E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দূর কোনো এক পরবাস থেকে শচীনদেব স্মরণে

২০১৪ সেপ্টেম্বর ৩০ ১৮:৪৭:৩৯
দূর কোনো এক পরবাস থেকে শচীনদেব স্মরণে

প্রবীর বিকাশ সরকার : শচীন দেববর্মণের গান যখন কালেভদ্রে কোনোখান থেকে ভেসে আসে তখন নড়েচড়ে বসি। কেননা শচীনদেব বলে কথা! তিনি কিংবদন্তীতূল্য বাংলার আধুনিক সঙ্গীতের ইতিহাসে। যিনি নাড়িয়ে দিতে জানেন বা দেন তাঁর শক্তি কতখানি পরিমাপ করা মুশকিল!

শচীনদেবের গানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় কলেজ জীবনে যখন ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের আইএ শ্রেণীর ছাত্র তখন। যখন বিদেশি পপ-রক গান শুনছি তখন অন্যস্বাদ গ্রহণের জন্য অন্বেষণ করতে গিয়ে একদিন এক পাড়াত দাদার কণ্ঠে একটি গান শুনে চমকে গেলাম ভীষণ! তিনি প্রায়শ মাতাল হয়ে রাতে বাড়ি ফিরতেন। আমাদের পাশের বাড়িটিই তাদের। একদিন রাতেরবেলা পথ আটকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, সেদিন যে গানটি গাইলেন ‘জ্বালায়ে চান্দের বাতি / জেগে রব সারারাতি গো’.........এটা কার গান? দারুণ গান!’

পরিমলদা তখন আমার কাঁধে হাত রাখলেন। এবং যথারীতি টলতে লাগলেন। মুখের ভেতর থেকে তেলিপাড়ার মুচিদের তৈরি চোলাই মদের গন্ধ। আমার প্রিয় গন্ধ। কারণ ওই এলাকার বন্ধুদের সঙ্গে আমিও টানি। তিনি থমকে কয়েক মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর নেশার ঘোরে জড়িয়ে জড়িয়ে রাগাত স্বরে বললেন, এ্যাঁ! এই তোর কবিতাচর্চা! এই তোর কাব্যচর্চা! তুই কি থাকিস এই শহরে! জানিস এই কুমিল্লা জেলা ভারতখ্যাত বিখ্যাত সব সঙ্গীতজ্ঞদের জন্মস্থান! এ্যাঁ! তুই আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস! তুই কবি হয়েও জিজ্ঞেস করছিস এটা কার গান! তুই মোটেই রোমান্টিক নন। তুই.....তুই কিছুই না........।’

জানি পরিমলদা বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন দি হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকার, পরে ঢাকার অবজারভার পত্রিকার। জাঁদরেল সাংস্কৃতিক মানুষ। তাঁর বয়স আমার চেয়ে সাড়ে তিনগুণ বেশি। কিন্তু শান্ত ভদ্র তাঁর সঙ্গে পাড়ার সবাই অবশ্য অত ঘনিষ্ঠ নন। বিয়ে করেননি একাই থাকেন। পুরনো টিনশেডের এক বড় বাড়িতে। প্রায়শ মিহি সুরে তাঁর ঘর থেকে বিভিন্ন ধরনের গান ভেসে আসে রাতের বেলা।


পরিমলদা এভাবে চটে যাবেন ভাবতে পারিনি। দিনের বেলা একরকম আর রাতেরবেলা আরেক রকম হয়ে যান সেটা জানতাম। অনেকের মুখেই শুনেছি। কান্দিরপাড়ে তাঁদের বেশ কয়েকজন প্রবীণ পণ্ডিতদের আড্ডা হয় এক বনেদী হিন্দু বাড়িতে। সেখানেই তাসখেলা, পাশাখেলা আর মালটানা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। একবার পাড়ারই আরেক দাদা শ্যামলদাকে খুঁজতে গিয়ে ওই বাসায় গিয়েছিলাম।

যাহোক, পরিমলদাকে হাত জোড় করে বললাম, ক্ষমা চাইছি দাদা। রাতে নয় দিনের বেলা জিজ্ঞেস করব। এখন আপনি বাড়ি যান, আমিও ধর্মসাগর পাড়ে বসে সারারাত আড্ডা মারব।

এই বলে যেই আমি ছুটে পালাতে যাব, অমনি খপ করে ডান হাত চেপে ধরলেন! আরে বাবা কী শক্তি তার হাতে! হাত তো নয়, সাঁড়াশি যেন! গর্জে উঠলেন, ‘ঠিক বলেছিস। এখন আমি গিয়ে গান শুনব। শচীন কর্তার গান। আরে পোলা, এটা শচীন দেববর্মণের গান! শুনিসনি বুঝি? কী গান শুনিস তোরাই জানিস! বাসায় আসিস শুনিয়ে দেব একেবারে গ্রামোফোনে। সেইসব রেকর্ড আমার কাছে আছে ‘ বলে হাত ছেড়ে দিয়ে টলতে টলতে চলে গেলেন।

সেই প্রথম শচীন দেববর্মণ নামে যে একজন শিল্পী, সুরকার এবং সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন এবং তাঁর জন্ম এই কুমিল্লা শহরে তা জানলাম পরিমলদার কাছেই! পরের দিনই বিকেলবেলা হাজির হলাম তাঁর বাসায়। নারকেল গাছের নিচে তাঁর ছিমছাম সুনসান নির্জন বাড়ি। তিনটি কক্ষে ডিগ্রি কলেজের ছয় জন ছাত্র ভাড়া থাকে। আর দুটি কক্ষ নিয়ে পরিমলদা। বইপত্র, ম্যাগাজিন, পত্রিকা, কাপড়চোপড়ে একাকার! দুটো প্রাচীন আলমারি ভর্তি পুরনো সব গ্রন্থ। টেবিলের চারপাশে বই আর এলপি রেকর্ডের স্তুপ। ধুলোবালিতে সযলাব। একটি বড় পালঙ্কে ঘুমান। তাঁর রান্নাবান্নার দরকার হয় না কারণ পাড়াতেই ছোটবোন থাকে সেখানে দুপুরে খেয়ে নেন। রাতের বেলা কোথাও থেকে খেয়ে বাড়ি ফেরেন। কে জানে ওই আড্ডার বাড়িতেই খেয়ে আসেন কিনা। মাঝেমাঝে অবশ্য দেখতাম তাঁর বোন সুমিতাদি পয়পরিষ্কার করে ময়লা আবর্জনা বাইরে ফেলছেন আর বিড় বিড় করে কীসব বলছেন।


যে যাক, পরিমলদা আমাকে দেখে বিছানা থেকে উঠলেন। গ্রীষ্মের বিকেল। ঘামছেন। খালি গা। ভুড়ি তেমন নেই তাঁর। ফর্সা ধবধবে শরীর। বললেন, ‘এসেছিস। দাঁড়া চাপিয়ে দিচ্ছি।’

অনেক পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ড বাজানোর মেশিন। ঘরের এক কোণে টেবিলের ওপর রাখা কাপড় দিয়ে ঢাকা। রেকর্ডের স্তুপ থেকে একটি রেকর্ড হিস মাস্টার্স ভয়েস বের করে গামছা দিয়ে মুছে চাপিয়ে দিলেন। প্রথমে রেকর্ড এর গ্যাস গ্যাস শব্দ তারপর যখন গানটি বাজল আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল! অদ্ভুত এক নাকিসুরে চওড়া গলায় এমন অদ্ভুত কথায় যিনি গানটি গাইছেন তিনি শচীন দেববর্মণ! এমন ব্যতিক্রম গান মা জন্ম দেয়ার পর এই প্রথমবার শুনলাম। এককথায় পাগল হয়ে গেলাম! মুখস্থ করে বন্ধুদের শোনাতে হবে। কয়েকবার শুনলাম এবং লিখে নিলাম। পরিমলদা সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে মুচকি হেসে আমার কাণ্ডকারখানা দেখলেন।

যথারীতি শক্তি ঔষধালয়ের মৃতসঞ্জীবনী সুধা খেয়ে মাতাল হয়ে আড্ডায় বন্ধুদের গানটি গেয়ে শোনালাম। সবাই চুপ! গান শেষ হলে পরে সবাই সমস্বরে বলল, ‘দোস্ত। জব্বর গান! কোথায় শিখলি?’

তারপর প্রায়শ আমি গানটি গেয়ে শোনাতাম বন্ধুদেরকে। যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র হঠাৎ করেই একটি মেয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে কুমিল্লায় ঘটনাচক্রে। বয়স বিংশতি। অসম্ভব গানপাগল ছিল মেয়েটি। কত আনকমন গান যে তার সংগ্রহে ছিল বলে বিশ্বাস করানো কঠিন! তার কাছ থেকেই আমি জীবনে প্রথম আনকমন সব শিল্পীর গানের ক্যাসেট উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। তার মধ্যে শচীন দেববর্মণের একটি ক্যাসেট।

শচীনদেবের অনেকগুলো গান তাতে ছিল। আমার ছিল একটি ছোট্ট ক্যাসেট প্লেয়ার। তাতে রাত জেগে জেগে গান শুনতাম। শচীনদেবের বেশ কয়েকটি গান আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। আলাওল হলে ভু্ইল্যা টেনে মাতাল হয়ে সেসব গান একাই গাইতাম কখনো হলের বারান্দায় বসে, কখনোবা শহীদমিনার চত্বরে। নির্জন সবুজঘেরা ক্যাম্পাসে পূর্ণিমার রাতে কী অসাধারণ লাগত গানটা! মনপ্রাণকে ডুবিয়ে চুবিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। মেয়েটিকে খুব অনুভব করতাম।


১৯৮৪ সাল। আমি জাপানে চলে আসব। মেয়েটির সঙ্গে আমার সাময়িক বিচ্ছেদ হবে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। কিছুই ভালো লাগত না আমার। কেবল ঘুরে ফিরে একটি গান আমাকে উদভ্রান্ত করে তুলল। সেটিও শচীনদেবেরই বিখ্যাত একটি গান: ‘দূর কোন্ পরবাসে / তুমি চলে যাইবারে / বন্ধুরে / কবে আইবারে.........।’ কী যন্ত্রণা কাউকে বুঝিয়ে বলার মতো নয়। কী অদ্ভুত হন্তারক একটি গান আমার সমস্ত শান্তি সূখ হরণ করে নিল। ওদিকে মেয়েটিরও একই অবস্থা। বিরহ শুরু না হতেই বিরহের যন্ত্রণা আমাদেরকে আচ্ছন্ন করা শুরু করল। মনে হল এই গানটি যেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আমাদের দুজনের কথা চিন্তা করেই লিখেছেন। আর শচীন দেববর্মণ তাঁর সমস্ত সুধা ঢেলে এই গানটি গেয়েছেন। দারুণ নির্মম গান কিন্তু অপূর্ব কম্পোজ! সারেঙ্গীর কী তীর্যক টান!


জাপানে আসার সময় আমি ক্যাসেটগুলো নিয়ে এসেছিলাম। শচীনদেবের ‘দূর কোন্ পরবাসে’ যতবার শুনেছি কেঁদে একাকার হয়েছি। তারপর ব্যস্ততম দেশের ব্যস্ততায় ভেসে গেছি একসময়। সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে মেয়েটির সঙ্গে। শচীন দেববর্মণকেও বিস্মৃত হয়ে গেলাম।

১৯৯২ সালে আমি কুমিল্লা যখন ফিরে যাই ছুটি নিয়ে তখন পূর্বচর্থার জুন্মন নামের একটি ছেলেকে আমার ছোটভাই পরিচয় করিয়ে দিল। সে আমাকে নিয়ে গেল শচীন দেববর্মণের পৈত্রিক বাড়িটিকে দেখাতে। বলল, ‘আপনার মানচিত্র পত্রিকায় লিখুন। দেখুন এই সাংস্কৃতিক সম্পদটির কী অবস্থা! এটা এখন সরকারি হাঁসমুরগির খামার! ভাবা যায় এটা কোনো সভ্য জাতির দেশে!!’

তখন আমার নতুন করে শচীন দেববর্মণকে মনে পড়ল। মেয়েটিকেও মনে পড়ল। কিন্তু সে তখন নেই এই শহরে। শহর বদল করে ঢাকায় চলে গেছে। দেখা হল না। বরং দেখা হল শচীনদেবের জন্মনেয়া বাড়িটি। দেখে আমি দারুণ বেদনাহত হলাম! এত বড় একজন শিল্পীর জন্মভিটার এই অবস্থা!!! দুচোখ ফেটে জল এলো আমার। টোকিওতে ফিরেই একটি ফিচার লিখেছিলাম আমার পত্রিকায় ছবিসহ। তথনো বাড়িটির ভাঙা দরজা জানালা ছিল। কিন্তু গত বছর দেখলাম সেসবও খুলে নিয়ে গেছে কারা। সরকারি হাঁসমুরগির খামারের লোকজনও তা জানে না। হায় কী জাতি এই বাঙালি!! আপন সাংস্কৃতিক প্রতিভাবানদের এরা মূল্য দেয় না, বিদেশিদের কী মূল্য দেবে?

যে বাড়ি থেকে একদিন শোনা যেত বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে শিক্ষার্থী কিশোর শচীনের রেওয়াজের সুর আজ বিধ্বস্ত সে বাড়ির প্রাঙ্গণ থেকে শোনা যায় মুরগির আওয়াজ! কী নির্মম পরিহাস ঈশ্বর!

লেখক : জাপান প্রবাসী

(এএস/সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test