E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাংলায় মুসলমান, সত্যটা যেমন

২০১৭ এপ্রিল ১৫ ১৮:০৬:৩১
বাংলায় মুসলমান, সত্যটা যেমন

মো. আমির হোসেন


মুসলমান ঘরে জন্ম নেওয়ার সৌভাগ্যেই হয়ত সেই ছোটবেলা থেকেই মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের গল্প আমার জানা। চোখ বন্ধ করলেই এক তুর্কী মুসলমান মহাবীরের ছবি ভেসে ওঠে। যার দেহ থেকে হাতের দৈর্ঘ ছিল অনেক বড়। মুখচ্ছবি ছিল অতীব কুৎসিত। সেই কুৎসিত মুখের অধিকারী তুর্কী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন খিলজী একদিন বাংলা বিজয় করে বাঙালী মুসলমানদের গর্বের আসনটি দখল করে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে বাঙলার শাসক ছিল তখন সেন বংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষণ সেন। তাঁর মত অত্যাচারী রাজা আর দ্বিতীয়টা তখন ছিল না, এমনটিই বলা হয়ে থাকে।

কথিত আছে লক্ষণ সেনের অত্যাচারে যেমন নিম্নবর্ণের হিন্দুরা অস্থির হয়ে থাকতেন। তেমনি বৌদ্ধরাও তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। ফলে বৌদ্ধরা দিল্লীর মুসলমান শাসকদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং লক্ষণ সেনের অত্যাচার থেকে তাঁদের রক্ষা করতে বলেন। সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই একদিন মুহাম্মদ খিলজী বাঙলায় আসেন এবং মাত্র ১৮ জন সৈন্য নিয়ে লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে তৎকালীন বাংলার রাজধানী নদীয়া দখল করে নেন। লক্ষণ সেন পালিয়ে যান। আর বাংলার নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে এক যোগে সবাই মুসলমান হয়ে যায়।

আচ্ছা, পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীকে তো সকলেই চিনেন। ১৯৭১ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশে গণহত্যা বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন সরাসরি। যুদ্ধের পরে তিনি ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ নামক একটি বইও লিখেছিলেন। বইটিতে মুসলমানদের সম্পর্কে তাঁর একটি উক্তি ছিল এরকম; 'মুসলিম মানসই এমন যে, তা বীরত্বপূর্ণ বাগাড়ম্বর ও অতিরঞ্জন দাবি করতে ভালোবাসে।' উক্তিটি সকল মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বল্লেও আমার কাছে মনে হয় উক্তিটি বাঙালী মুসলমানদের জন্য অধিক পরিমানে যুক্তি যুক্ত। কেন বলছি সেই প্রসঙ্গে আসি এবার।

প্রথমত মিস্টার খিলজী কখনই দিল্লীর মুসলমান সেনাবাহিনীতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীন দস্যু, যার প্রধান পেশাই ছিল দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ করা। দ্বিতীয়ত বৌদ্ধরা কখনই লক্ষণ সেনের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের কু-পরামর্শ দেওয়ার কথা নয়। ১১৯৯ খৃষ্টাব্দে যে দস্যু খিলজী তার বিশাল দস্যু বাহিনী নিয়ে বিহার দুর্গ আক্রমণ করে সেখানকার সকল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করেছিলেন, সেই ইতিহাস নদীয়া, নবদ্বীপ বা নৌখনৌতীর বুদ্ধদের অজানা থাকারও কথা নয়।

উক্ত ঘটনাটি জানা যায় খিলজীর বাংলা বিজয়ের প্রায় ৫০ বছর পর দিল্লীর ভুতপূর্ব প্রধান কাজী মিনহাজ উদ্দিনের লেখা ইতিহাসে। মিনহাজ উদ্দিন বলছেন, ভাগ্যান্বেষী লুটেরা মুহাম্মদ খিলজী একদিন হিসার-ই-বিহার বা বিহারের দুর্গ আক্রমন এবং অধিকার করে নিলেন। সেইসাথে তার অধিবাসীদের প্রায় সকলকেই হত্যা করে প্রচুর ধনরত্ন লুট করেন ও প্রচুর গ্রন্থ পুড়িয়ে দিলেন। এই বিহারই ছিল প্রখ্যাত ঔদন্ড বা ঔদন্ডপুর বিহার। যে অধিবাসীদের তিনি হত্যা করেছিলেন সেই অধিবাসীদের সকলেই ছিলেন মুন্ডিতশির বৌদ্ধ ভিক্ষু। এই বিহার থেকেই বর্তমান বিহার জনপদের নামকরণ। এই জনপদে একসময় প্রচুর বৌদ্ধবিহারও ছিল যার সকলই তিনি ধ্বংস করেছিলেন।

এবার আসি অত্যাচারী রাজা লক্ষণ সেন সম্পর্কে। লক্ষণ সেন কেমন ছিলেন তার সাক্ষ্যও কিন্তু মিনহাজই দিচ্ছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, 'রায় লখমনিয়া (লক্ষণ সেন) মহৎ রাজা ছিলেন। হিন্দুস্তানে তাহার মত সম্মানিত রাজা আর কেহ ছিল না। তাহার হাত কাহারও উপর কোন অত্যাচারে অবিচারে অগ্রসর হইত না। এক লক্ষ কড়ির কমে তিনি কাহাকেও কিছু দান করিতেন না।'

আরেক মুসলমান ঐতিহাসিক ইসমী বলছেন, লক্ষণ সেন কখনই দুর্বল রাজা ছিলেন না। অত্যন্ত মহৎ, উদার ও সাহসী যোদ্ধা ছিলেন তিনি। বলা হয়ে থাকে নদীয়ার দুর্গ দুর্ভেদ্য ছিল, মোটেও এমনটা নয়। নদীয়ার যে দুর্গে মুহাম্মদ খিলজী আক্রমন করেন, তা ছিল অতি সাধারণ গঙ্গাতীরবর্তী একটি তীর্থস্থান। গঙ্গার তীর ঘেসে ছিল রাজার প্রাসাদ। এই প্রাসাদ সুদৃঢ় অট্টালিকা নয়। তদানীন্তন বাঙলার রুচি ও অভ্যাসানুযায়ী কাঠ ও বাঁশের তৈরী সমৃদ্ধ বাংলা বাড়ী। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমানে সৈন্যবাহিনীও উপস্থিত ছিলেন না। ১৮ জন সৈন্য নিয়ে মুহাম্মদ খিলজী যখন নগরে প্রবেশ করেন তখন সবাই ভেবেছিলেন তারা বোধ হয় ঘোড়া ব্যবসায়ী। সেই সুযোগে খিলজী প্রাসাদে আক্রমন করে বসেন। তখন সময় দ্বিপ্রহর। মুসলমানেরা যা লুকায় তা হল, খিলজী প্রাসাদে আক্রমণ করার প্রায় সাথে সাথেই তার পিছনে থাকা বিশাল তুর্কী বাহিনীও নগরে ঢুকে যায় এবং প্রাসাদের সকলকে হত্যা করে। ইসমী বলছেন, অতর্কিত হামলা করার পরেও বৃদ্ধ লক্ষণ সেন হাল ছেড়ে দেননি। তিনি ও তাঁর সৈন্যরা সাহসিকতার সাথে দস্যু খিলজীদের মোকাবেলা করেন। একসময় পরাজয় নিশ্চিত জেনে তিনি বিক্রমপুরের দিকে পালিয়ে যান।

দস্যু খিলজীর অত্যাচারের কাহিনী তখন লোককাথায় পরিণত হয়েছে। যেখানেই যা পেয়েছেন লুট করেছেন। যেখানেই যা পেয়েছেন ধ্বংস করেছেন। নির্বিচারে নগরের সাধারণ মানুষদের হত্যা ও শিরচ্ছেদ করেছেন। নিম্নবর্ণের হিন্দু, ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধরা দিকবিদিক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অত্যাচারে টিকতে না পেরে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছেন। বৌদ্ধ লামা তারনাথের লেখাতেও যার সাক্ষ্য আছে।

বলা হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ডুবেছিল ১৭৫৭ সালে, ইংরেজদের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে। কথাটি সত্য নয়। বাংলার পরাজয় ঘটেছিল এক দল মুসলমান দস্যুদের হাতে, সেই ১২০১ খৃষ্টাব্দে। তখন থেকেই বাংলা পরাধীন। বাংলায় মুসলমানদের ইতিহাস কোন গর্বের বিষয় নয়, বাংলায় মুসলমানদের ইতিহাস দস্যুবৃত্তির ইতিহাস। লুটতরাজের ইতিহাস। হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস। সবাইকে বাংলা শুভ নববর্ষ।

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test