E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

বিচার পেতে প্রধান বিচারপতির আত্মীয়কেই দিতে হয়েছে ১৮ লাখ

২০২৩ মে ২০ ১৮:৪৮:১১
বিচার পেতে প্রধান বিচারপতির আত্মীয়কেই দিতে হয়েছে ১৮ লাখ

স্টাফ রিপোর্টার : প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের অভিভাবক। তার নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টসহ সারাদেশের আদালত পরিচালিত হয়। সেই প্রধান বিচারপতির এক আত্মীয় হাইকোর্টে এসে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এক মামলার রায়ের নকল সংগ্রহ করতে দুই আইনজীবীর সহকারীকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েও পাননি রায়ের অনুলিপি। মামলার খরচ বাবদ আইনজীবীকেও দিতে হয়েছে ১৮ লাখ টাকা।

বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সেই ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘আইনজীবীর সহকারীরা যদি একটা নকল তুলতে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে যান, তারপরও ক্লায়েন্টকে চরকির মতো ঘোরাতে থাকেন, এটা রোধ করবে কে?

মামলার জাজমেন্টের কপি তুলতে নিকট আত্মীয়ের আদালতে হয়রানির কথা তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জাজমেন্ট করানোর জন্য ১৮ লাখ টাকা ল’ইয়ার নিয়েছেন। এরপর তার পক্ষে রায় আসলেও ৪০ হাজার টাকা তার ক্লার্ক নিয়েছেন রায়ের নকল তোলার জন্য। পরে নকল ওঠানোর জন্য আরেকজন ক্লার্ককে ধরেছেন। তিনিও আবার ৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু মামলার রায়ের নকল পাননি।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি একটি কেসের ঘটনার কথা আপনাদের বলি, এখানে সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি আছেন। তারা হয়তো অখুশি হতে পারেন। এখন থেকে ৭/৮ বছর আগে আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় সার্ভিস ম্যাটারে রিট করার জন্য আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। আমি তাকে অ্যাডভাইস করলাম, বললাম দেখো মামলা-মোকদ্দমা করতে যেও না। মামলা কোরো না। এ মামলাতে তুমি হেরে যাবে। এটা সার্ভিস ম্যাটার। তকে কেউ হয়তো অ্যাডভাইস করেছে যে, হাইকোর্ট ডিভিশনে যদি রিট পিটিশন করো তাহলে তুমি রিকুইটাল পাবা। কিন্তু এটা হাইকোর্ট ডিভিশনের এখতিয়ারের বিষয় ছিল না।’

‘কিন্তু সে যাই হোক, আমি তাকে অ্যাডভাইস করলাম। তারপর আমাকে না জানিয়ে হাইকোর্টে মোকদ্দমাটা করেন। হাইকোর্ট তার পক্ষে রায়ও দেন। রুল অ্যাবসুলুট (যথাযথ ঘোষণা) হয়। অ্যাবসুলুট হওয়ার পর তিনি আর নকল পান না। অনেকদিন ঘুরে ঘুরে নকল যখন পাননি, তখন একপর্যায়ে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি তখন দেশের প্রধান বিচারপতি। এর আগে তিনি যে মামলা করেছেন, রুল অ্যাবসুলুট হয়েছে, কিছুই আমাকে বলেননি। কারণ আমি তাকে মামলা করতে বারণ করেছিলাম।’ বলেন প্রধান বিচারপতি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রিসেন্টলি (সম্প্রতি) আমার ব্রাদারদের (সহকর্মী বিচারপতি) কাছে গল্পটা করেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতিটা আপনাদের বোঝানোর জন্য বলছি। আমি তখনও প্রধান বিচারপতি। একদিন সেই আত্মীয় আমার বাসায় গেছেন। আমি কাজ করছিলাম। বাসায় এসে দেখি সেই আত্মীয় কান্নাকাটি শুরু করেছেন। আমি বললাম কান্নাকাটি করো কেন। তখন তিনি বললেন, আপনি তো মোকদ্দমা করতে নিষেধ করেছিলেন। আমি মোকদ্দমা করেছিলাম, জিতেছিও। কিন্তু আজ দুই বছর হলো মামলার রায়ের কপি হাতে পাইনি। আমি যে অ্যাডভোকেট এনগেজড করেছিলাম সেই অ্যাডভোকেট সাহেবের ক্লার্ককে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি নকল ওঠানোর জন্য। ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার পরও রায়ের নকল দিতে পারেননি। পরে আরেকজন ল’ইয়ারের ক্লার্ককে বললাম তুমি নকলটা তুলে দিতে পারো? তিনি বললেন খুবই পারি। কিন্তু নকল তুলতে পারেননি। এর মধ্যে ওই ক্লার্ক ৮০ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছেন।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ কেসের পারপাসে মোট কত টাকা খরচ করেছো? তিনি তখন বলেন, আমি ল’ইয়ারকে দিয়েছি ১৮ লাখ টাকা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ল’ইয়ার সাহেবের নাম কী? একজনের নাম বললেন। কিন্তু সেই আইনজীবীর নাম আমি এর আগে শুনিনি, দেখিওনি। যারা প্র্যাকটিসিং ল’ইয়ার তাদের সবাইকে তো আমার চেনার কথা। আর ১৮ লাখ টাকা যার ফি তাকে তো চিনবোই। কিন্তু একে আমি চিনতে পারলাম না। ১৮ লাখ টাকা ল’ইয়ার নিয়েছেন। ৪০ হাজার টাকা তার ক্লার্ক নিয়েছেন নকল তোলার জন্য। পরে নকল ওঠানোর জন্য আরেকজন ক্লার্ককে ধরেছেন। তিনি আবার ৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু মামলার নকল পাননি।’

প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ সমস্যাটা কীভাবে সমাধান করবো? আপনারা বলেন তো দেখি? এটা সমস্যার একটা উদাহরণ দিলাম। এর মধ্যে আশার কথাও আছে আবার হতাশার কথাও আছে। যেগুলো আমাদের উৎসাহিত করে। আবার আলোচনা এরকম করলে কেউ খুশি হবে, কেউ অখুশি হবে। আমি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আমাদের কোনো একটা কোর্টের ডিসপোজাল মামলার সংখ্যা মাত্র ১৩টি, আবার ওই পিরিয়ডে (সময়কাল) কোনো একটা কোর্ট ডিসপোজাল হয়েছে সাড়ে তিন হাজার। ছয় মাসে সাড়ে তিন হাজার কেস ডিসপোজাল করেছে। যে ১৩টি মামলা ডিসপোজাল করেছে সে বেঞ্চ নিয়ে, আবার যে সাড়ে তিন হাজার কেস ডিসপোজাল করেছে তাকে নিয়েও আমাদের চলতে হবে।’

হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা আমাদের অধস্তন আদালত ভিজিটের কাজে ঝিনাইদহ গিয়েছিলাম, একজন নারি অফিসার নিয়ে এসেছি লিগ্যাল এইড অফিস থেকে। দেখলাম ওদের তিন বছরের এস্টিমেট ধরে কাজ করেছে। ওরা বললো যে, স্যার ওকে নিয়ে গেলেন, সাড়ে ৫০০ মামলা ডিল করেছে। এরকম আছে, এরকমও পেয়েছি, আবার অনেক কম।’

প্রধানবিচারপতি বলেন, ‘আমাদের লিগ্যাল এইড অফিসার যারা বিভিন্ন জেলায় কাজ করছেন, আমি অনেকগুলো জেলা ঘুরে দেখেছি, তাদের পারফরমেন্স খুব ভালো। এসব জেলার মতো সবাইকে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছাশক্তিটা কী, ইচ্ছা শক্তি যদি দেশ প্রেম হয়, ইচ্ছাশক্তি যদি আমাদের ৭১ হয়, ইচ্ছাশক্তি যদি হয় মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে, এই যে কতগুলো উদাহরণ দিলাম, এমন যারা মাসের পর মাস বছরের পর বছর ঘোরেন বিচার পাওয়ার জন্য, তাদের কোনোভাবে উপকার হোক। আমি তো বুক ফুলিয়ে বলি, ডাক্তারি পেশা যদি প্রথম মানবসেবা হয় তাহলে আইনজীবীদের মানবসেবা দ্বিতীয় সেবা প্রবেশন হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু সেবা যদি ওই ১৮ লাখ টাকার পর ৪০ হাজার, তারপর ৮০ হাজার, এরপরও জাজমেন্ট নামে না। এটা কোনো সেবা না। এটা নিয়েও চলতে হবে। আমাদের খুরশীদ আলম খান সাহেব, রেকর্ড ফাইল যায় না। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে এর পেছনে কী সমস্যা, সেটাও প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমাকে দেখতে হয়।’

কায়েকবার সেকশনে গিয়েচেন উল্লেখ করে দেশের প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পেশায় যে সুইপার তারও আমি প্রধান বিচারপতি, আবার যে হাজার হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করে, যারা দেশ থেকে টাকা পাচার করছে তাদের বিচারও আমাদেরই করতে হয়।’

বারের সভাপতি ও সম্পাদকের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আইনজীবীদের আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতে হবে, কেসে (মামলা) অ্যাডজন্টমেন্ট না নিয়ে কোর্টকে আপনারা হেল্প করবেন। কোর্টের বিচারকের একার পক্ষে কোনো সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব না, যদি আইনজীবীদের হেল্প না আসে, আইনজীবীর সহকারীর হেল্প না আসে। আইনজীবীর সহকারীরা যদি একটা নকল তুলতে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে তারপরও ক্লায়েন্টকে চরকির মতো ঘোরাতে থাকেন, এটা রোধ করবে কে?’

তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ছাড় দেবেন না, সে যত উচ্চপদস্থ অফিসারই হোক, মধ্যমসারির অফিসার হোক, আর যত নিচের কর্মকর্তাই হোক।

(ওএস/এসপি/মে ২০, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test