E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একটা চাকরি দরকার!

২০১৪ মার্চ ১২ ১৮:২০:৪৩
একটা চাকরি দরকার!

বজলুর রশীদ : পরিচিত প্রায় সবাইকেই বলে রেখেছি, একটা চাকরি দরকার। আমার প্রতি সহানুভূতির কারো কমতি নেই, কিন্তু যুতসই কাজ আমার জন্য তারা খুঁজে বের করতে পারছে না। যেসব চাকরি মেলে, তা আমার পক্ষে করে ওঠা কঠিন। আমাদের সাব-কন্টিনেন্টের বহু লোক এখানে রেস্টুরেন্টে কাজ করে। ছেলেরা রেস্টুরেন্টে আর মেয়েরা টিম হর্টনস (উত্তর আমেরিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় চা বিক্রির দোকান)-এ কাজ করে।নতুন যারা আসে তাদের ঘুরে-ফিরে এসব জায়গাতেই কাজ মেলে, আর একবার শুরু করলে এখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন অনেকের সন্ধান পাওয়া যাবে, যারা বছরের পর বছর এসব জায়গায় কাজ করে যাচ্ছে।

 

আমি দুয়েকজনের কাছে জানতে চেয়েছি-বিষয়টা কী, আপনারা অন্য চাকরির চেষ্টা করেন না কেন। উত্তর মেলেছে এরকম-এখানকার লেখাপড়া ছাড়া এখানে আর অন্য কোনো কাজই পাওয়া যায় না। আর কানাডায় পড়াশোনাটাও বেশ কষ্টকর। দাঁত ভেঙে যাওয়ার অবস্থা! লেখাপড়ার ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে গিয়েই অনেকটা এই দূরাবস্থা। রেস্টুরেন্টে কাজ পাওয়াও যে খুব সহজ এমন নয়, এখানে কাজ পাওয়ার জন্যও অনেক সময় কানাডিয়ান সার্টিফিকেটের দরকার হয়। যেহেতু বাংলাদেশের অনেকেই এ সেক্টরে কাজ করছেন, তারা কায়দা-কানুন করে দুয়েকজনকে কাজে ঢুকিয়ে নিতে পারেন। অবশ্য এখানে কাজের মধ্যে কেউ কোনো ভেদ খোঁজে না। কোন কাজটা বড় আর কোন কাজটা ছোটো-এভাবে কেউই দেখে না। রেস্টুরেন্টের যিনি মালিক তিনিও এমনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বোঝা মুশকিল কে মালিক আর কে চাকরি করছেন। এখানকার কাজের সংস্কৃতিটাই এমন। ফলে এ নিয়ে লোকজনের মাথা-ব্যথা নেই।

আমার শ্রীলংকান বন্ধুকে মাসখানেক দেখছি না। ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমার পরিচিত। তার কাছ থেকে তার দেশের ভাষাও কিছু শিখেছি। পরবর্তীতে তার সঙ্গে তার ভাষায় যখন আমি কথা বলতাম সে খুব মজা পেতো। অবসরে অনেক বিকেলে তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। আমার স্ত্রী লিমাকেও চিনতো। আমাদের দু’জনকেই ভালোবাসতো ভীষণ। আমরা একই বিল্ডিংয়ে থাকি। বয়স তার প্রায় ৮০ হলেও ক’দিন আগেও তাকে সুঠাম দেখেছি। বিয়েসাদি করেননি। একটা এপার্টমেন্টে একাই থাকে। বেশ হাসিখুশি মানুষ। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের দেখা হতো এলিভেটরে ওঠা-নামার সময়। ওই সময়ই কুশল বিনিময় করে নিতাম। ক’দিন আগে লিমাই কথাটা তুলল-আন্নাকে (শ্রীলংকান শব্দ আন্না অর্থ ভাই) দেখি না অনেকদিন। তাইতো! আমারও মনে হলো কথাতো ঠিক।

এরপর আমি মনে মনে খুঁজছিলাম। হঠাৎই এক বিকেলে তার সন্ধান পেলাম। বিল্ডিংয়ের সামনে একটা চেয়ারে বসে আছেন। আগে বিকেল হলেই তাকে এখানে পাওয়া যেতো। তার সেই প্রিয় জায়গাটাতে বসে আছেন আজও। গাড়ির জানালা নামিয়ে নিশ্চিত হয়েছি আমার আন্না’ই কি-না। কিন্তু এ তো অন্য এক মানুষ। চোখ দুটো চলে গেছে গর্তের মধ্যে, শরীরে মাংস বলতে নেই। জামা পরিয়ে হাড়গুলোকে কেবল ঢেকে রাখা হয়েছে। একটা হুইল চেয়ারে বসে আছেন। চেয়ারের সঙ্গে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বাঁধা। নাকের মধ্যে নল। খুব কাছ থেকে দেখছি তাও মেলাতে পারছি না, আমার বহুদিনের চেনা আন্নাকে। আমার মন খারাপ লাগছে এই ভেবে- এই বিপদে একজন প্রাণী নেই তার পাশে দাঁড়ানোর। হয়তো বিশ্বস্ত ওই হুইল চেয়ার আর অক্সিজেনের সিলিন্ডারটিই তার এখন প্রিয় সঙ্গী!

চাকরি খুঁজতে খুঁজতে যখন একপ্রকার হয়রান হয়ে পড়েছি, এরকম এক সময়ে আবারও শহরের আরেক প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেলাম। বিষয়টা আমার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল বৈকি। সাধারণত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা এ চাকরি করেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘সেলেস্টিকা’।

কম্পিউটারের মাদারবোর্ডে বিভিন্ন ধরনের চিপস্ বসিয়ে তা কিভাবে ফাংশান করছে-এসব দেখাশোনাই এখানে আমার প্রধান কাজ। কাজ শুরু ২০০৮ এর জানুয়ারির শেষভাগে। সেলেস্টিকার চাকরিকে এখানে সবাই মূল্যায়ন করে। কানাডায় আসার পরেই এ খবর জেনেছি। বইপত্র যোগাড় করে ঘরে বসে ২/৩ মাস পড়াশোনা করে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। ভেবেছিলাম এ চাকরি আমার হবেই না। দুরুদুরু মনে আবেদন জমা দিয়ে এসেছিলাম। তারা আমাকে ডেকেছে, লিখিত ও মৌখিক ইন্টারভিউ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত আমাকে চূড়ান্ত করেছে। এ পর্যন্ত সবই ভালো ছিল; সমস্যাটা বাধল এরপরে। আমাকে নাইট শিফটে কাজ করতে হবে। রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা। রাত ১২টার পর যে মানুষ জেগেই থাকতে পারে না, সে সারারাত ধরে কাজ করবে কীভাবে! শুনলাম শুরুতে সবাকেই নাইট শিফ্ট করতে হয়, ধীরে ধীরে ডে শিফ্টে আসা যায়। আর এই চাকরি মূলত ২ বছরের ‘কন্ট্রাক্ট জব’। ২ বছরের জন্য। অগত্যা নাইট শিফ্ট দিয়েই শুরু করলাম। মানুষ সবাই যখন ঘুমুতে যায়, আমি তখন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হই চাকরি করতে। এ ধরনের কাজ আমার জীবনে এই প্রথম। বেশ মজা পাচ্ছি। নগদ টাকা উঠানোর যে ‘এটিএম মেশিন’ সেই মেশিনের মাদার বোর্ড তৈরি দিয়েই আমার সেলেস্টিকায় কাজ শুরু।

প্রথম কয়েক রাত বেশ ঘুম পেয়েছে কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় তা আর চেপে বসতে পারেনি। সবকিছু গুছিয়ে বাসায় ফিরতে সকাল ৮টা বেজে যেতো। আমি বাসায় ফেরার আগেই অনেক সময় লিমাকে বেরিয়ে পড়তে হতো। ৯টায় তার ক্লাস শুরু। বাসে-ট্রেনে চেপে কলেজে যেতে তার এক ঘণ্টা লাগে। আমি বাসায় ফিরে কোনোরকম জামাকাপড় বদলে দিতাম ঘুম। কখন দিন শেষে সন্ধ্যা চলে আসত বুঝতেই পারতাম না। লিমার বাসায় ফিরতে ফিরতে ৬টা বেজে যেতো। ও এসে ডেকে তুলতো আমাকে। তখনও আমার চোখে কাঁচা ঘুম। ভীষণ কষ্ট হতো বিছানা ছাড়তে। প্রতিদিনই মনে হয় আজ যদি না যেতে হতো কাজে! সারাদিন কলেজ করে লিমাও ভীষণ ক্লান্ত। দেখতে দেখতে ১০টা বেজে যায়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আবার সেই ছোটা। লিমা দিনমান কলেজে, ক্লাস-টিউটোরিয়াল-মিডটার্ম নিয়ে অস্থির; আমি চাকরি করছি রাতভর। ‘রিলে রেস’-এ নেমেছি যেন! ও সারাদিন দৌড়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রিলের কাঠি তুলে দিচ্ছে আমার হাতে। শুরু হচ্ছে তখন আমার দৌড়ের পালা। সকালে আমি ফিরে আবার তুলে দিচ্ছি তার হাতে। এ দৌড়ের কখন শেষ হবে কে জানে!

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test