E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অস্ট্রেলিয়ার পার্থে বাদল সরকারের ‘বড় পিসিমা’

২০১৮ জুলাই ২৭ ১৫:৪৮:২৩
অস্ট্রেলিয়ার পার্থে বাদল সরকারের ‘বড় পিসিমা’

বিশ্বজিত বসু : কলকাতা শহরের আবাসিক ফ্লাট ভিমাপুকুর ম্যানসন। ম্যানসনের বিভিন্ন ফ্লাটে বসবাসকারী একদল বাউন্ডুলে আয়োজন করেছে এমেচার থিয়াটারের।  থিয়েটার দলের নাম ভীমাপুকুর ম্যানসন নাট্য সংঘ।  পালের গোদা নিতাই নাটক অন্তঃপ্রাণ। বিয়ে থার বালাই নেই। নাটক নিয়েই পরে থাকে সবসময়। সংগে জুটেছে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা আরেক বাউন্ডুলে শম্ভু। কলেজ পড়ুয়া বিপত্নিক অধ্যাপক যোগেন স্যারের কন্যা অনু, মিস্টার সেনের স্ত্রী মিসেস সেন। চার নম্বর ফ্লাটের ছেলে কিশোর , প্রতিবেশী প্রতুল কর, গগন, আর অনাথ। 

এবারের নাটক কাল বৈশাখি। পরিচালনা করছে নিতাই । শম্ভু স্টেজ ম্যানেজার, নায়িকা প্রমিলার চরিত্রে অনু, প্রতুল কর হিরো, গগন ভিলেন, নায়কের পার্শ্ব চরিত্র শশাংকের ভুমিকায় কিশোর, চাকরের চরিত্রে অনাথ। নায়িকার পার্শ্ব চরিত্র বনানীর ভুমিকায় অভিনয় করছে আর্টের ভীষণ ইন্টারেস্টেড মিঃ সেনের স্ত্রী মিসেস সেন।

নিচতলায় অনুদের ড্রইং রুমে চলে নাটকের মহড়া। অনুর বাবা অধ্যাপক যোগীন চাটুর্য্যে আত্মভোলা আধুনিক মানুষ। নাটকের পৃষ্ঠপোষক। রিহার্সেলের নিয়মিত দর্শক আছে দুজন। একজন খুকু, শম্ভুর ভাইঝি। তার শখ সে বড হয়ে অনু মাসির মত অভিনয় করবে। আরেকজন দর্শক মিঃ সেন। স্ত্রীর অভিনয়ের মহড়া দেখার সুযোগ মিস করেন না। মহড়ার মাঝে মাঝে বা হাত ঢুকিয়ে নিজেকে জাহির করার মধ্যে আনন্দ পান। স্বপ্ন দেখেন নিজের স্ত্রীকে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে । কিন্তু মিসেস সেন মহড়ায় সব সময়ই অন্য মনস্ক। কিম্বা ব্যস্ত থাকেন প্রসাধনে।

বৌদি প্রতিমা মুখোপ্যাধ্যায়ের শম্ভুর প্রাণের বৌদি। ভালবাসা আর শাসন দুই মিলিয়ে বৌদি দেবরের এক মধুর সম্পর্ক। প্রায় প্রতি রাতেই শম্ভুর খাবার নিয়ে বসে থাকতে হয় প্রতিমাকে। অধর্য্য হলে মেয়ে খুকুকে দোতালা থেকে নিচে পাঠিয়ে দেন কাকাকে ডাকতে। আর একটু বেশী অধর্য্য হলে বেশী হলে নিজেই চলে আসেন। নাটকের মহড়া শুরুর পর সেই ডাকাডাকির মাত্রা বেড়ে গেছে অনেক।

কয়েক মাস নিয়মিত মহড়ার পর পরশু রবিবার সন্ধ্যায় নাটক। রিহার্সেল চলছে অনুদের নিচতলায়। হঠাত একটি টেলিগ্রাম বদলে দেয় মহড়ার পরিবেশ। বড় পিসিমা আসছেন।সাড়ে সাতটায় ট্রেন পৌঁছাবে হাওড়ায়। যোগিন বাবু আর অনুর বুকে শুরু হয় ধড়োপড়ানী। নাটক ভেস্তে যাবে, এব্যাপারে তারা নিশ্চিত। অতএব নাটকের মহড়া বন্ধ। এ ব্যাপারে যখন কথোপথন চলছে এমন সময় পিসিমার প্রবেশ। সংগে পিসেমশাই।

বাসায় একদল বাউন্ডুলে ছেলের দল দেখে পিসিমার চক্ষু চড়কগাছ। কি হচ্ছে বাড়ীর ভিতর। পিসিমাকে দেখে অনু দিশেহারা। তাকে ম্যানেজ করার জন্য অনুর একটার পর একটা ভুল বাক্য। যাকে বলে লেজে গোবরে অবস্থা। ছয় মাসের সব পরিশ্রম, টিকিট বিক্রি শেষ, লনে তৈরি হয়েছে মঞ্চ। এখন উপায় ।
বাংলা নাটকের প্রবাদ পুরুষ বাদল সরকারের নাটক বড় পিসিমা। এটা তাঁর লেখা প্রথম মৌলিক নাটক। নগর পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার বাদল সরকার লন্ডনে পড়াশুনা করতে যান গত শতাব্দীর 50 দশকের শেষে । প্রবাসে বসে লিখেন এ নাটক।

বড় পিসিমা হরিহর চাটুর্য্যের বড় কন্যা। জাদরেল বড় পিসি থাকেন লক্লৌতে। স্বামী জাদরেল উকিল। কিন্তু জাদরেল বউয়ের সামনে টুটি পর্যন্ত করেন না। ভাইঝি অনুর প্রতি দায়বোধে পিসি হুট হাট লক্নৌ ছেড়ে চলে আসার অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষ করে ভাই বৌ মারা যাবার পর চলে আসার গতিটা বেরে গেছে বেশ। আজ এরকমই আসা। সেই সাথে লক্ষ্য এবার ভাইঝির বিয়ে ঠিক করে তবেই ফিরবেন। স্বামীর প্রাকিটিস চুলোয় গেলেও থোরাই কেয়ার। জাজের সামনে পিসেমসাই যত দাপুটে বউয়ের সামনে ততটুকুই কেঁচো।

বাউন্ডুলে শম্ভু আর কলেজ পড়ুয়া অনু যে পরস্পরের দিকে ঝুকে আছে অনেকটা, সেটা যোগিন বাবু বুঝতে না পারলেও বড়পিসি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে উপলব্ধী করে ফেলেছেন। নারীর চোখ বলে কথা। আর একজন ব্যাপারটা ভালভাবেই বোঝেন তিনি বৌদি। নিতাই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছে কিনা বোঝা যায় না। কিন্তু শম্ভু আর অনু দুজনেই তার ভীষণ আপনার লোক।

প্রথমে একটা সমাধান এলো। পিসি বেড়াতে যাচ্ছেন কোননগর। থাকবেন শনি আর রবি বার। সবাই একটু আশা নিয়ে মহড়া বন্ধ করে বাড়ী ফিরে গেলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেটা ভেঙ্গে চুরামার।

অনাথ। তোতলামি তার সব কথায়। কিন্তু নাটকে অভিনয় করা তার চরম ইচ্ছা। অগত্যা চাকরের চরিত্রে তার একটা সুযোগ দিয়েছে নিতাই। একটি লাইন ঠিকমত বলতে পারছেনা ছয়মাস যাবত। সহজ সরল কাজ পাগল অনাথ জানতে পারে নাই পিসিমার উপস্থিতি । মঞ্চ তৈরির দড়ি কিনে ফিরে এসেই পিসিমার মুখোমুখি। পিসিমার জেরার মুখে মনের আনন্দে সে জানিয়ে দেয় নাটকের মঞ্চায়নের খবর।

পিসিমা যখন জানতে পারলেন এ বাড়ীতে বাউন্ডুলের দল নাটকের মহড়া করছে তখন নিরাপদ মনে করে সিদ্ধান্ত নিলেন অনুকে সংগে করে নিয়ে যাবেন কোন নগর। । বড় বোনের কাছে অধ্যাপক নির্বাক। আর স্ত্রীর কাছে জাদরেল উকিলও নিরুপায়।

অনু চলে গেলে নাটক হবে কিভাবে। উপায় চলে আসে শম্ভুর মাথায়। সহজ সমাধান। অনুর হঠাত পেটে ব্যাথা বিছানা থেকে উঠতে পারছে না।

অগত্যা সমস্যার একটূ সমাধান মিললেও সব ভেস্তে চলে যায় । অনু মাসিকে খুজতে এসে মনের আনন্দে নাটকের সব সব খবর জানিয়ে যায় খুকু।

"চল আমরা পালিয়ে যায়। না হয়না রাজিবদা।" খুকুর মুখে নাটকের সংলাপ শুনে পিসির রাগ চড়ে যায় ২৪০ ডিগ্রি। হরিহর চাটুর্য্যের বংশের মেয়ে করবে নাটক। শম্ভুর পরিকল্পনা সব চলে যায় ভেস্তে। পিসীমা জোড় করে অনুকে নিয়ে চলে যান কোননগর।

শম্ভু নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে । অনুকে যে করেই হোক নাটকের আগে ফিরিয়ে আনতে হবে। সেন দম্পতির পারস্পরিক বোঝাপরা দেখে শম্ভুর মাথায় নতুন বুদ্ধি এসে ভর করে। বিয়ে! কোনভাবে যদি অনুকে নিতাইদার বউ হিসাবে দেখানো যায় তাহলেই একমাত্র পিসিমাকে থামানো সম্ভব। স্বামীর অনুমতি থাকলে পিসিমা ঠেকাতে পারবে না। সেজন্য মিথ্যা বিয়ের সার্টিফিকেট তৈরিও হয়ে গেল। শুধু বাকি রইল দুটি নাম। এরকম পরিস্থিতিতে নাটকের মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। শেষ মহড়াও হয়ে গেল। কিন্তু অনুর দেখা নেই।

শম্ভু কনফিডেন্ট অনু আসবেই নাটকের আগে। কিন্তু কিভাবে আসবে কেউ বুঝতে পারছে না। শম্ভু নিতাইকে পটাচ্ছে সার্টিফিকেটে অনুর পাশে নিতাইয়ের নাম বসিয়ে দেয়ার। এনিয়ে যখন দুজনের মধ্য চরম বচসা চলছে ঠিক সে সময়ে একটি ট্যাক্সি এসে দাড়ায় ফ্লাটে সামনে। সেখান থেকে নেমে আসে অনু এবং পিসেমশাই। পিসিমা নেমে গেছেন পথে। কিছু কেনাকাটা করে ফিরবেন।

নিজে যাকে মন দিয়ে বসে আছি, সে যখন অন্যের সাথে বিয়ের আয়েজন করে তখন মনের অবস্থা কি হতে পারে। অনুর সেই অবস্থা। সব কিছু শুনে অনু পসিমার নাকের উপর দিয়ে নাটক করার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তত অপাত্রে বিয়েটা ঠেকাতে হবে। সে সময়ে ত্রাণকর্তী হিসাবে আবির্ভূত হয় বৌদি। পিসিমাকে ম্যানেজ করতে দুপুরে দোতালায় খাবার নিমন্ত্রণ করেন । খাবার টেবিলে পিসিমা ম্যানেজড। পিসিমা নাটক দেখবেন।

সন্ধ্যয় নাটক শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সবাই আতঙ্কিত পিসিনা কি করে বসেন অডিটেরিয়ামে। নিতাই মঞ্চে পায়চারি করছে। অনুকে মঞ্চে দেখে পিসিমা উত্তেজিত হয়ে যদি অডিটেরিয়ামে হৈচৈ শুরু করে তখন কি হবে। একটার পর একটা খবর আসতে থাকে। না পিসিমা নাটক দেখছেন। সব শেষে শম্ভু এসে জানায় পিসিমা অনুর অভিনয় দেখে মুখ ভড়া হাসি নিয়ে হাত তালি দিচ্ছেন । বৌদির কাছে জানা যায়। বৌদি অনুর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন পিসি রাজী হয়ে গেছেন। আর পাত্রটি হচ্ছে শম্ভু।

নাটকের মধ্যদিয়ে বাদল সরকার তুলে এনেছেন তত্কালীন সমাজের একটি চিত্র। উঠে এসেছে আগল ভাঙার সংগ্রাম। উঠে এসেছে সমাজের নানা কাজে অংশগ্রহণে নারীকে যে বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়ছে তার একটি । সেই সংগে উঠে এসেছে নারীর অংগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য যোগীন কিম্বা নিতাইদের এগিয়ে আসার গল্প।

পিসিমা সংস্কার আচ্ছন্ন নারীর প্রতিক। তার মধ্যে রয়েছে বাত্সল্য প্রেম এবং কর্ত্যব্যেবোধ। নিজের কর্তব্য বোধ সম্পর্কে সচেতন। আগল ভেঙে বেরিয়ে আসা নারীদের প্রতিক অনু। সংস্কারের দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায় সে।

দুই প্রজন্মের দুই নারীর মধ্যে চিন্তা এবং চেতানার যে দুরত্ব সেটা ফুটে উঠেছে গল্পে। উঠে এসেছে পুরুষ এবং প্রকৃতির পরস্পরের যে চিরন্তন ভাল লাগা বিষয়টি। এবং সেই ভাল লাগার সফল পরিণতি দেখানো হয়েছে শম্ভু আর অনু বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করার মধ্যে দিয়ে।

বাংলা নাটকের প্রবাদ পুরুষ বাদল সরকারের নাটক বড় পিসিমা । সেটিকে কিছুটা সংযাজন বিয়োজন করেছেন সুপ্রিয় গুহ। মঞ্চস্থ হলো পিসিমা বিভ্রাট নামে। ২১ শে জুলাই পার্থ, অস্ট্রেলিয়ার নেক্সাস থিয়েটার মঞ্চে। পার্থের নাট্য সংগঠন বঙ্গ রঙ্গের বাতসরিক প্রযোজনার একটি নাটক। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিতাই - বিশ্বজিত বসু, শম্ভ - সুব্রত বল্দোপ্যধ্যায়, অনু- পারমিতা সেন মূখার্জী, পিসিমা- শর্বরী পাল, বৌদি- শর্মিষ্ঠা সাহা, মিঃ সেন -প্রিয়ঙ্কর ঘোষ, মিসেস সেন - দিপান্বীতা মায়ার, অনাথ - প্রসুন মুখার্জী, গগন - সঞ্জয় ঘোষ, কিশোর- সিদ্ধার্থ গাঙ্গুলী, প্রতুল - অনির্বান চক্রবর্তী, খুকু -মিলি, প্রমটার - জয়ন্ত রায়, পিসেমশাই -দেবাশীষ রায় এবং অধ্যাপক যোগিনের চট্টোপ্যাধ্যায়ের চরিত্রে সির্ধার্থ ভট্টাচার্য্য।

মঞ্চ ব্যবস্থাপানায় ছিলেন নিখিল হালদার, অয়ন ঘোষাল, শুভাশীষ চন্দ, অভিজিত ব্যানার্জি, সুদীপ গাঙ্গুলী, অমৃতা সিন্ধু ঘোষ ও রাজেশ ঠাকুর।, সেট নির্মান এবং প্রপসে জুলিয়ান মায়ার, সুনেতা ঘোষ, দিনবন্ধু মিত্র এবং স্বাগতা লক্ষী ঘোষাল। পোষাক পরিকল্পনায় সঙ্গীতা ঘোষাল এবং কোরিওগ্রাফি করেছেন পারমিতা সেন মুখার্জী।

মেকআপ দিয়ে চরিত্রানুযায়ী কলাকুশলীদের সাজিয়েছেন রাশী ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একদন নবীন এবং প্রবীন নাট্যপ্রেমী। টিমে ছিলেন ইন্দিরা চন্দ, সুস্মিতা সিনহা, শুভ্রা মিত্র, ঋদ্ধী মিত্র, সুনিতা ঠাকুর, অনিন্দিতা সরকার, অর্চনা হালদার, রেনজিনি নায়ার ঘোষ এবং সুস্মিতা গুহ। নাটকের শব্দ বিন্যাস, আলোক সঞ্চালন এবং নির্দেশনায় ছিলেন সুপ্রিয় গুহ।

(বিবি/এসপি/জুলাই ২৭, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test