E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমতলী ও বামনায় তীব্র নদী ভাঙ্গন

পায়রা ও বিষখালী গিলছে বরগুনার বিস্তৃর্ণ জনপদ

২০১৪ জুলাই ০৩ ১৫:০০:২০
পায়রা ও বিষখালী গিলছে বরগুনার বিস্তৃর্ণ জনপদ

বরগুনা প্রতিনিধি : বরগুনার বিষখালী ও পায়রা নদী তীরবর্তী জনপদে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই এ ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী ৫০টি গ্রামের কৃষি জমিসহ গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে।

নদীর ভাঙনরোধে এ যাবৎ কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় এ ভাঙনে এ জনপদের আয়তন ছোট হয়ে আসছে। এতে নদী তীরবর্তী জমি ও বসত বাড়ি হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে বহু পরিবার ।

ভাঙ্গনের কবলে জেলার পায়রা নদীর তীরবর্তী আমতলী পৌর শহর রক্ষা বাঁধের ব্লক ধসে যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে পৌরসভাসহ আমতলী-তালতলী উপজেলার প্রায় ২৫টি গ্রাম। বর্ষা মৌসুম শুরু হবার সাথে সাথে নতুন করে এ ভাঙ্গনে আতঙ্কের দিন কাটাচ্ছে ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ। আমতলী লঞ্চঘাট ও ফেরীঘাট এলাকায় চলতি বর্ষা মৌসুমে পার্শ্ববর্তী ব্লক ধসে দুই ঘাট এলাকা হুমকির মুখে রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৯০ সাল থেকে আমতলী ও তালতলী উপজেলার পায়রা নদী ভাঙ্গন শুরু হয়। এ পর্যন্ত পায়রা নদীর ভাঙ্গনের কবলে পৌরসভার পুরাতন শ্মশানঘাট, লঞ্চঘাট, ফেরীঘাট, বালিয়াতলী, পশুরবুনিয়া, পশ্চিম ঘটখালী, আক্সগুলকাটা, গুলিশাখালী, জয়ালভাঙ্গা, বগীরবাজার, মৌপাড়া, গাবতলী, তেতুঁলবাড়ীয়াসহ প্রায় ২৫ গ্রামের আবাদী জমি ও বসতি নদীতে বিলীন হয়েছে।

অন্যদিকে পাউবোর বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে বিভিন্ন গ্রামের এলাকায় লবন পানি ঢুকে কোটি কোটি টাকার ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। ১৯৯৮ সনে আমতলী পৌরসভাকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষায় ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সিসি ব্লক ফেলা হয়। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলাতে রক্ষাবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০১০ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে মাত্র ১২৫ মিটার ক্ষতিগ্রস্থ অংশে ব্লক ফেলে তা মেরামত করে। এ কাজ অতি নিন্মমানের হওয়াতে পুনরায় ব্লক সরে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পাউবোর অফিস সংলগ্ন পায়রা নদীতে ভয়াবহ ভাঙ্গনের কারনে ৫০-৬০ মিটার ব্লক ধসে সরে গেছে। বর্তমানে পুর্ণিমার জোয়ারের কারণে ফেরীঘাট, পুরাতন লঞ্চঘাট, পশ্চিম ঘটখালী, আঙ্গুলকাটা এলাকা ঝুকির মধ্যে রয়েছে। গত ২৩ বছরে আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ৪ হাজার ঘরবাড়ি- ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ৮ শ একর কৃষি জমি ও ২৫ কিলোমিটার বেড়ীবাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

অপরদিকে জেলার বামনা উপজেলার বিষখালী নদী ভাঙ্গনে পাঁচ সহস্রাধিক পরিবার বিষখালী নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব পরিবার অব্যাহত ভাঙ্গনে ভিটা মাটি হারিয়ে এখন বিপন্ন জীবনের মুখোমুখি। ভাঙ্গন রোধে স্বাধীনতা পরবর্তী কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রতিদিন এ জনপদ ভাঙ্গনের বিস্তৃতি বাড়ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বরগুনার বামনা সদরের লঞ্চঘাট এলাকাসহ নদী তীরবর্তী প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অন্তত ১০ টি গ্রামের কৃষি জমি ও বৃক্ষরাজি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙনের তীব্রতায় ওয়াপদা বেড়ি বাধ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। উপজেলার পুরাতন বামনা বাজার থেকে চালিতাবুনীয় ফেরীঘাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পানিউন্নয়ন বোর্ডে বেরিবাধের কালিকাবাড়ি ও চেচান গ্রামের প্রায় তিন কিলোমিটার বেড়িবাধ ঘূর্ণিঝড় সিডরের জলোচ্ছাসে ধসে যায়। এর পর সেখানে দায় সারাভাবে মাটি ভরাট করলেও নতুন করে ভাঙনের তীব্রতার কারণে ওই বেড়িবাধ বিলীন হয়ে গেছে।

বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক জোয়ারে বিপর্যস্ত বেরিবাধ ধসে উল্লেখিত এলাকার ঢুষখালী,পশ্চিম শফিপুর,চালিতানীয়া ও সোনাখালী গ্রামের কৃষি জমি তলিয়ে প্রতিবছর ফসলহানী ঘটছে। এছাড়া বামনা উপজেলা সদরের লঞ্চঘাট এলাকা,বেবাজিয়াখালী, কলাগাছিয়া, পূর্ব সফিপুর, রুহিতা,অযোধ্যা, খোলপটুয়া, রামনা, দক্ষিন রামনা, চলাভাঙ্গা ও উত্তর কাকচিড়া গ্রাম নতুন করে ব্যাপক নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। এ সমস্ত এলাকার নদী তীরবর্তী আবাদী জমি ও বসতবাড়ী অব্যহত ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে ।

দক্ষিন রামনা, চলাভাঙ্গা ও উত্তরকাকচিড়া এলাকার ভাঙ্গন নদীর তীরবর্তী পানি উন্নয় বোর্ডের প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধ বিষখালী নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ধসে যাওয়া ওই বাধ সাময়িক ভাবে আবাদি জমির ভিতরে নির্মাণ করলেও বিষখালী নদীর স্বাভাবিক জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে গ্রামের আবাদি জমিতে লোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে বর্ষা মৌসুমে কৃষি ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে ।

কালিকাবাড়ি গ্রামের হরে কান্ত শীল (৫০) জানান, সিডরে কালিকাবাড়ি গ্রামের বেড়িবাঁধ ধসে গেলে নদী তীরবর্তী প্রায় শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। পরে ধসে যাওয়া বাঁধে কোনমতে মাটি ভরাট দিলে আশ্রয়হীন পরিবারগুলো আবার নদী তীরে বসতি গড়ে। বর্তমানে উল্লেখিত এলাকায় নতুন করে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে বহু পরিবার আবার গৃহহীন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

২০১০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী তৎকালীন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমান বামনার ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন কালে স্থানীয় খোলপটুয়া বন্দরে এক জনসভায় এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে বামনার নদী ভাঙ্গন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন। ওই আশ্বাসের সাড়ে তিন বছর পরেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য জরিপে জনাগেছে, গত ৫০ বছরে বিষখালী নদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বামনা উপজেলার ১০ টি গ্রামের পাঁচ হাজার পরিবার গৃহহীন সহ হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি ও বনভূমি বিলীন হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে পুরাতন বামনার মূল বন্দর সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙ্গনে বামনার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে চার বর্গ কিলো মিটার আয়তনের সফিপুর গ্রাম ।

কালিকাবাড়ী গ্রামের জেলে নীরবালা দাস (৭০) জানান, নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে ৬ বার তার বসতবাড়ি স্থানান্তর করতে হয়েছে। নদী ভাঙ্গনের ১০ একর আবাদী জমি সম্পূর্ন বিষখালীর করাল গ্রাসে চলে গেছে। বসত বাড়ি ছাড়া এখন তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

এদিকে বামনা উপজেলা সদর লঞ্চঘাট বাজার এলাকার শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী তীরবর্তী প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় লঞ্চঘাট এলাকা এখন পুরোপুরি বিলীনের আশংকা দেখা দিয়েছে। এলাকবাসী ভাঙ্গন কবলিত লঞ্চঘাট এলাকার ব্যবসায়িরা নদী ভাঙ্গনের আশংকায় তাদের দোকান পাট অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। সম্প্রতি এলাকাবাসি নদী ভাঙনের হাত থেকে রেহাই পেতে লঞ্চঘাটের কাছে ভাঙন কবলিত স্থানে দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করে। এছাড়া ভাঙনরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নদীতীরে এলাকাবাসি মানববন্ধন করে।

বামনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, নদী ভাঙ্গন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। বিষখালী নদীতে ভাঙন অব্যহত আছে। শহরের লঞ্চঘাট এলাকার নদী তীরে ব্লক স্থাপন করা খুবই জরুরী । জেলা পরিষদ সভায় বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বরগুনা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মালেক বলেন, পায়রা নদীর ভাঙ্গন রোধে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। বর্ষা শেষে এ কাজ শুরুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অপরদিকে বামনা উপজেলায় বিষখালী নদী ভাঙ্গনে ধসে যাওয়া বেড়িবাধ নুতন করে নির্মানের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে। আশা করি শীঘ্রই এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।

(এমএইচ/জেএ/জুলাই ০৩, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test