E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আসাদের জয়ে যন্ত্রণা জনগণের

২০২০ সেপ্টেম্বর ২৮ ১৬:০৪:৩১
আসাদের জয়ে যন্ত্রণা জনগণের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২০১১ সালে সংঘাতের শুরু হলেও নানা পক্ষের অংশগ্রহণে দ্রুতই তা হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তিদের এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সিরীয়দের জন্য ডেকে এনেছে মহাবিপদ।

করোনাভাইরাস মহামারি দেশটির নাগরিকদের জীবনকে নতুন করে হুমকির মুখে ফেলেছে। সিরিয়ায় খাবারের দাম এতো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, নারীরা সন্তানদের মুখে আহার তুলে দেয়ার জন্য লতাপাতা সিদ্ধ করছেন। রাজধানী দামেস্কের বেকারিগুলোতে সামান্য ভর্তুকিতে রুটি পাওয়া যায়। এ নিয়ে প্রায়ই সেখানে লোকজন একে অপরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

একবেলার আহার জোগাড়ের জন্য মানুষ মাইলের পর মাইল হাঁটছেন। দেশটির কিছু কিছু শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। সিরিয়ার মুদ্রার মূল্য এতো বেশি পড়ে গেছে যে, স্থানীয়দের অনেকে এটিকে সিগারেটের কাগজ হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার এক বছরে সিরিয়ায় এখন এমন চিত্র। প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাওয়া বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছেন বাশার আল-আসাদ।

শেষ আরেক ধাক্কায় বিজয় নিশ্চিত হবে বলে আশা করেন সিরিয়ার এই প্রেসিডেন্ট। শুধু তাই নয়, বিদেশি যেসব শক্তি দেশটিতে তার বিকল্প নেই বলে মনে করেন, তারাও পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং পুনর্গঠনে সহায়তা করবেন বলে বিশ্বাস বাশার আল-আসাদের।

কিন্তু এখন পর্যন্ত তার সেসব আশা সূদূর পরাহতই। বসন্তে তুর্কি সমর্থিত বিদ্রোহীরা তাদের শেষ শক্তিশালী ঘাঁটি ইদলিবে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বাহিনীর অভিযান প্রতিরোধ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ার অঙ্গীকার করলেও সৈন্যরা এখনও সিরিয়ায় রয়েছেন। দেশটির তেল-সমৃদ্ধ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দিদের সহায়তা-সমর্থন দিচ্ছে মার্কিন বাহিনী।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সিরিয়ার অর্থনীতি। আর এতে খাঁড়ার ওপর মরার ঘা হিসেবে হাজির হয়েছে প্রতিবেশি লেবাননে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কট। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারি। সিরিয়ায় করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডব ভয়াবহ বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করলেও স্থানীয় প্রশাসন তা গায়ে মাখছে না। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির চেয়েও বাশার আল-আসাদ সমর্থিত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে জাতিসংঘ।

সিরিয়ার অর্থনীতিকে ইতোমধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ। দেশটিতে বর্তমানে দৈনিক মাত্র ৬০ হাজার ব্যারেল তেল উৎপাদন হয়; যা যুদ্ধের আগের সময়ের এক ষষ্ঠাংশের সমান। লেবাননের ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখার ইতিহাস রয়েছে সিরীয়দের। কিন্তু চলতি বছর দেশটির ব্যাঙ্কগুলো অর্থ উত্তোলন সীমিত করে ফেলে। এতে প্রায় প্রত্যেকেই আর্থিক সঙ্কটে পড়েন।

চলতি বছর ডলারের বিপরীতে সিরীয় পাউন্ডের পতন হয়েছে রেকর্ড ৭০ শতাংশের বেশি। দেশটির প্রধান প্রধান সব খাবারের দাম বেড়ে গেছে। সরকার ভর্তুকি এবং অর্থ-সহায়তা কাটছাঁট করেছে। নিজেদের ব্যাঙ্ক রক্ষায় সিরিয়া সরকার ঋণ স্থগিত, ডলার লেনদেন নিষিদ্ধ ও অর্থ উত্তোলন সীমিত করেছে।

অর্থনৈতিক এই ব্যথাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯ মহামারি। জাতিসংঘ বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সিরীয়দের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য স্থায়ী অথবা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। দেশটির সরকার করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত মার্চে লকডাউন জারি করে। কিন্তু খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা বাস্ত্যুচুত সিরীয়রা মহামারির বিধি-নিষেধের মানার চেয়ে জীবন-বাঁচাতে মরিয়া। মহামারিতে মাশুল গুণতে হচ্ছে তাদের; যেটি বর্তমানে পরিষ্কার হয়ে উঠছে।

করোনার প্রাদুর্ভাবের মাত্রা গোপনের চেষ্টা করছে সিরিয়ার ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী। মহামারিতে মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও সরকার এসব মৃত্যু নিউমোনিয়ায় হয়েছে বলে শনাক্ত করতে চিকিৎসকদের নির্দেশ দিয়েছে।

সিরিয়ার সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০০ জনেরও কম মানুষ করোনায় মারা গেছেন। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও কয়েকগুণ বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন। জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী মার্ক লোকক বলেন, আমরা জানি, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ নতুন সংক্রমিতদের উৎস শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দামেস্কে সরকারিভাবে করোনায় মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান দেয়া হচ্ছে সেই সংখ্যা তার ৮০ গুণ বেশি হতে পারে। সেখানে ইতোমধ্যে এই ভাইরাসে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। সরকারের সঙ্গে যাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে তারা হাসপাতালে শয্যা পান। অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা অক্সিজেন ক্যানিস্টার ত্রাণ-সহায়তা করছেন।

অতীতে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার পাশে যারা সহায়তার জন্য দাঁড়িয়েছিল এখন তারা এগিয়ে আসছে না অথবা আসবেও না। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অন্যতম মিত্র ইরান খুব বেশি অর্থনৈতিক সহায়তা করতে পারছে না। কারণ তেহরান নিজেও বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার যাঁতাকলে ধুকছে।

সিরীয় প্রেসিডেন্টের বড় মিত্র রাশিয়ার অবস্থাও করোনা মহামারিতে ভালো নয়। সিরীয়রা বলছেন, রাশিয়া তাদের জন্য চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। নতুন জ্বালানি ও অবকাঠামো নির্মাণ চুক্তির লক্ষ্যে চলতি মাসের শুরুর দিকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ দামেস্ক সফর করেন। সিরীয় প্রেসিডেন্টের অনুগত এক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের রক্ষকরা শকুনে পরিণত হয়েছে।

খাবার এবং ওষুধের জন্য অর্থ সহায়তা পাঠালেও রাজনৈতিক সমাধানে না পৌঁছানো পর্যন্ত সিরিয়া পুনর্গঠনে সহায়তা করতে রাজি নয় আমেরিকা এবং ইউরোপ। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে তার শাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন সমাধানে পৌঁছাতে বাধ্য করার লক্ষ্যে সিরিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

গত জুনে দেশটিতে রেমিট্যান্স পাঠানোসহ বিদেশি মুদ্রা স্থানান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন প্রশাসন। বৈরুত থেকে দুবাইয়ে তাদের ব্যাঙ্কিং কার্যক্রম সরিয়ে নেয়ার আশাও শেষ হয়ে আসে। অনেক সিরীয় প্রবাসে থাকা স্বজনদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল।

প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পরিবার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় অনেক দেশ। দেশটিতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের জন্য ক্ষমতাসীন আসাদ সরকারকেও বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করছে ইউরোপের কিছু দেশ।

জার্মানির একটি আদালতে দুই সিরীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগের শুনানি চলছে। হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়েরের হুমকি দিয়েছে নেদারল্যান্ডস।

তারপরও সিরিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যারা সরকারের বিরোধিতা করেছে, তাদের দমন করছে। বর্তমানে সরকার দেশটির কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কাস্টমসের কর্মকর্তা এবং মিলিশিয়ারা মালবাহী ট্রাক জব্দ করছে। সেগুলো ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের ঘুষ দাবি করছে।

কর সংগ্রহের জন্য রাষ্ট্রের জেনারেল এবং যুদ্ধবাজদের ব্যবহার করছে সরকার। সংগৃহীত করের একটি অংশ আবার তাদের পকেটেও ঢুকছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজের জন্য আসাদ এখন অর্থনীতির বেশিরভাগ লুটপাট করছেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বাশার আল-আসাদের অনুগতরাও। একজন ব্যবসায়ী বলেন, আমি আর নিশ্চিত নই যে, তিনি বেঁচে যাবেন।

প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ কূটনীতিতে বেশি আগ্রহী নন বলে মনে করেন অনেকে। তার এক পারিবারিক বন্ধু বলেন, প্রথম দিন থেকে তার অবস্থানের এই পরিবর্তন ঘটেনি। দুই দশক ধরে ক্ষমতায় থাকার পর সিরিয়ায় আসাদের শাসনব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে স্থিতিশীল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বেতনের চেকের জন্য অনুগত ও সরকারি চাকরিজীবীদের অন্য কোথাও যেতে হয় না। সিক্রেট পুলিশের সদস্যরা দ্রুত বিক্ষোভ দমন করছে, ইদলিবে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী।

আগামী গ্রীষ্মে বাশার আল-আসাদের সাত বছরের মেয়াদ শেষ হবে। সেই সময় দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছেন তিনি। আসাদ এবং তার স্ত্রী আসমা তাদের ১৮ বছর বয়সী ছেলে হাফেজকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছেন; যে একদিন দেশটির ক্ষমতায় যাবে বলে বলা হয়। আসাদের জন্য ক্ষমতায় থাকাটাই বিজয়ের। দ্য ইকোনমিস্ট।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test