E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অর্থকষ্ট ও অবহেলায় কোটি পুরুষের স্বপ্নের রাজকন্যা শেফালির বিদায়

২০২০ ফেব্রুয়ারি ০৬ ১৬:৫৬:৫৭
অর্থকষ্ট ও অবহেলায় কোটি পুরুষের স্বপ্নের রাজকন্যা শেফালির বিদায়

বিনোদন ডেস্ক : সত্তরের দশকে এক নামেই বুঁদ হয়েছিলো ভারতের কোটি কোটি পুরুষ। তিনি ছিলেন সবার স্বপ্নের রাজকন্যা। বিশেষ করে তরুণদের কাছে তিনি ছিলেন আরাধ্য। তাকে কল্পনায় নিয়ে রঙিন হয়েছে কত পুরুষের কত বসন্ত তার হিসেব কে রেখেছে! রুপ, গ্ল্যামার, মায়া আর ছলাকলার ষোলকলায় কয়েক দশক এভাবেই মাতিয়ে রেখেছিলেন আরতি দাস ওরফে মিস শেফালি।

ষাটের দশকের শেষদিকে রক্ষণশীল সমাজকে উপেক্ষা করে ক্যাবারে ড্যান্সার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। এরপর তার নাচের তালে আশির দশক পর্যন্ত মাতোয়ারা ছিলো কলকাতা তথা ভারত। তখনকার কলকাতার পুরুষেরা সময় গুনতেন কখন দিন গিয়ে রাত আসবে। নাচের মঞ্চে সুবাস ছড়াবেন মিষ্টি শেফালি। অনেক রকমের নাচ জানতেন তিনি। তার সমকক্ষ কেউ ছিলো না। নাচের জন্য তুমুল জনপ্রিয় মিস শেফালিকে তাই ‘কুইন অফ ক্যাবারে’ বলে ডাকা হতো।

বাঙালির প্রথম ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালি। নাচের মঞ্চ থেকে সিনেমার পর্দা; সবখানেই প্রিয়মুখ ছিলেন মিস শেফালি। তার ভক্ত-অনুরাগীদের তালিকায় ছিলেন ভারতের অনেক বিখ্যাত ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরা। তার রুপ-নাচে ও গুণে মুগ্ধ ছিলেন উত্তমকুমার, অমিতাভ বচ্চনরাও।

উত্তমকুমার মিস শেফালির নাচ উপভোগ করতে প্রায়ই হোটেলে যেতেন। একবার নাচতে নাচতে উত্তমকুমারকে মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন শেফালি। মালা পরানোর রীতি অনুযায়ী শেফালির কোমর ধরে সেদিন উদ্দাম নেচেওছিলেন বাংলা সিনেমার মহানায়ক। সেখান থেকেই পরিচয় ও ঘনিষ্টতা। এরপর শেফালির বাসায় তার নিত্য যাতায়াত ছিলো। সেই যাতায়াত নিয়ে অনেক গল্পই ছড়ানো আছে কলকাতার সিনেমাপাড়ায়। যদিও মিস শেফালি দাবি করতেন, ‘উত্তমকুমারকে আমি দাদা বলে ডাকতাম। তিনি আমার বেডরুমটা পছন্দ করেছিলেন সাজানো গোছানো দেখে। তিনি আসতেন। আমাদের একটা ঘনিষ্টতা ছিলো। তবে সেটা মানুষ যেভাবে ভাবে তেমনটি নয়। আমাদের সম্পর্কটা পারিবারিকভাবেই প্রতিষ্টা পেয়েছিলো।’

মিস শেফালি অমিতাভ বচ্চনকেও নিজের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু বলে দাবি করেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘অমিতাভ তো আমাকে খুবই পছন্দ করতো। আমরা খুব ভালো বন্ধু। যখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় তখন রেখার সঙ্গে তার প্রেম। আমরা অনেক মজা করেছি। বুড়ো বয়সে অনেকেই বদলে গেছে। তবে অমিতাভের কোনো চেঞ্জ আসেনি। সে আগের মতোই আছে। এখনো দেখা হলে সেটা টের পাই।’

শুধু নায়কেরাই নন, ভারতের অভিনেত্রীদেরও প্রিয় ছিলেন শেফালি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে শেফালি এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘একটি হোটেলে আমি মেকাপ শেষে টাওয়াল দিয়ে মুখ ঘষছিলাম। এমন সময় পিঠে কে যেন চর মারলো। তখন আমার অনেক নাম ও প্রভাব। শত শত পুরুষ আমার চোখের ইশারায় উঠে বসে। একটা ভাব সময় কাজ করতো মনের ভেতর। তো আমাকে কেউ চর মারলো বিষয়টা বেশ মনে লাগলো। বিরক্ত হয়ে পেছনে তাকালাম। দেখি ম্যাডাম। মানে সুচিত্রা সেন। তিনি আমার মেকাপ নিয়ে কিছু কথা বললেন। সেই প্রথম আলাপ। এরপর আমাদের খুব ঘনিষ্টতা হয়। ম্যাডাম আমাকে খুব পছন্দ করতেন।’

‘চৌরঙ্গী’ সিনেমা দিয়ে রুপোলি পর্দায় যাত্রা করেন তিনি। উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের দুটি ছবিতেও অভিনয় করেছেন মিস শেফালি। যে সত্যজিতের সিনেমায় অভিনয় করতে সব তারকা-মহাতারকারা অপেক্ষায় বসে থাকতেন সেই সত্যজিৎ আগ্রহ করে ডেকে নিয়েছিলেন শেফালিকে। প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘আমার সিনেমায় অভিনয় করবে?’

সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে শেফালি বলেন, ‘আমাকে অনিল দা’কে (অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়) দিয়ে ডাকালেন। গেলাম। গিয়ে দেখি সৌমিত্র (অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) দা ও তার স্ত্রীকে নিয়ে বসে আছেন। আমাকে নিয়ে গেলেন পাশের একটি রুমে। কী যে চমৎকার করে তিনি আমাকে প্রস্তাবটা দিলেন! আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কত কোমল আর নরম করে তিনি বলেছিলেন তার ছবিতে কাজ করবো কী না। তারপর দুটো ছবিতে কাজ করা হলো। তিনি আমাকে একটা অন্যরকম সাহস দিয়েছিলেন। প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।’

শেফালির নাচে ও উদ্দাম জীবনের আহ্বানে যুব সমাজ নষ্ট হচ্ছে, ঘরের পুরুষরা সব উচ্ছ্বন্নে যাচ্ছে এই অভিযোগে শেফালির বিরুদ্ধে বহুবার প্রতিবাদ উঠেছে। অনেক নায়িকারা তাকে হিংসে করতেন। সেইসব নায়িকারা আড়ালে আড়ালে শেফালিকে ঘায়েল করার অনেক ষড়যন্ত্র-চেষ্টাই করেছিলেন।

সবকিছু মোকাবিলা করেছেন শেফালি শক্ত মনে। এসময় তিনি পাশে পেয়েছেন তার অনেক বিত্তবান, প্রভাবশালী প্রেমিকদের। পাশে পেয়েছেন শোবিজের অনেক তারকাদের। এভাবেই সবার নয়নমণি হয়ে ছিলেন তিনি।

সেই শেফালির জীবনের অবসান হলো আজ বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভোর বেলায় সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে। শীতের ভোরে ঝড়ে গেল রাতের শেফালি!

শেষ জীবনে কঠিন ও করুণ সময় পার করেছেন তিনি। রঙিন ও উৎসমুখর জীবনের শেফালি ভোগ করে গেছেন অসহায় ও বেদনার নিঃসঙ্গতা। অর্থকষ্টেও ছিলেন। কলকাতার ওবেরয় গ্র্যান্ডে মিস শেফালির নিজস্ব সুইট ছিল। আর সার্কাস এভিনিউতে রাজসিক ফ্ল্যাট। ছিলো অনেক রকমের গাড়ি। দুই হাতে রোজগার করতেন, হাত খুলে দানও করতেন তিনি। দাতা শেফালির সুনাম কলকাতাজুড়ে আজহ বহমান।

কিন্তু শেষদিকে এসে সব হারিয়ে নিঃস্ব শেফালি। বয়সের কাছে হেরে অভিনয় গেল, নাচ গেল। থাকতেন এমন এক ফ্ল্যাটে যেখানে ভাল করে রোদও ঢুকে না। শ্বাসকষ্ট ছিলো। কিডনি নষ্ট। হার্টের অসুখ। আরও নানা উপসর্গ।

বাধ্য হয়ে শেষ জীবনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। এক টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘মমতা তো এখন অনেকের জন্য অনেক কিছু করেন। তিনি শোবিজের মানুষদের দেখাশুনা করেন মমতা নিয়ে। কিন্তু আমার খোঁজ তো কেউ নেয় না। আমাকে তো সম্মান দেয় না। আমি সাহায্য চাই।’

কারো কাছ থেকেই আর কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হবে না মিস শেফালির। সব নিঃসঙ্গতা ও চাওয়া পাওয়ার খাতা বন্ধ করে দিয়ে অন্য ভুবনে যাত্রা করেছেন তিনি। তার সেই যাত্রা যেন আনন্দের হয়। রঙিন আর উৎসবমুখর থাকুক তার নতুন ভুবন।

(ওএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test