E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সেই শৈশবের ঈদ

২০১৭ জুন ২৪ ২৩:৪৭:০০
সেই শৈশবের ঈদ

আম্বিয়া অন্তরা


তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। ছয় বোন ও  একমাত্র বড় ভাই এবং  মাকে রেখে আব্বা হার্ট এটাকে মারা গেলেন। অনেক সম্পদ, পুকুর বাগান বাড়ী সবই ছিল, কিন্তু তদারকের মানুষ ছিলনা। পাঁচ বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, আমি সবার ছোট। সংসারের দায়িত্ব ভাইয়ের মাথায়। তিনি  তার সন্তানদের সাথে  আমাকেও সন্তানের মত দেখতেন। আমাকে ও তার  পরিবার নিয়ে ভাই ঢাকায় থাকতেন। কিন্তু গ্রামের পরিবারের দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। আমি রোজার ছুটিতে মায়ের সাথে থাকার জন্য আগেই  গ্রামের বাড়ী চলে এসেছিলাম। সেইবার ঈদের সময় কোন এক সমস্যার কারণে নতুন কাপড়ের বাজেট বন্ধ রাখলেন ভাই।

আমি নতুন সই পেতেছি; নতুন জামা পরে তাদের বাড়ী দাওয়াত খেতে যাবো। কিন্তু নতুন জামা না দিলে কি হবে আমার! মা আমার আগের জামা ধোপা বাড়ী থেকে ইস্ত্রি করিয়ে এনে রেখেছেন। মায়ের মাথায় অনেক চিন্তা! পাঁচ জামাইকে দাওয়াত করে আনতে হবে। আমাদের মেহেরপুরের জেলার রেওয়াজ, ঈদ কোরবানি যে কোন বিয়ে সাদী উৎসব হলেই জামাইদের দাওয়াত দিতে হবে এবং ভাল পোশাকও দিতে হবে। মায়ের মাথায় আসমান সমান চিন্তা, আর আমার মাথায় তার চেয়ে বেশী চিন্তা! নতুন জামা না পেলে সইয়ের বাড়ী যাবো কিভাবে! ভ্যাল্ভেট কাপড়ের রুমাল ছাট ফ্রক ঈদ ফ্যাশন । মা এতদিন আশা দিয়ে আসলো ঈদের সময় ভ্যাল্ভেট কাপড়ের রুমাল ছাট ফ্রক কিনে দিবে! আর এখন দিতে পারবেনা! ব্যবহার করা জামা ইস্ত্রী করে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন! এতদিন তাহলে মা মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন! সত্য কথা কেন গোপন করেছিলেন! রাগে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। মাথায় বুদ্ধি আসলো। আমি সাঁতারের সব রকম কৌশল জানি। মাকে ভয় দেখালে কাজ হবে। মাকে বললাম জামা কিনে না দিলে পুকুরে ডুবে মরবো।

পুকুরে ঝাপ দিলাম; মরা সাঁতার কাটছি পানিতে ভেসে ভেসে। মা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেছেন যে, আমি মরে যাচ্ছি। মায়ের আহাজারিতে পাড়ার লোকজন জড় হল। মা তাদের বললেন, তোমরা আমার মেয়েকে উদ্ধার কর,আমি ঈদের কাপড় কিনে দেবো। প্রতিবেশীরা আমাকে পানি তুলে থেকে ডাঙায় আনল। তারপর মায়ের হাতের সোনার বালা বিক্রি করে আমাকে ভ্যালভেট কাপড়ের রুমাল ছাট জামা কিনে দিলেন।

চাঁদ রাতে ভাই ঢাকা থেকে আমার জন্য অনেক দামী ঈদ ফ্যাশনের জামা এনে আমাকে ডেকে বললেন, দেখ তোর জামা পছন্দ হয়েছে কিনা! আমি জামা হাতে নিয়ে ভয়ে কান্না করছিলাম। ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের পানিতে জামা ভিজতে লাগলো। এর আগে যে ঘটনা ঘটেছে, ভাই তার কিছুই জানেন না। আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ভাই বলেছিলেন, এইবার নতুন কাপড় বন্ধ থাকবে।

মা ও ভাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমার রাগ দেখার মানুষ গুলো আর নেই। ঈদ আসে ঈদ যায়! কিন্তু নতুন কাপড় পরার সেই আবেগ সেই আগ্রহ আর নেই। আজ সেই পুরনো ঈদ স্মৃতির কথা লিখতে গিয়ে চোখ ভিজে যায়। এখন আমিও সন্তানের মা। সন্তানের জন্য মায়ের কষ্টটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি। খুব ইচ্ছে করে মাকে জড়িয়ে ধরে শৈশবের সেই ভুলের জন্য বলি,আমায় ক্ষমা করে দিও মা! সেটা তো আর হবার নয়! এই ভুলগুলোর ধরণই বুঝি এমন, যখন তা শুধরে নেওয়ার তাগিদ অনুভূত হয়, তখন আর সেই ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। তবু আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে বলি, আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test