E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভালো থাকবেন প্রবীর দা

২০১৪ সেপ্টেম্বর ০১ ১০:৫৫:৩০
ভালো থাকবেন প্রবীর দা

ফজলুল বারী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীন সফরে গেলেন প্রিয় প্রবীর শিকদার। শুনে খুব ভালো লাগলো। মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সন্তান প্রবীর দা। শৈশবে বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর শহীদ জায়া মা'কে সাপোর্ট দিতে অনেক কাজ করেছেন। সঙ্গে পড়াশুনা। জনকন্ঠের ফরিদপুর প্রতিনিধি থাকতে তার সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা। রাজাকার মুসা বিন শমসেরকে নিয়ে রিপোর্ট করার পর তার ওপর হামলা হয়। ফরিদপুরে মুসা বিন শমসের লুলা মুসা নামে পরিচিত। প্রবীর শিকদারের রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ ছিল।

এরপরই তার ওপর হয় আক্রমন! বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফরিদপুর শহরে যাবার পথে রাস্তায় মোটর বাইকের গতিরোধ করে গুলিতে তাকে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়! জনকন্ঠে খবর আসে মুমুর্ষ প্রবীর শিকদারকে নিয়ে ঢাকা রওয়ানা হয়েছেন ফরিদপুরের সাংবাদিক মুন্সি হারুন। খবর পেয়ে অফিসে তার কক্ষে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তোয়াব খান। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার প্রবাদ প্রতীম স্বরূপ মানুষ একজন। জনকন্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক। তোয়াব ভাই আমাকে বললেন, ভালো করে রিপোর্ট করবে। আর আজ থেকে প্রবীর শিকদারের চিকিৎসার দেখভাল করবে তুমি। জনকন্ঠে এমন ঢাকার বাইরের কোন সাংবাদিক আক্রান্ত, বিপদে পড়লে তাদের দেখভালের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হতো। এমন কাজ করতে ভালোও লাগতো। অফিসে এমনিতে মফ:স্বলের সাংবাদিকরা খুব উপেক্ষিত। এই সুযোগে যদি তাদের জন্য কিছু করা যায়। কিন্তু কাজটা সহজ ছিলো না। পথে প্রবীর শিকদারের অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটায় ঢাকায় ঢুকে প্রথম হাসপাতাল পেয়ে সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালেই ঢুকে পড়ে তাকে বহনকারী এম্বুলেন্স! এটি মূলত হূদরোগ চিকিৎসার হাসপাতাল। কিন্তু অন্য অনেক রোগের বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা সেখানে আছে। সোহরাওয়ার্দির চিকিৎসকরাও খুব যত্ম করে তাকে রিসিভ ও চিকিৎসা শুরু করে দেন।

হাসপাতালে তার জরুরি প্রয়োজন মেটানোর ফাঁকে ফাঁকে তার সঙ্গে কথা বলে প্রথম রিপোর্টের মাল-মসল্লা জোগাড় করে ফেলি। রিপোর্ট লিখতে অফিসে ফিরে সেটি লিখে জমা দিয়ে আবার ছুটে যাই হাসপাতালে। সেখানে সর্বক্ষনিক তার পাশে ফরিদপুরের সিনিয়র সাংবাদিক মুন্সি হারুন। এমন সহযোগী মানুষ বিরল আজকের সমাজে। কিন্তু হাসপপাতালের দ্বিতীয় দিনেই একটি দু:সংবাদ দেন ডাক্তাররা! জীবন বাঁচাতে গুলিতে ঝাঁঝরা প্রবীর শিকদারের একটি পা কেটে ফেলতে হবে। পরিস্থিতি আমাকে বুঝিয়ে প্রবীর দা'র সম্মতি নিতে বলা হয়। কঠিন এক দায়িত্ব! একটা মানুষ সারাজীবনের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে যাবে! আমি ডাক্তারদের সঙ্গে একটু বার্গেনের চেষ্টা করি। কোনভাবে তার পা'টা রক্ষা করা যায় কিনা! কিন্তু আমাকে বলা হয় জখম পায়ের কারনে প্রবীর দা'র কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে না! সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে আরও বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে। প্রবীর শিকদার আর মুন্সি হারুন ভাইর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করি। সংগ্রামী মানুষ প্রবীর শিকদার। ঠান্ডা মাথায় বলেন, ডাক্তাররা যা ভালো মনে করেন তা তাদের করতে দিন। আমি দেখি বোদির চোখ গড়িয়ে পানি ঝরছে। চোখের সামনে সারাজীবনের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে তার স্বামী! অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় প্রবীর দা'কে! সারাজীবনের জন্য হারিয়ে যায় তার একটি পরিচয়!

স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিরুদ্ধে রিপোর্টিং যুদ্ধে এভাবে তিনি উৎসর্গ করেন নিজের স্বাভাবিক জীবন! সেদিনের সেই রিপোর্টটি লেখার সময় আমার চোখ জলে ভিজেছে। এরপর থেকে ধারাবাহিক চলতে থাকে রিপোর্ট। অফিস থেকে সব সাপোর্ট পাচ্ছি। শুধু হাসপাতালে তার চিকিৎসার জরুরি আর্থিক বিষয়াদি ছাড়া! রিপোর্ট পড়ে পড়ে হাসপাতালে অনেকে প্রবীর দাকে দেখতে আসেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও আসেন দেখতে। প্রবীর দাকে তখন সোহরাওয়ার্দি থেকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে সময় সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন আরেক আক্রান্ত সাংবাদিক। ফেনীর টিপু সুলতান। ফেনীর গড ফাদার জয়নাল হাজারী বাহিনী তাকে কুপিয়ে মুমুর্ষ করে ফেলে রেখে গিয়েছিল! তার পাশে দাঁড়ানোর বদলে আওয়ামী লীগ উল্টো বিষোদগার করছিল তার বিরুদ্ধে! ওই অবস্থায় মোহাম্মদ নাসিমকে বুঝিয়ে প্রবীর শিকদারকে দেখার পর তাকে নিয়ে গেলাম টিপুর শয্যা পাশে। খুব ভালো লেগেছিল সেদিন। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে আমাদের অনুরোধে প্রবীর শিকদারকে আবার নিয়ে আসা হয় সোহরাওয়ার্দিতে। ওই সময় তাকে দেখতে আসেন ড. কামাল হোসেন। প্রবীর দার হাতে তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। মুন্সি হারুন ভাইর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীও বেশি কিছু টাকা পাঠান। ওই বিপদের সময় ওই টাকাগুলো খুব কাজে দিয়েছিল। এরপর বড় একটি সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নত চিকিৎসা, কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য প্রবীর শিকদারকে তিনি সিঙ্গাপুর পাঠান। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের ক্ষমতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে একজন বিপদগ্রস্ত শহীদের সন্তানের জন্য তিনি দায়িত্বটি পালন করেন। প্রবীর শিকদারের হাতে চিকিৎসার চেক, বিমানের টিকেটের টাকা তুলে দেবার অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে গণভবনে আমারও ডাক পড়েছিল। মূলত জনকন্ঠে আমাদের লেখা আর শেখ হাসিনার দেয়া টাকাতেই তার এভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাটি হয়েছিল। তার সিঙ্গাপুর থাকতেও সেখানে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে চলতে থাকে রিপোর্ট।

সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর প্রবীর শিকদারকে নিয়ে গেলাম তোয়াব খানের কাছে। যে মানুষটি এর আগে সুস্থ মানুষ হিসাবে জনকন্ঠে এসেছেন, সে বার তিনি নকল পায়ে আর ক্রেচে ভর দিয়ে আসেন! তোয়াব ভাইকে বললাম যারা প্রবীর শিকদারকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, ফরিদপুর ফিরে গেলেতো তারা তাকে আস্ত রাখবে না। এর চাইতে যদি তাকে ঢাকায় জনকন্ঠ অফিসে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতেন! তার জীবনটাও বাঁচতো। ইন্টারকম উঠিয়ে তিনি সম্পাদক আতিক উল্লাহ খান মাসুদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন। মাসুদ সাহেবকে বলেন, প্রবীরকে আমি আমাদের মফ:স্বল ডেক্সে নিয়ে নিতে চাই। রিসিভার রেখেই তিনি আমাকে বলেন তোমার ইচ্ছা পূরন হয়েছে। প্রবীরের চাকরি হয়ে গেছে। যাও তাকে নিয়ে গিয়ে সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে দেখা করো গিয়ে। কৃতজ্ঞতায় আমার সেদিন চোখ ভিজেছে। তোয়াব খানের কাছে এমন যখন যা চেয়েছি আমি তাই পেয়েছি।

সেই প্রবীর শিকদার এরপর ফরিদপুর থেকে ঘুরে এসে ঢাকায় জনকন্ঠ অফিসে কাজে যোগ দেন। ফলোআপের জন্য তাকে আবার একবার ফরিদপুর পাঠানো হয়। এরপর আবার আমি বিদেশ চলে আসলে তিনি জনকন্ঠ ছেড়ে যোগ দেন কালের কন্ঠে। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগটি ছিল। কেন তিনি কালের কন্ঠে চলে গেলেন, তাও সবিস্তার বলেছেন। কিছুদিন আগে ফেনীর ফুলগাজীর উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুলকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর তাকেও একইভাবে হত্যার হুমকি দেয় যুদ্ধাপরাধীদের দল। আমাকে বার্তাটি পাঠিয়ে বলেন, বিপদে পড়লেই তো আপনার কথা মনে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে লেখার সময় বের করতে পারিনি। এর মাঝে আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসাবে তিনি চীন যাচ্ছেন শুনে খুব ভালো লাগে। এর মাধ্যমে যারা আবার তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে তাদের প্রতি একটা বার্তা যাবে। নির্যাতিত সাংবাদিকদের এভাবে বিদেশ ট্যুরে সফরসঙ্গী করার মাধ্যমে নতুন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধন্যবাদ প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। অনেক অনেক ভালো থাকবেন প্রবীর দা।

লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test