E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ঘুম আসে, ঘুম আসে না!

২০১৪ মে ১৩ ১০:৫৫:০৩
ঘুম আসে, ঘুম আসে না!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিখ্যাত জার্নাল নিউরোসায়েন্স-এ প্রকাশিত একটি তথ্যের জেরে ঘুম উড়ে গিয়েছে টেক-স্যাভি মানুষের৷ ঘুমোনোর আগে নাকি ল্যাপটপ নিয়ে বসা যাবে না! সোশ্যাল মিডিয়ায় বাক্যালাপ করা যাবে না! এমনকী আইপ্যাড, আইফোনেও জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা৷ কেন? না, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, অনিদ্রার সব চেয়ে বড় কারণ এরাই! কাজেই শোওয়ার ঘরে এদের ঢোকা বন্ধ করে দিতে হবে৷ শুধু তাই নয়, ঘুম পাড়ানোর আরও এমন সব নিদান দিয়েছেন তাঁরা যা শুনে চোখ কপালে উঠছে তরুণ প্রজন্মের৷ সেই মান্ধাতা আমলের সব নিয়ম, লাইট নিভিয়ে ১০টায় শুয়ে পড়ো, ওঠো সকাল ৫-৬টায়! শরীরে ঘুমের ঘড়ি নাকি এভাবেই সেট করা আছে! আজও৷

ঘুমের ঘড়ি

ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা জেডি মোয়ার ঘুমের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় শুরু করলেন পড়াশোনা৷ কীভাবে সহজে পরিপূর্ণ ঘুম ঘুমানো যায় তা খুঁজতে খুঁজতে তিনি দেখেন ব্রেনে যে ঘুমের ঘড়ি আছে, যে ঠিক করে কখন ঘুমের সময় আর কখন জেগে থাকার, তাকে বোকা বানাতে আলোই হল সব চেয়ে বড় ভিলেন৷ তা সে সূর্যের আলো হোক কি ল্যাপটপ-আইপ্যাডের আলো৷ আলো দেখলেই ঘুমের ঘড়ি ধরে নেয় এটা দিনের বেলা৷ কাজের সময়৷ ফলে ঘুমোনোর জন্য যে যে প্রস্ত্ততি চলার কথা ব্রেনে, তা না হয়ে সে কাজ করার জন্য উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে৷ বারোটা বেজে যায় ঘুমের৷

তিনি তখন শুরু করলেন এক মজার খেলা৷ সূর্য ডোবামাত্র ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন অফ করে, ঘরের লাইট নিভিয়ে, এমনকী ফ্রিজের মধ্যে যে আলো জ্বলে তা পর্যন্ত নিভিয়ে অন্ধকারে বসে গান শুনতে

লাগলেন৷ খানিকক্ষণের মধ্যে অন্ধকার চোখ সয়ে গেল৷ ফলে বাথরু-টাথরুম যেতেও আর আলো জ্বালতে হল না৷ এভাবে কাটল দু-চারদিন৷ তেমন কিছু হল না৷ মধ্যরাত পার করেই ঘুম এল৷ তবে ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘুম নয়৷ সকালে উঠে তরতাজা লাগে এমন ঘুম৷ সপ্তাহ গড়িয়ে যাওয়ার আগেই ঘুমের সময় এগোতে লাগল৷ শেষমেশ দেখা গেল রাত ৯টাতে তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন৷ ৮ ঘণ্টার পরিপূর্ণ ঘুম হচ্ছে তাঁর৷ এবং সকালে যখন উঠছেন, তিনি যেন এক নতুন মানুষ৷ আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যে মানুষকে তিনি ভুলে ছিলেন এত কাল৷ মোয়ারের এই অভিজ্ঞতা ঘুম নিয়ে গবেষণার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল৷ নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর স্লিপ অ্যান্ড সার্কাডিয়ান বায়োলজির ডিরেক্টর ডা জি জানালেন, মোয়ারের অভিজ্ঞতা ও সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে যা জানা যাচ্ছে তা হল, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমিয়ে পড়া ও সঠিক সময়ে জেগে ওঠার যে ছন্দ আছে আমাদের শরীরে, যাকে বলে সার্কাডিয়ান রিদম, ব্রেনে বসে থাকা ঘুমের ঘড়ির হিসেবেই চলা যার ধর্ম, তাকে সত্যিই কিছুটা বোকা বানাতে পারে ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন ইত্যাদি থেকে বিচ্ছুরিত আলোরা৷ কাজেই কারও যদি ঘুমের অসুবিধে থাকে ঘুমের অন্তত দু-ঘণ্টা আগে থেকে এ সব ব্যবহার করবেন না৷

আলোর কারসাজি

অনেকক্ষণ ধরে চোখে চড়া আলো এসে পড়লে চোখের আলোক সংবেদী রিসেপটারগুলি ব্রেনকে বলে পাঠায় যে এখন জেগে থাকার সময়৷ ফলে রাত ৯-১০টার পর থেকে স্বাভাবিক নিয়মে ব্রেনে যে মেলাটোনিন নামে হরমোন তৈরি হওয়ার কথা, যার কাজ ঘুমের ঘড়ির হিসেবে মানুষকে ঘুম পারানো, তার কাজে ব্যাঘাত ঘটে৷ ব্যাঘাত ঘটে ঘুমের৷ বেশি গোলমাল করে নীল রংয়ের আলো৷ যা আছে সূর্যের চড়া আলোয়, আছে ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে, আইফোনে৷ কতটুকু নীল আলোতে কতখানি ঘমের ব্যাঘাত ঘটে তার হিসেব-নিকেশ এখনও সম্পূর্ণ না হলেও, দেখা গিয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টরের উপর ব্যাপারটা নির্ভর করে৷ যেমন-

আলোর উজ্জ্বলতা কী রকম৷

তাতে কী কী রং আছে৷

যেখান থেকে আলোটা এসে পড়ছে তা কত বড়৷

চোখ থেকে কতটা দূরত্বে তা আছে৷

সারা দিন মানুষটি কীভাবে কাটান৷ কোনও চাষী, যিনি সারা দিন রোদে পুড়ে কাজ করেন বা রোদে ঘুরে মার্কেটিং করা যাঁর কাজ তাঁদের তুলনায় অফিসে কৃত্রিম ও কম আলোয় বসে যিনি কাজ করেন, তাঁর আলোর প্রতি সেন্সিটিভিটি অনেক বেশি থাকে বলে ঘুমের সমস্যাও তাঁরই বেশি হয়৷

সমাধান

যদি আপনার ঘুমের সমস্যা থাকে এবং ল্যাপটপ, স্মার্টফোন শোয়ার সময়ও কাছ ছাড়া করতে না চান, কয়েকটি সমাধানের কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা, করে দেখতে পারেন৷ যেমন-

ল্যাপটপে বা স্মার্টফোনে কাজ করার সময় কমলা রঙের সানগ্লাস পরে নিন৷ নীল আলোর এফেক্ট কেটে যাবে৷

ল্যাপটপ বা আইপ্যাডের স্ক্রিন সেটিংটা এমনভাবে বদলে নিন যাতে রাত্রে কাজ করার সময় আলোর উজ্জ্বলতা কমার পাশাপাশি নীল আলোকেও সরিয়ে দেওয়া যায়৷

এফ লাক্স নামের প্রোগ্রাম ফ্রিতে ডাউনলোড করে নিতে পারেন৷ এতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে নিজে থেকেই কম্পিউটার বা ফোনের স্ক্রিন থেকে নীল আলো কমতে শুরু করবে৷ তবে হ্যাঁ, বিজ্ঞানীদের মতে, এত কিছুর পরও যে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন, এমন নাও হতে পারে৷ নীল আলোকে না হয় ঠেকালেন, কিন্ত্ত এই যে কাজ করতে করতে ঘুমের ফোকাস হারিয়ে যাচ্ছে, তাকে কীভাবে ঠেকাবেন?

ঘুম ও ফোকাস

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া লসএঞ্জেলেস-এর স্লিপ সায়েন্টিস্টদের মতে ঘুমের ব্যাপারটা অত সহজে নয় মোটেই, যে কেবল আলোকে দোষারোপ করে পার পাবেন৷ কমলা চশমা পরে নিলেন ঠিকই, কিন্তু যতক্ষণ ঘুম না এল ফেসবুকে চ্যাট করে গেলেন বা প্রজেক্টের কাজ করলেন কিম্বা রিল্যাক্সড হতে ডাউনলোড করে সিনেমাই দেখতে বসে গেলেন, আর এই ফাঁকে যে নতুন নতুন তথ্যের ভারে ব্রেন ক্লান্ত হয়ে ঘুমের তোরজোর করার বদলে আরও চাঙা হয়ে উঠল, তার খবর পেলেন না৷ কাজেই বিজ্ঞানীদের মতে, আলোর ব্যাপারটা তো মাথায় রাখতে হবেই, কিন্তু তার সঙ্গে ঘুমের আগে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে ঘুমের ফোকাস বিঘ্নিত হয়৷ এই ব্যাপারটা অবশ্য একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম৷ তবু মোটের উপর একটা নিয়ম আছে, যা মেনে চললে ঘুমের কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটি দুই-ই ভালো হতে বাধ্য, যাদের একযোগে বলে স্লিপ হাইজিন৷

স্লিপ হাইজিন

ঘুমের বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকে রিল্যাক্সড হতে হবে৷ সে আপনি উষ্ণ জলে স্নান করে হোন, কী মজার বই পড়ে বা হালকা পায়চারি করে৷ অনেকে গান শুনে মাথার ভার লাঘব করেন, কেউ মজার সিনেমা দেখে, কেউ বা পর দিনের রুটিন ঠিক করে ঝাড়া হাত-পা হয়ে শুতে যাওয়া পছন্দ করেন৷ যাতে আপনার স্ট্রেস রিলিফ হয় তাই করুন ঘুমের কিছুক্ষণ আগে থেকে৷ বুঝতেই পারছেন, ঘুমোনোর আগে নিয়মিত জটিল কাজকর্ম করলে তা ঘুমের জন্য সহায়ক হবে না একেবারেই৷

ই-বুক পড়ার চেয়ে এমনি বই পড়া ঘুমের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো৷ কারণ সাধারণ বই পড়লে যে পরিমাণ আলো চোখে এসে পড়ে, ই-বুকের ক্ষেত্রে চোখে আরও জোরদার আলো এসে পড়ে৷

ঘুমের আগে টিভি না দেখাই ভালো৷ দেখতে হলে টিভি সেট-এর দূর থেকে দেখুন৷ ল্যাপটপে ডাউনলোড করে দেখতে আলোর জন্য সমস্যা হতে পারে৷

বিকেলের পর থেকে চা-কফি-কোলা খাবেন না৷ অতিরিক্ত সিগারেটেও ঘুমের অসুবিধে হতে পারে৷

সন্ধের পর ভারী ব্যায়াম না করাই ভালো৷

বেডরুমকে কাজের ঘর বানিয়ে ফেলবেন না৷ চাদর-বালিশ-গদি-ঘরের তাপমাত্রা সব কিছু যেন পছন্দসই ও আরামদায়ক হয়৷ রাত্রে হালকা খাবার খান, ঘুমোনোর ঘণ্টা দুয়েক আগে৷

রোজ সকালে মোটামুটি একই সময় ওঠার চেষ্টা করুন৷

ঘুমের অসুবিধে থাকলে দিনের বেলা ঘুমাবেন না৷

স্লিপ হাইজিন মেনেও ঘুম না হলে ঘুমের ওষুধ না খেয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন৷ কারণ ওষুধ খেয়ে ঘুমোলে ঘুমের কোয়ান্টিটি বাড়লেও কোয়ালিটি ভালো হয় না কখনওই৷ প্রয়োজনে স্ট্রেস ম্যানেজ করান৷ কারণ অনিদ্রার সবচেয়ে বড় কারণ হল স্ট্রেস৷

(ওএস/এইচ/মে ১৩, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test