E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

শেখ হাসিনার মন্তব্য ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

২০১৭ মার্চ ২৩ ১১:৩১:১৫
শেখ হাসিনার মন্তব্য ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

আবেদ খান


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য বেশ আলোচিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন স্থানে এমনকি দেশের বাইরেও রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক মহলে কিঞ্চিৎ জল্পনা-কল্পনার এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।

মহিলা যুবলীগের অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে দুটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কোনো কোনো সদস্যের সক্রিয় ভূমিকার ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘র’-এর লোক এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার লোক হওয়া ভবনে দিনরাত বসে থেকে কলকাঠি নাড়ত।
কূটনীতিক মহল এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তির ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন-
ক. বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বর্তমান সরকারের আমলে সবচাইতে বেশি শক্তিশালী হয়েছে এবং ভারতের দুই আমলের দুই প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ কংগ্রেস-এর মনমোহন সিং এবং বিজেপির নরেন্দ্র মোদীর অত্যন্ত আন্তরিক বাংলাদেশ সফরের পর এখন কী ঘটল- যার কারণে শেখ হাসিনার বহু প্রত্যাশিত ভারত-সফর বারংবার দীর্ঘায়িত হতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে স্থির হলো?
খ. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সফরের প্রাক্কালে শেখ হাসিনার এই মন্তব্য কি বিশেষ কোনো ইঙ্গিত বহন করছে? এই ইঙ্গিতের ফলে কি কোনো রকম পারস্পারিক আস্থার সংকট দানা বাঁধছে?
গ. এই সময় এই উক্তি কি খুবই প্রয়োজনীয় ছিল কিংবা এর মাধ্যমে কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো মহলকে কোনো ধরনের বিশেষ বার্তা দিতে চাইলেন? তা হলে সেটা কোন মহল? সেটা কি পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্র ভারত? কিংবা সেটা কি সেই মহলÑযারা প্রতি মুহূর্তে শেখ হাসিনার সরকারকে ভারত সরকারের অনুগৃহীত সরকার বলে প্রচারণা চালায়?
ঘ. বাংলাদেশে কি চীনের বাণিজ্যিক পুঁজিবিস্তার ঘটছে এবং বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্য কি ক্রমশ চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে? বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিচালিত হওয়ার কারণে কি বাংলাদেশের বিদেশনীতিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে- যার লক্ষণ চীনের কাছ থেকে সাবমেরিনসমেত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয়?
ঙ. এই প্রসঙ্গ টেনে এনে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে যথেষ্ট পরিপক্বতা অর্জনকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি এই বার্তাটি দিতে চাইলেন যে, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ যেভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বকে অশান্ত করে চলেছে তাকে অন্তত বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বেশ সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারছে? এই সময় যদি কোনো ভারতীয় বিশেষ সংস্থার কোনো বিশেষ প্রতিনিধির মনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কাঠামো পরিবর্তনের কোনো ধরনের ভাবনা ক্রিয়াশীল থাকে, তা হলে তা কি এই উপমহাদেশের স্থিতিশীলতাকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে?

দুই.
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে সরকারবিরোধী মহল বিশেষ করে বিএনপির একটি অংশ অতিমাত্রায় মুখর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত কোনো বিশেষ সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে কি না, তাই নিয়ে সেই মহল তুমুল কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে। এমন কী বিদেশি কূটনৈতিক মহলেও তাদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা যদি আরও খেয়াল করি তা হলে দেখব ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফর করে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের বিষয়টি চূড়ান্ত করার পর পরই বিরোধী শিবিরের কট্টর ভারতবিরোধী নেতারা ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকেন এবং এরই পাশাপাশি বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। ২০০৫ সালে একাধিক আত্মঘাতী হামলা হওয়ার পর তাতে একটা দীর্ঘবিরতি পড়েছিল। কিন্তু এইবার অত্যন্ত তীব্রভাবে আত্মঘাতীদের আত্মপ্রকাশ ঘটল। বিশেষ করে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এমন একটা সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর শিবির এবং সদস্যদের ওপরও হামলা চালানোর ঘটনা ঘটছে যার সঙ্গে সরকার-বিরোধীদের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ার সংযোগ থাকতে পারে।
আর একটি বিষয় উল্লেখ প্রণিধানযোগ্য- তা হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মহলের নির্লজ্জ উপস্থিতি। এই মহলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রকার অর্থনৈতিক বা সামরিক অনুপ্রবেশকে স্মিতহাস্যে গ্রহণ করে, চীনের সঙ্গে কোনো অর্থনৈতিক বা সামরিক বন্ধনে আনন্দিত হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক বা সামরিক প্রকাশ্য কিংবা গোপন সম্পর্কে উল্লসিত হয় আর ভারতের সঙ্গে সামান্যতম সমঝোতার আভাস দেখলেই ক্ষোভে এবং ক্রোধে ফেটে পড়ে। চীনের পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলারের ঋণপ্রস্তাব তাদের চোখে সুসম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ আর ভারতের এক বা তিন বিলিয়ন সহযোগিতা-প্রস্তাব প্রতিভাত হয় দেশ বিক্রির শামিল হিসেবে। এই মহলের এ-ধরনের মিত্র নির্বাচন সঙ্গত কারণেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের শত্রুমিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। লক্ষ্য করার মতো যে, এই মহলটি শেখ হাসিনার ওই মন্তব্য নিয়ে মহা উৎসাহে জল্পনা-কল্পনা শুরু করে দিয়েছেন। কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে ‘র’, কেউ বলছেন জিয়াকে হত্যা করেছে ‘র’। এই বিষয়টি তুলে ধরার সঙ্গে তারা যুক্ত করেন শেখ হাসিনার ভারত সফর। তুলে আনেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে এমন সব বক্তব্য, যার ভেতর দিয়ে তাঁদের কট্টর ভারত-বিরোধিতার চেহারাটি উন্মোচিত হয়ে যায়। বারংবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে ‘র’-এর ভূমিকার কথা উল্লেখ করার পশ্চাৎবর্তী কৌশলটি হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় গোপন এবং কখনও কখনও সদম্ভ উপস্থিতির বিষয়টি ক্রমাগত আড়ালে রাখা। এই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা যা আইএসআই হিসেবে কুখ্যাত, বাংলাদেশের ছেচল্লিশ বছরের ইতিহাসে কী ভয়ঙ্কর ভূমিকাই না পালন করে চলেছে! অথচ এই ব্যাপারে ওই মহলটি কি কখনও কোনো শব্দ উচ্চারণ করেছে? আর এই আইএসআই তো ক্রমাগত বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই কাজ করেছে। কী করেনি বা কী করছে না তারা? পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে এবং মুক্তিযুদ্ধের চার মহানায়ককে কারাগারে হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান পর্যন্ত প্রতিটি অপকর্মে রয়েছে তাদের সুনিপুণ রহস্যজনক ভূমিকা। আজ বাংলাদেশে যত রকম রাজনেতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা রয়েছে তার প্রধান নিয়ন্ত্রক এই আইএসআই নিয়ে ওই মহলের ‘পবিত্র’ কণ্ঠস্বর তো একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি কখনও! অথচ যে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসাকে ‘র’-এর অবদান বলে ওই মহলটি ব্যাপক প্রচার করে বেড়ায়, সেই শেখ হাসিনা তো কোনো রাখ-ঢাক না করেই কোনো এক সময় ‘র’-এর কোনো কর্মকর্তার কর্মকাণ্ড নিয়ে সরাসরি সমালোচনা করলেন। কিন্তু বেগম জিয়া থেকে শুরু করে তার চেলাচামুণ্ডা গুণগ্রাহীদের কেউ কি কখনও একটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন পাকিস্তান বা আইএসআই-এর বিরুদ্ধে? তাঁদের কাজকর্মে মনে হয়েছে তাঁদের প্রত্যেকেই যেন আইএসআই-এর বেতনভূক কর্মচারী!

তিন.
লেখা শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনার মন্তব্য এবং তার প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত-সফর নিয়ে নানাবিধ জল্পনা-কল্পনা প্রসঙ্গে। যারা এই মন্তব্য নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন কিংবা মনের খুশি চেপে রেখে ভাবছেন এই বোধহয় শেখ হাসিনা ভারতের আস্থার স্থান থেকে টুপ করে খসে গেলেন- তাদের উদ্দেশে অন্তত এটুকু বলা যায়- বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার শেকড় বহু গভীরেই প্রোথিত।
দুই দেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কই এই দুই দেশকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। দুই দেশই এটা বিশ্বাস করে যে, পারস্পরিক মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ভেতর দিয়ে যদি এগিয়ে যাওয়া যায় তবে তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হবে। দুই দেশই এই সত্যটি অনুধাবন করে যে, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বা উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদ দ্বারা একটি অঞ্চল আক্রান্ত হলে তার ধাক্কা কোনো ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। কাজেই কোনো মন্তব্যের ফলে এই সম্পর্কে চিড় ধরবে- এতো ঠুনকো নয় এই সম্পর্ক।
একটা কথা এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ফসল- কারো দয়ার দান নয়। বাংলাদেশের অস্তিত্বের পক্ষে কারা ছিল আর বিপক্ষে কারা ছিল- এটা বাংলাদেশের সবাই জানে। আর বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা এবং বর্তমান সরকার সেটার ব্যাপারে ‘বিলক্ষণ’ অবগত। কাজেই শেখ হাসিনা ওই মন্তব্য করে ঠিক করলেন কি ভুল করলেন- তা নিয়ে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে লাভ নেই। শেখ হাসিনার এই উক্তি যাদের বিচলিত করেছে তারাই অন্তত অনুধাবন করবে তিনি কোন কারণে এবং কি বুঝে এই কথা বলেছেন।
কারো আকাশকুসুম কল্পনার শখ যদি থেকেই থাকে, তা তিনি অনায়াসেই করতে পারেন।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test