E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি !

২০১৪ মার্চ ০৭ ১০:৩৪:৫০
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি !

বজলুর রশীদ : সারারাত চাকরি শেষে সকালে বাসায় ফেরার জন্য যখন বাসে উঠি, চেষ্টা করি একটা পত্রিকা নিয়ে উঠতে। ‘মেট্রো’ ও ‘টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স’ দু’টি দৈনিকই ফ্রি। আমি মেট্রো পছন্দ করি। ২০০৮-এর ফেব্র“য়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ। সেদিনও বাসে বসে মেট্রোর পাতা উল্টাচ্ছিলাম। চোখে পড়ল ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন। অন্টারিও সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৯ মাসের ‘অটোমোটিভ প্রি-এপ্রেন্টিসশিপ’ প্রোগাম। সেন্টেনিয়াল কলেজে মার্চে শুরু। চলবে টানা ডিসেম্বর পর্যন্ত।

শেষের ৩ মাস কো-অপ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে যাদের চূড়ান্ত করবে, সরকার তাদের পড়াশোনার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবে। বিজ্ঞাপনটা আমার ভীষণ মনে ধরল। এ ধরনের ফ্রি পড়ার সুযোগই আমি খুঁজছিলাম। বাসায় ফিরে সেদিন আর ঘুম হলো না, কাগজ-পত্র রেডি করে ছুটলাম কলেজে। লিমা যে কলেজে পড়াশোনা করছে সেই একই কলেজ তবে ভিন্ন ক্যাম্পাস। কলেজটা আমার ভীষণ পছন্দ। এর আগেও দুয়েকবার ঢুঁ মারার সুযোগ হয়েছে। দারুণ কো-অপারেটিভ মনে হয় সবাইকেÑ বিশেষ করে শিক্ষকদের। লিখিত পরীক্ষার ডাক এলো ফেব্র“য়ারির শেষ সপ্তাহে। ছেলেমেয়ে মিলে ৫শ’র মতো এপ্লিক্যান্ট। নেবে মাত্র ৩০ জন। পরীক্ষার বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল গণিত। আর এতেই আমার রক্ষা! আমার কাছে মনে হয়েছে এখানকার পোলাপানরা অংকে কাঁচা। এরা শুধু ফটাফট ইংরেজি বলতে পারে এই যা! লিখিত পরীক্ষায় আমি উৎরে গেলাম। এবার মৌখিক পরীক্ষা। আমার কনফিডেন্স বাড়ছে। মনে হচ্ছে আমি এখানেও টিকে যাব। ভেতরে বসা দু’জন। একজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, অন্যজন এ প্রোগামের কো-অর্ডিনেটর, নামÑ গ্রাহাম স্প্যারো। তিনিই আসলে এ প্রোগ্রামের মূল ব্যক্তি। তারা একজন করে ডাকছেন। আমরা লাইন দিয়ে বাইরে বসে আছি। এক সময় আমার ডাক এলো। মূলত গ্রাহাম স্প্যারো’ই সব প্রশ্ন করছেন। আমার হোম কান্ট্রি বাংলাদেশ শুনে গ্রাহাম খানিকটা হতচকিত হয়ে উঠলেন দেখলাম। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই বলা শুরু করলেন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সৈনিক। ওই সময় বাবার সাথেই তাকে বেশ কিছুদিন চট্টগ্রামে থাকতে হয়েছে। কী অদ্ভুত! শৈশবের স্মৃতি তাও মাত্র ক’দিনের; আজও তাকে কেমন আনমনা করে তুলছে। গ্রাহামের কাছ থেকেই শুনলাম লিখিত পরীক্ষার গণিত অংশটুকুতে আমি খুবই ভালো করেছি। আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে পরের সপ্তাহ থেকে ক্লাস শুরু করার জন্য প্রস্তুত হতে বলে দিলেন। বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর তিন সপ্তাহের মধ্যে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ। ২০০৮ সালের মার্চের ১০ তারিখ থেকে আরেক অধ্যায় আমার শুরু হলো। সেলেস্টিকার চাকরি তখনও ছাড়িনি। ছাড়িনি এই ভেবে যে, গাড়ি-ঘোড়া সম্পর্কে আসলে আমার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই; শেষ পর্যন্ত এ প্রোগ্রাম কতদূর চালিয়ে নিতে পারব-ভরসা পাচ্ছি না। সেলেস্টিকায় সারারাত কাজ শেষে সেন্টেনিয়ালে দিনের বেলায় ক্লাস। ক’দিনের মধ্যেই আমার অবস্থা কাহিল। দুটোর যে কোনো একটা ছাড়তেই হবে। শেষ পর্যন্ত সেলেস্টিকাকে বিদায় জানিয়ে পুরোদস্তুর অটোমোটিভের ছাত্র হয়ে গেলাম।

লিমার ৪ সেমিস্টারের প্রথম সেমিস্টার এপ্রিলে শেষ হলে আমাদের পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হলো। সিদ্ধান্ত হলো- বাকি ৩ সেমিস্টার লিমা পার্টটাইম পড়বে, পাশাপাশি চাকরি করবে। আমি ফুলটাইম পড়াশোনা করব। সে মতো লিমা শুরু করল চাকরি খোঁজা। ইন্টারনেটে হরদম বায়োডাটা পোস্ট করছে। দুই মাস পার হতে চলল। কোথাও থেকে ডাক আসে না। আমরা ক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছি। আমাদের সঞ্চিত যে অর্থ, তা প্রায় শেষের পথে। অগত্যা আমি সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করলাম। কলেজ শেষে কোনোদিন বাসায় ফিরি, কোনোদিন সোজা চলে যাই কাজে। এখানে সামারে রেস্টুরেন্টগুলোতে প্রচুর লোক হায়ার করা হয়। এসব মূলত সিজনাল জব। শীতের শুরুতে এসব রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। সবাইকে বেকার হয়ে যার যার মতো বাড়ি ফিরতে হয়। আমি যে রেস্টুরেন্টে কাজ করি, তা একেবারে লেকের ধারে। দারুণ এক মনোরম জায়গায়। ইতালিয়ান এই রেস্টুরেন্টের ‘সেফ’ একজন সিলেটী ভদ্রলোক। সেফ রেস্টুরেন্টের প্রধান ব্যক্তি। তার হাতেই থাকে হায়ার-ফায়ারের ক্ষমতা। আয়-ইনকামও তার বেশ ভালো। আমি ছিলাম হেলপার। যেখানে যার সাহায্য লাগত, আমি ছুটে যেতাম সেখানে। বিকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত আমার ডিউটি। বাসায় ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। পরের দিন সকাল সাড়ে ৭টায় আমার ক্লাস শুরু। সাড়ে ৭টার এক মিনিট দেরি মানে ওই ক্লাস মিস। ১০ মিনিট আগেই ক্লাসরুমে চলে আসেন শিক্ষক। ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে ৭টা বাজলেই ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে দেন। কোনো উপায় নেই আর ভেতরে যাওয়ার। লেখাপড়া এখানে ভীষণ কঠিন। ফাঁকির কোনো বালাই নেই। শিক্ষা-কারিকুলাম এমনভাবে করা হয়েছে, সবকিছুর গভীরে গিয়ে জানতে হবে, শিখতে হবে। ১০০’র মধ্যে ৬০ নম্বরে পাস। ৫৯ পেলেও ফেল। ফলে সারাক্ষণ এক ধরনের আতংকে থাকতাম, এই বুঝি না আবার ফেল হয়ে যায়!

এরমধ্যে লিমার একদিন ডাক এলো। ওর সাবজেক্ট রিলেটেড জব। ও ইন্টারভিউয়ে ভীষণ ভালো করেছে। বোর্ডের সবাই খুশী। একটা নার্সারি স্কুলে এসিস্টেন্ট টিচার। বাসা থেকে বাসে-ট্রেনে এক ঘণ্টার রাস্তা। ২০০৮-এর ৭ জুলাই লিমা যোগ দিল নতুন চাকরিতে। এরমধ্যে সপ্তাহে ৩ দিন সন্ধ্যায় তাকে কলেজেও যেতে হয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তার ক্লাস। যে সন্ধ্যায় তাকে কলেজে যেতে হয়, সেদিন কাজ শেষে তার আর বাসায় ফেরা হয় না, সরাসরি চলে যায় কলেজে, বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১১টা। কলেজের প্রধান ক্যাম্পাসে তার ক্লাস, সেটি আমাদের বাসা থেকে বেশ দূরে, আমারটা ১৫/২০ মিনিটের রাস্তা। পার্ট-টাইম প্রোগ্রাম সব মেইন ক্যাম্পাসে। দেখতে দেখতে আমার কো-অপের সময় চলে এসেছে। কলেজ থেকে একেকজনকে একেক ডিলারশীপে পাঠানো হচ্ছে। আমাকে পাঠানো হলো ডাউন্সভিউ ক্রাইসলারে। জায়গাটার নাম ডাউন্সভিউ। আমাদের বাসা থেকে ট্রেনে প্রায় সোয়া ঘণ্টার রাস্তা। এখানকার ট্রেন ভীষণ দ্রুতগামী। সেই হিসাবে অনেক দূরের রাস্তাই আসলে। ঢাকা-কুমিল্লার দূরত্ব বলা যায়। আমি গেছি কো-অপের জন্য, আমার হয়ে গেল চাকরি। আমি তো হতভম্ব! এ কী। এতো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test