E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নারীদের এখন মুখ ফোটে বুক ফাটে না

২০১৬ মার্চ ০৮ ১৪:৩২:৫৯
নারীদের এখন মুখ ফোটে বুক ফাটে না

কৌশলী ইমা : নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে হবে। পুরুষতন্ত্রকে সমূলেই উৎপাটন করতে হবে। আদিকালের সেই প্রবাদ বাক্য নারীদের ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ বর্তমান যুগে এ প্রবাদ একেবারেই বেমানান। এখন নারীদের মুখ ফোটে কারো বুক ফাটে না।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে চারিপাশে নারীদের অবস্থারও একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে অনেক নারী তার বিয়ে বিষয়ে মতামত প্রদান করতে পারতেন না। সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করতে পারতেন না। অনেকেই পরিবার থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন না। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করলেও তাদের সে আয় স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী খরচ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন সে অবস্থার ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি বেশি হলেও এখনও পুরুষের তুলনায় অনেক কম। ৮ মার্চ সারা বিশ্বে যখন নারী দিবস পালন করা হচ্ছে, অন্যদিকে হয়তো কোন নারী সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ থেকে উত্তরণের জন্য কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে সরকারিভাবে পদক্ষেপে নিলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আবার যারা বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে তা প্রকল্প ভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি কথা হচ্ছে সবাই মিলে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে হবে।

এছাড়া নারীর অধিকার আদায়ে একজন নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপশি পরিবারেরও বেশ কিছু ভূমিকা রয়েছে। নারীর নিজেরও কিছু ভূমিকা রয়েছে। নারীর নিজেরও কিছু দায়িত্ব থাকবে। স্বেচ্ছাচারী হয়ে পুরুষের প্রতি বিরূপ আচরণ করবে তা নয়।

সর্বোপরি কথা হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয়কে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সহনশীল হতে হবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইসলাম ধর্মই নারীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছে। এ ধর্মে নারীর অধিকারের কথা সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। আর এসব নির্দেশনা এসেছে সুস্পষ্টভাবে। এজন্য ধর্মের নামে নারীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নারীদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে।

নারীর উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার নারী। পৃথিবীতে এরকম আর কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

জাতীয় সংসদে অবদান রাখতে বঙ্গবন্ধু নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে গেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সরকারের বিভিন্ন পদে নারীদের নিয়ে আসতে অনেক বাধার মুখে পড়েছিলাম। আমার দৃঢ়পদক্ষেপের ফলে আজ বিমান চালাচ্ছেন নারী। এছাড়া পুলিশের বড় বড় পদে এখন নারীরা। আগে কখনো সচিব পদে কোনো নারী ছিল না। আমার সরকারই সচিব পদে নারীদেরকে নিয়ে এসেছে। তবে নারী-পুরুষ সকলের চেষ্টায় আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।

তিনি বলেন, সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। সেখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে নারীদের কর্মসংস্থানের। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায়ই সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো। তিনি বলেন, আমাদের কারও দিকে মুখাপেক্ষী হতে থাকলে চলবে না। নিজেদের এগিয়ে যেতে হবে। নিজের মর্যাদা নিজেকেই কর্মের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হবে। সরকার প্রধান, সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা সবাই নারী। বিশ্বের কোথাও এ ধরনের নজির নেই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই। সমাজের সবাইকে একসঙ্গে দেশকে উন্নত করতে হবে। ইসলাম ধর্মই নারীদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ইসলাম ধর্মে নারীর গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের ১০ শতাংশ কোটা বঙ্গবন্ধু চারু করে গেছেন। নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে গেছেন। ২০১০ সালে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল পর্যায় থেকে স্থানীয় সরকার প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেই। উপজেলা পরিষদে নারীরা আসার প্রক্রিয়া করেছি। স্থানীয় সরকারের সবক্ষেত্রে নারীদের আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী তিন বাহিনীতে নারীদের উপস্থিতি, জজকোর্টে নারী, নারী পাইলটসহ বাংলাদেশের জন্য সাঁতার ও ভারোত্তলনে দুই নারীর স্বর্ণ জয়ের কথা উল্লেখ করেন। অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমান সমান প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

নারীনেত্রী ও জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সালমা আলী বলেন, এ অবস্থার জন্য দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী দরিদ্রতা এবং নারীদের আয়মূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণহীনতা। নিরক্ষতা ও অজ্ঞতা, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, যৌতুক, বাল্যবিয়ে, নারীদের নিজেদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা লালনও এর পেছনে কাজ করে। তিনি বলেন, দেশের অনেক নারী এখনও বিশ্বাস করে, সমাজের পুরুষরা তাদের চেয়ে শক্তিশালী। মেধা-মননে পুরুষের চেয়ে নারী পিছিয়ে। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, সমাজের নারীরাই পুরুষতন্ত্রকে বেশি লালন করে। নারীর মন থেকে এ ধরনের মনোভাব যতদিন পরিবর্তন করা না যাবে ততদিন সমতা প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হবে না।

গ্রামের অধিকাংশ নারী অবহেলিত। বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের প্রতি বঞ্চনা হয় আরও বেশি। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় তো বটেই, অন্য নারীদের চেয়েও তারা পিছিয়ে। পারিবারিক কাঠামোতেও তারা অবহেলিত। সমাজে মানুষ হিসেবে যতটুকু মর্যাদা থাকার কথা তা তাদের নেই। এসব নারী এখনও জানে না, সমাজে তাদের মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার রয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, অন্য অনেক ক্ষেত্রে নারী এগিয়ে গেলেও সমতার প্রশ্নে দেশে এখনও অনেক পিছিয়ে। সম্পদ-সম্পত্তিতেও নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। নারীর প্রতি সহিংসতাও কমাতে সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা জরুরি। তিনি নারী পুরুষের সমতা অর্জনের জন্য তিনটি সুপারিশ করেন। এগুলো হলো- নারীশিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা, নারীর পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

নারী অধিকার রক্ষা এবং নির্যাতন রোধে সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর, গঠিত হয়েছে কমিটি। কাজ করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কিন্তু শত কর্মপ্রচেষ্টা সত্ত্বেও সমাজে এখনও নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত হয়নি। বন্ধ করা যায়নি নারী নির্যাতন।

গত শনিবার ঢাকায় মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ইউএন উইমেন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্রিস্টিন সুসান হান্টার বলেন, সাধারণ নারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার দিকেই নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে নারীর অবস্থান যেন আরও দৃশ্যমান হয়, সেদিকে জোর দিতে হবে। সরকারকে বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোই কেবল নয়, বরং সমতা অর্জন করতে হবে। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে সব জায়গায় নারীর জন্য এ সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সিডও সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সমতা যদি অর্ধেকাংশে নিশ্চিত করতে হয় তাহলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

শিক্ষা একটি মানবিক অধিকার। এটি সমতা, উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্য অর্জনে অপরিহার্য হাতিয়ার। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনও নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। পরিবারগুলো এখনও মেয়েসন্তানের চেয়ে ছেলেসন্তানের শিক্ষা নিশ্চিত করায় বেশি মনোযোগী। পুরোপুরি বৈষম্যহীন শিক্ষা ছেলে মেয়ে উভয়েরই উপকার করে। নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করতে নারীশিক্ষা জরুরি। পরিবারে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ নিতে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, টেকসই এবং সামগ্রিক উন্নতি ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে সমাজের নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে। সমাজে নারী-পুরুষের সহাবস্থান এবং সমঅধিকার নিশ্চিত করা না গেলে কখনও কোনো টেকসই এবং প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণ, সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণই হলো আধুনিক প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার মূলমন্ত্র। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, নারীর উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী-পুরুষ বৈষম্য কমিয়ে সমতা আনা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য উগ্রগতি হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে অনেক ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের বৈষম্য কমেছে বলেও দাবি করেন তিনি।

নারী দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। নারী দিবসের শুরু ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সূঁচ কারখানার নারী শ্রমিকরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। সেদিন আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেফতার হন অসংখ্য নারী। কারাগারে নির্যাতিতও হন অনেকে। তিন বছর পর ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় `নারী শ্রমিক ইউনিয়ন`।

১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। ১৯১০ সালের এই দিনে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পর থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন শুরু করে। এর দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে পৃথিবী জুড়েই নারীর সমঅধিকার আদায় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশও প্রতিবছর যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালন করে।



লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সমকালীন সঙ্গীতশিল্পী, পরিচালক সঙ্গীত একাডেমি, নিউইংল্যান্ড

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test