিত্তে বলবেন, প্রবীর কখনো মিথ্যে বলে না!

বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী একটিই এবং এর মহা পরিচালক একজনই তিনি শামসুজ্জামান খান-অনেক বড়মাপের মানুষ আমি তাঁর মহত্ব নিয়ে আলোচনা করলাম মাত্র! ভবিষ্যতে তাঁকে নিয়ে যখন গবেষণা হবে তখন তথ্য-উপাত্ত হিসেবে এই নিবন্ধটি কাজে লাগবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : জাপান প্রবাসী ও গবেষক

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test