E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে

২০১৪ জুন ২৩ ২১:৪৫:১৪
আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে

শেখ হাসিনা : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের ইতিহাস আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, বাঙালী জাতিকে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বিশ্বসভায়।

আত্মপরিচয়ের সুযোগ করে দেয়া, বাঙালীর মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করাসহ বাঙালীর যা কিছু প্রাপ্তি, যা কিছু গৌরবের, তার সবই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে একটি শক্তিশালী ও গণমুখী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের সকল জেলা, মহকুমা থেকে শুরু করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চারণের বেশে ঘুরে বেড়ান। নিজের চোখে দেখেন সাধারণ মানুষের দুঃখ বেদনা বঞ্চনা, তাদের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়-অবিচার। তাদের দুঃখ দুর্দশার অবসান ঘটাবার জন্য তিনি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

তিনি উপলব্ধি করেন যে, একটি শক্তিশালী সংগঠন ছাড়া সাধারণ মানুষের মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তাই তিনি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে অধিক মনোযোগ দেন। এই সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে শাসক শ্রেণীর সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে বারবার তিনি মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হন ও কারাবরণ করতে হয়। এমনকি জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের কথা বলতে গিয়ে তাঁকে অনেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে মিথ্যে মামলার আসামীও করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর নীতিতে ছিলেন হিমালয়ের মতো অটল-অবিচল। সকল হুমকির বিরুদ্ধে তিনি বাঙালীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর প্রাণপ্রিয় আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীও জেল-জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা অর্জন ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আমরা এক ঐতিহাসিক ঘটনার অদ্ভুত সম্মিলন দেখতে পাই। এই সংগঠন যেন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল এক ঐতিহাসিক দায় পরিশোধ করে বাঙালীর আজীবন লালিত আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দিতে। আমরা পিছনে ফিরলে বা ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলা যুদ্ধে পরাজিত হন আর এই পরাজয় হয়েছিল তারই প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বেঈমানীর কারণে। সেই পরাজয়ের মাধ্যমে বিদেশী শক্তির কাছে দেশের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়।
তার প্রায় দুইশ’ বছর পরে ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে একটি গণমুখী সংগঠন ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের সম্মেলনে নাম সংশোধন করে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে যাতে সকল ধর্ম ও মতের মানুষ এই সংগঠনকে নিজের করে নিতে পারে, আরও শক্তিশালী করতে পারে। আওয়ামী লীগ সংগঠনকে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে তাদের মুক্তির দূত হিসেবে। ২৩ বছরের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আজকের জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তান নামের দেশটির একটি প্রদেশ, যার ভৌগলিক দূরত্ব ছিল ১২শত মাইল। ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি-নীতি, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস কোন কিছুরই কোন মিল ছিলনা। কেবল মাত্র ধর্ম ছাড়া অভিন্ন আর কোন উপাদানই ছিলনা।

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বাঙালীরা ছিল সংখ্যায় বেশী কিন্তু শোষণ করত সংখ্যালঘুরা। সরকারী চাকুরী, সামরিক বা অসামরিক কোন জায়গায় কোন ভাল অবস্থানে বাঙালীর কোন সুযোগ ছিল না। ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর বঞ্চনা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াই ছিল যেন বাঙালীর নিয়তি। প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম অবহেলা আর অপমানের মধ্য দিয়ে জীবন ধারণ করতে হত। বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ অর্জন করতো পূর্ববাংলা অথচ তা ব্যবহারের অধিকার বাঙালীদের ছিলনা।

এমনকি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানী শাসকদল। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার লড়াই শুরু। ২ মার্চ ফজলুল হক হলের ছাত্রসভায় সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ই মার্চ ভাষা দিবস পালন থেকে সংগ্রামের শুরু করে বাঙালীরা। বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্র-যুবনেতাদের গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় পাকিস্তানীদের অত্যাচার নির্যাতন, পুলিশী জুলুম, মামলা দায়ের। ভাষা সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন চালিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু আবারো কারাগারে বন্দী হন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই ভাষার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য কর্মপরিষদ গঠন করা হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিকসহ অনেকে শাহাদাত বরণ করেন। শুধুমাত্র মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য বাঙালীর এই আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন গৌরবালেখ্য।

১৯৫৩ সালে ৬ই ফেব্রুয়ারি ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় -২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হবে। সেই মোতাবেক দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র জেলায় চিঠি দিয়ে নির্দেশ প্রেরণ করেন।
কর্মসূচীগুলি হলঃ ১। হরতাল ২। শোভাযাত্রা ৩। জনসভা ৪। কালোপতাকা উত্তোলন ৫। কালো ব্যাজ ধারণ।

আওয়ামী লীগ সংগঠন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করতে গিয়ে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়। তারপরও সফলতার সাথে দিবসটি পালিত হয়। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সেদিনের সেই সাহসী সিদ্ধান্তের পথ ধরেই আজ সারাদেশের দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালি ২১ ফ্রেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আজ জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে বিশ্বব্যাপী তা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয় যেখানে আওয়ামী লীগই ছিল সারাদেশে বিস্তৃত মূল সংগঠন। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যৌথ নেতৃত্বে বঞ্চিত মানুষ শোষণমুক্তির সুযোগ পায়। দুর্ভাগ্য হল, কেন্দ্রের মুসলিম লীগ সরকার এ পরিবর্তন মেনে নিতে পারে নাই। শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। জরুরী অবস্থা জারি করে ৯২-ক ধারা দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন চালু করে এবং বঙ্গবন্ধুসহ সকল নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ আবারো অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে।

১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর আইয়ুব খান মার্শাল ‘ল জারি করে আবার সকল নেতাকে গ্রেফতার করে। একাধারে সেনাপ্রধান, আবার রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে মিলিটারি ডিক্টেটরের শাসন শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে এটি ছিল দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি পদক্ষেপ আর এই দুর্বলতার সুযোগেই সামরিক শাসন আসার সুযোগ পায়।

বঙ্গবন্ধু ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর গ্রেফতার হন। ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পান তবে তাঁর চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র ছাত্রসমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আইয়ুব খান আরবী/রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রবর্তন করার পদক্ষেপ নেন।

১৯৫৮ সালে মার্শাল ‘ল জারি করার পর সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব সরকারের চক্রান্তে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সহকর্মীদের সহযোগিতায় দাঙ্গা প্রতিরোধ করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

আওয়ামী লীগ সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ব্যাপক সফর শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থাকে সম্পুর্ণ অরক্ষিত। পূর্ব পাকিস্তান আদৌ পাকিস্তানের অংশ কিনা সেটাই সন্দেহ ছিল। কারণ বাংলাদেশের জনগণের নিরাপত্তার বিষয়ে কোন ব্যবস্থাই পাকিস্তানী সরকার গ্রহণ করে নাই। সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল এই অঞ্চলের অসহায় বঙ্গসন্তানরা।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের মুক্তি সনদ ৬ দফা দাবী পেশ করেন। ছয়দফা ছিল এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবী। এই দাবি দেয়ার ফলে ১৯৬৬ সালেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। বন্দী থাকা অবস্থায়ই তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে। ঐ বছরই জুলাই মাসে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়” ফাঁসি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। যা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেয় নাই।

১৯৬৬ সালের ৭ই জুন বন্দী মুক্তি ও ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সমগ্র বাংলাদেশে হরতাল পালিত হয়। গুলিতে শ্রমিক জনতা জীবন দেয়। সেই অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেই কোর্ট বসিয়ে ৩৫জন আসামীসহ বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হলে এদেশের ছাত্র জনতা গর্জে ওঠে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা ও ৬ দফা সামনে নিয়ে আন্দোলন এগিয়ে চলে। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বন্দীদের মুক্তির দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তা পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। আইয়ূব সরকার বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুকে সকল আসামীসহ মুক্তি দিতে। এর আগে সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৫ই ফেব্রুয়ারি বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। আইয়ূব খানের পতন ঘটে। আরেক মিলিটারী ডিক্টেটর ক্ষমতায় আসে, তার নাম ইয়াহিয়া খান। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাঙালী কোন নেতা বা দল পাকিস্তানের শাসনভার হাতে নেবে তা ঐ শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে পারে নাই । তাই ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানাভাবে সময়ক্ষেপণ শুরু করে।

বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। যে আন্দোলনে সমগ্র বাঙালী জাতি অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। সরকারী, বেসরকারী বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে কৃষক-শ্রমিকসহ সকল স্তরের জনগণ একই নির্দেশে চলতে শুরু করে।
ধানমন্ডির ৩২নং সড়কের বাড়িটা হয়ে ওঠে সর্বস্তরের মানুষের গন্তব্যস্থান। সেখান থেকে সমগ্র বাংলাদেশে নির্দেশ দেয়া হত। ৩২ নম্বর থেকে যে নির্দেশ যেত মানুষ অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করতেন। ১লা মার্চ থেকেই পাকিস্তানী শাসকদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। কার্যত তাদের শাসন ভেঙ্গে পড়ে। আন্তর্জাতিক পত্র পত্রিকা ৩২নং সড়কের বাড়িটাকে লন্ডনের ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের সাথে তুলনা করে প্রতিবেদন ছাপায়। দৈনিক আজাদ পত্রিকা ১৯৭১ এর ১৪ মার্চ “৭ কোটি বাঙালি যেখান থেকে নির্দেশ গ্রহণ করে” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলে, “.....বাংলার শাসনক্ষমতা এখন আর সামরিক কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে নাই বরং ৭ কোটি মানুষের ভালোবাসার শক্তিতে ধানমন্ডির ৩২ নং সড়ক এখন বাংলার শাসনক্ষমতার একমাত্র উৎস হইয়া পড়িয়াছে।”
৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা দেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই বক্তব্যের মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর উপর আক্রমণ চালায়। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দেন এবং শেষ শত্রু বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। এই ঘোষণার সাথে সাথেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানী কারাগারে নিয়ে যায় এবং দেশদ্রোহী মামলা দিয়ে ফাঁসির আদেশ দেয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহামদকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করেন। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর আ¤্রকাণনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার শপথ গ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তমিত সূর্য উদিত হয় সেই জায়গায় যার খুব কাছেই দুই শত বছর আগে তা অস্তমিত হয়েছিল।

দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে মিত্র শক্তি ভারত ও অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশ, জনগণ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সহায়তায় বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সেই রেসকোর্স ময়দানেই আত্মসমর্পণ করে। ইয়াহিয়া খানের পতন হয়। ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি বিশ্ব নেতৃত্বের প্রবল চাপে পাকিস্তানের নতুন সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় । ১০ই জানুয়ারি জাতির পিতা ফিরে আসেন তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে এবং রেসকোর্স ময়দানেই তিনি ভাষণ দেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে কিভাবে গড়ে তুলবেন তার দিক নির্দেশনা ও নীতিমালা ঘোষণা দেন। লাখো শহীদ ও নির্যাতিতা মা বোনদের আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধার সাথে স¥রণ করেন। বন্ধুপ্রতিম দেশ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।

বঙ্গবন্ধু মাত্র নয় মাসের মধ্যে জাতিকে সংবিধান উপহার দেন। সেই সংবিধান মোতাবেক ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচন দেন। সেই সাথে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে শুরু করেন।

যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে দেশ যখন নতুন ভাবে গড়ে উঠছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উনèতি হচ্ছে, সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ যখন উজ্জল ভবিষ্যতের পথে পা বাড়িয়েছে তখনই নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগ¯ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করে, অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকা থামিয়ে দেয়। হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। স¦াধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের গৌরবময় ইতিহাস মুছে ফেলে দেয়া হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তির দোসররা যা জাতির জন্য লজ্জাজনক অধ্যায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়ে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করা হয়। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে দেশে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সুচনা করে।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক ঘাত প্রতিঘাত চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ দেশের জনগণের সেবা করার সুযোগ পায়। বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করে, সরকার জনগণের সেবক, সরকারের একমাত্র কাজ জনগণের কল্যাণ। আশাহত, বেদনাক্লিষ্ট, শোষিত মানুষগুলো নতুনভাবে সুন্দর ভবিষ্যতের স¦প্ন দেখতে শুরু করে। গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস জানতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত হয়ে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক উনèতি, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স¦াস্থ্য সেবা, সংস্কৃতি চর্চা দেশকে আবার গৌরবময় অধ্যায়ের পথে এগিয়ে নিতে থাকে।

কিন্তু, দূর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না বাঙালীর। ২০০১ সালে ১ অক্টোবরের নির্বাচন আবার কালো মেঘে ঢেকে দেয় স্বপ্নের রূপালী আকাশকে। হত্যা, নারী ধর্ষণ, জ¦ালাও পোড়াও, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, দূর্নীতি, দুঃশাসন, স¦জনপ্রীতি, দলীয়করণ দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে থাকে। ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে বিএনপি¬-জামাত গং মরিয়া হয়ে ওঠে। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা পতাকা স¦াধীনতার শত্রুদের গাড়িতে, যুদ্ধাপরাধীদের হাতে তুলে দেয়। যারা ১৯৭১ সালে মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, স¦াধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করেছে তারাই হয়ে যায় দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা। হাওয়া ভবন, অর্থপাচার, অস্ত্র চোরাচালান, ড্রাগ-ট্রাফিকিং, এমন কোন অপকর্ম নাই এরা করে নাই। দেশের মানুষ জিম্মি হয়ে যায় এদের হাতে।

এদের অপকর্মের ফসল সেনা সমর্থিত তত্ত¦বধায়ক সরকার ও জরুরি অবস্থা জারি। পাঁচ বছর বিএনপি সরকারের জুলুম নির্যাতন, দুই বছর ফখরুদ্দীন, মঈনুদ্দীনদের জরুরি অবস্থায় দেশের মানুষ দমবন্ধ অবস্থায় দিন যাপন করে। অবশেষে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পায়। পাঁচ বছরে অতীতের সকল জঞ্জাল পরিস্কার করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বসভায় উজ্জল করে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি ও উনèয়নের পথে দেশ অগ্রসর হতে থাকে। মানুষ ফিরে পায় রাজনৈতিক অধিকার । সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা গণতন্ত্রকে সুসংহত করে। উনèয়নের ছোঁয়া প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছাতে থাকে। পাঁচ বছরে দেশ এগিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধিদের বিচার চলছে। বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে। জাতি কলঙ্ক মুক্তির সুযোগ পাচ্ছে।

৫ই জানুয়ারি, ২০১৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উন্নয়নের গতিকে চলমান রাখার সুযোগ পেয়েছে। দেশবাসীর কাছে দেয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করার এ সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যেই উন্নীত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের মানুষ অনেক কষ্ট করেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমি নিশ্চিন্তভাবেই বিশ্বাস করি, তাদের দুঃখের দিনের অবসান ঘটবেই। বিশ্বসভায় বাঙালী জাতি উনèত জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে চলবে। এটাই ছিল জাতির পিতার আকাঙ্খা, যা আমরা বাস্তবায়ন করব ইনশাল্লাহ্।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন আর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অভূতপূর্ব সমন্ময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। পৃথিবীতে এই দুই রাজনৈতিক কৌশলের সমন¦য়, মিশ্রণ ও বিজয় অর্জন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা যা সম্ভব করেছে গণমানুষের দল- আওয়ামী লীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংগঠনের নিবেদিত বিশাল কর্মী বাহিনীর দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগই এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছে।

৬৫ বছরের এই সংগঠন সঠিক নেতৃত্ব ও ত্যাগী কর্মী বাহিনী এবং জনসমর্থন পেয়েছে বলেই গৌরবের সাথে শত ষড়যন্ত্র, বাধা অতিক্রম করে বিজয় অর্জন করেছে, স্বাধীনতা এনেছে, পৃথিবীর বিপ্লবের ইতিহাসে এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আগামীতেও বাংলাদেশ উন্নীত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে, বাঙালী জাতি উন্নীত জাতি হিসেবে এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ত্যাগী কর্মীদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যা কিছু অর্জন করেছে তা কেবল সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী কর্মীদের দ্বারাই, সুসংগঠিত এই সংগঠনের মাধ্যমে। তাদের প্রতি জানাই আমার সংগ্রামী সালাম। বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে সমুন্নত করে রাখার দায়িত্ব আমাদের। লাখো কন্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে আমরাই পেরেছি বিশ্বরেকর্ড গড়তে। আওয়ামী লীগই পারবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পুরণ করতে। আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে ইনশাল্লাহ্। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

শেখ হাসিনা : প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং সভানেত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test