E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কওমী মাদ্রাসায় মাস্টার্স সনদ কেন?

২০১৭ এপ্রিল ২৫ ২১:২০:৫৮
কওমী মাদ্রাসায় মাস্টার্স সনদ কেন?

কাজী আনিছ :


হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি। আমি তখন প্রথম আলোতে কাজ করি। আমাকেসহ বেশ কয়েকজনকে অফিস থেকে স্থান ভাগ করে দেওয়া হলো। আমার স্থান হয় গাবতলী। ভোরে ভোরে গাবতলী চলে গেলাম। ধীরে ধীরে হাজার হাজার হেফাজত কর্মীর অবস্থানে গাবতলী সয়লাব। আমি যতই দেখছিলাম, ততই আশ্চর্য হচ্ছি, তাদের ক্ষমতা দেখে নয়, অক্ষমতা দেখে।

অফিসে ফিরে আমি শরীফুল হাসান ভাইয়ের সঙ্গে বলছিলাম, এতগুলো শিশু, কিশোর, তরুণ। তারা তো আমাদের দেশের সন্তান। অথচ তারা আমাদের দেশের কোনো কাজেই আসছে না! তারা কোনো আধুনিক শিক্ষা পাচ্ছে না! আমি ভাবতেই শিউড়ে উঠলাম, কত হাজার সম্ভাব্য জনশক্তি থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে।

এ হেফাজতের কর্মীরা কওমী মাদ্রাসার। হাল আমলে এ কওমীকে মাস্টার্স সনদ দেওয়ার কথা উঠেছে। হেফাজত নেতারা খুশিমনে যুক্তি দিচ্ছেন, সরকার এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশের প্রচলিত ধারায় অন্তর্ভুক্ত করছেন।

সরকার কোন উদ্দেশ্যে মাস্টার্স সনদ দিতে চায়, তা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু হেফাজত নেতারা সনদ বগলদাবা করে এর স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলো দাঁড় করিয়ে যাচ্ছেন, আসলে তা খোদ ওই মাদ্রাসার নিষ্পাপ শিশু, কিশোর ও যুবকদের সঙ্গে নির্ঘাৎ প্রতারণা, একটি ফাঁদ। নিষ্পাপ বলছি এ কারণে, আপনি কওমী মাদ্রাসার শিশু, কিশোর ও যুবকদের সঙ্গে কথা বলে দেখবেন, তাদের ওস্তাদের প্রতি তাদের অগাধ এক বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করে, তাদের এ ওস্তাদ যা বলে তা খোদ আল্লাহ ও তার রাসুলের কথা।

অবুঝ শিশু ও কিশোরের তা ব্যাখ্যা করারও কোনো সুযোগ নেই। আর ওই শিশু-কিশোরের বাবা-মাও আল্লাহ ও তার রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য নিজের নিষ্পাপ সন্তানটিকে কওমী মাদ্রাসায় পাঠায়। কেউ বা অভাবের তাড়নায়। শিশু-কিশোরদের এ মানসিকতা বা বিশ্বাস এবং তাদের বাবা মায়ের এ আস্থা সম্পূর্ণ নির্দোষ। আর তার সুযোগ নেওয়া হয়। এ বিশ্বাস ধোলাই হয়, বিকৃত ও বিক্রিত হয় ওস্তাদের আসন নিয়ে বসে থাকা ওই মানুষগুলোর নিজেদের তৈরি করা কাঠামোতে।

এখনকার মানুষ অনেক সচেতন হয়ে উঠছে। মানুষ ভালমন্দের পার্থক্য বুঝে। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষায় কোনো আধুনিক শিক্ষার ছোঁয়া নেই বলে অনেকেই এখান থেকে বের হয়ে আসছেন। আমি এমন কয়েকজনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। এ শিক্ষা অর্জন করে কোনো চাকরি না মেলায় অনেক বাবা-মাও এখন তার সন্তানদের এখানে ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক।

আবার দেখবেন, কওমী মাদ্রাসার পাঠ চুকিয়ে অনেকেই নতুন করে ভর্তি হন সরকারি নিয়ম ও আধুনিক শিক্ষা অনুসরণকারী মাদ্রাসায়। এগুলোকে বলা হয় আলিয়া মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে কওমী ছাত্ররা সার্টিফিকেট নেন। এমনকি হেফাজত নেতাদের অনেকেই কিন্তু কওমী চুকিয়ে আলিয়ার সার্টিফিকেটধারী। এই যে কওমী শেষ করে যখন অন্য জায়গায় আবার ভর্তি হতে হয়, এটা কওমীর ’আদর্শের’ প্রতিও হুমকি। কারণ, অনেকেই ভিন্ন ধারায় গিয়ে ভিন্ন মতাবলম্বী হয়েছেন, আগের ধারা যে ভুল তা বুঝতে পেরেছেন-এমন সংখ্যাও কম নয়।

সূতরাং এখানে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সংকট আবার ‘আদর্শগত’ সংকট-উভয়ের সমস্যায় সম্মুখীন। তাই এ সংকটটাকে দূর করতে এবং আদর্শকে সমুন্নত রাখতে একটি ’মুলা ঝুলানোর’ প্রয়োজন। আর তা মাস্টার্স সনদ। আর তা যদি হয়, তাহলে তা হবে ভর্তি হওয়া বা ভর্তিচ্ছুদের সঙ্গে একটি প্রতারণা। কারণ, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষায় কোনো আধুনিক শিক্ষা নেই। এখানে প্রতি ক্লাসে জোর দেওয়া হয় শুধু একটি বিশেষ বিষয়ের উপড়। যেমন আমরা আধুনিক শিক্ষায় বলি, প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি। কিন্তু কওমী মাদ্রাসায় বলা হয়, হেদায়া, কাফিয়া ইত্যাদি। এগুলো আরবি ব্যাকরণ গ্রন্থ। আর সর্বশেষ ধাপটি দাওরায়ে হাদিস। মানে হাদিস গ্রন্থ। আধুনিক শিক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থার পর্যবেক্ষণ ও তদারকি আছে। এখানে নেই। আধুনিক শিক্ষায় বিভিন্ন পরীক্ষার ধাপ অতিক্রম করে তারপর মাস্টার্স। এখানে নেই। এসব সমস্যা ও ত্রুটি রেখে হঠাৎ করে মাস্টার্স সনদ-সরকারের উদ্দেশ্য বুঝার মতো জ্ঞান আমার নেই, কিন্তু হেফাজত নেতাদের উদ্দেশ্য বুঝি, ’মুলা ঝুলানো’... সংকট কাটাতে।

আজকে কওমী মাদ্রাসার আপাদমস্তক সংস্কার করে সরকারি নীতিমালায় এনে আধুনিক শিক্ষারও বিস্তার ঘটাতে যান, নিশ্চিত প্রতিবাদ আন্দোলন। তাই এ সংস্কারকে দূরে রেখে নিয়ন্ত্রণ না করে আপসের পথে গেলে তা আদতে হবে তাদের সংকটটাকে কাটাতে সহায়তা করা। তাদের ‘আদর্শকে’ সমুন্নত করা, যে আদর্শের ভয়ংকর রূপ দেখেছি, প্রতিনিয়ত দেখি।এটি হবে পুরো দেশের জন্য ভয়ংকর। যে নিষ্পাপ মুখগুলো, যে পরিবারগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার মাস্টার্স সনদের কথা শুনে কওমী মাদ্রাসায় ভিড় জমাতে শুরু করেছে বা করবে, তাদের সঙ্গে হবে নির্ঘাৎ এক প্রতারণা।

মোহাম্মদপুরে আমি যে চায়ের দোকানে চা খাই, সেখানে প্রায় সময় কয়েকজন কওমী মাদ্রাসার শিশু-কিশোর, তরুণ চা খেতে আসে। কিছুদিন আগে দুই তরুণের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে দিলাম। মাস্টার্স সনদের কথা তাদের ওস্তাদ তাদের কানে পৌঁছে দিয়েছে। তাদের বিশ্বাস, তারাও দেশের অফিস আদালতে চাকরি পাবে।

আমি চুপ করে চলে এসেছি। ভেবেছি, কারা আমার এ দেশটাকে জনশক্তিহীন করে তুলছে? কারা আমার দেশের এ নিষ্পাপ, অবুঝ সন্তানদের জীবন নিয়ে প্রতিনিয়ত খেলে যাচ্ছে?

লেখক : সিনিয়র লেকচারার, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test