E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্প

অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, হুমকিতে অধিগ্রহনকৃত এলাকা : পর্ব ২

২০১৪ জুলাই ২২ ২১:৩৭:২৫
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, হুমকিতে অধিগ্রহনকৃত এলাকা : পর্ব ২

কাজী নজরুল ইসলাম, শরীয়তপুর থেকে :

শরীয়তপুর জেলায় কোন বালু মহাল না থাকা সত্বেও পদ্মা সেতুর মত একটি স্পর্শ কাতর প্রকল্পে নদীর তীরে ৩০ টি বলগেট ড্রেজার বসিয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর সার্ভিস এরিয়া-২ এর মাটি ভরাট এর  জন্য কোন রকম নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ন অবৈধভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বালু। আর এতে সহায়তা করছে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন। ফলে ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী।

উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলার ফলে এক দিকে যেমন ঝুকিতে পরছে পদ্মা সেতু নির্মানের জন্য অধিগ্রহনকৃত জমি, পূনর্বাসন এলাকা, সদ্য সমাপ্ত নদী শাসনকৃত বেরী বাধ অপর দিকে প্রবল ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে পরছে তিনটি গ্রাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, সেতু কর্তৃপক্ষ কাউকে অবৈধ কাজ করার অনুমোদন দেয়নি, কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলে তা দেখার জন্য জেলা প্রশাসন রয়েছে।

পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২ শত ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্পের জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতুর সার্ভিস এরিয়া-২ এর জন্য দিয়ারা নাওডুবা মৌজায় সেতু বিভাগ ১৪৪ একর জমি অধিগ্রহন করে সেখানে পদ্মা রিসোর্ট এরিয়া নির্মানের প্রস্তুতি চলছে। ২০১৩ সালের ২০ আগষ্ট সেতু বিভাগের দেয়া ঠিকায় এ কাজ করার সুযোগ পায় আব্দুল মোনেম লিমিটেড নামে দেশীয় একটি বৃহৎ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার শর্তে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারী কার্যাদেশ প্রদান করে সরকার। এর আগেই ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর কাজটির উদ্ধোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি শরীয়তপুর অংশে সার্ভিস এরিয়া-২ এর জন্য প্রয়োজনীয় বালু ভরাটের কিছু কাজ সাব ঠিকায় দেয় খোকন এন্ড ট্রেডিং ও মেসার্স জাকির হোসেন নামে ২টি প্রতিষ্ঠানকে। বেশীরভাগ বালু তুলছে মূল ঠিকাদার মোনেম লি:। ঠিকাদার গত সাত মাস যাবৎ জাজিরার পদ্মা নদীর তীর সংরক্ষন এলাকায় ও পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহনকৃত এলাকার কাছ থেকে জাজিরা উপজেলার নাওডুবা ইউনিয়নের হাছেন বয়াতির কান্দি, সমর আলী মৃধার কান্দি ও হাজী গফুর মোল্যার কান্দি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে জোর করে অবৈধভাবে বালু তুলে চলেছে। এ বালু তোলার কাজে তারা ব্যবহার করছে বোলগেট ড্রেজার। গত ১৬ এপ্রিল স্থানীয় বাসিন্দারা অবৈধভাবে বালু তোলার কাজে বাধা সৃষ্টি করলে কিছু দিন বালু উত্তোলন বন্ধ রাখে। এর পর শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় জুন মাসের প্রথম দিক থেকে নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে আবার তারা বালু তোলা শুরু করেছে। প্রতি দিনই স্থাপন করা হচ্ছে নতুন নতুন ড্রেজার। ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে আবার সৃষ্টি হয়েছে ভিটে মাটি হারানোর ভীতি। নতুন করে ফুঁসে উঠছে তারা।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সূত্র থেকে জানা গেছে, সার্ভিস এরিয়া- ২ এর অধীনে পদ্মা রিসোর্ট নির্মান করা হবে। এখানে ১ টি মোটেল ম্যাস, ১ টি রিসোর্ট অভ্যার্থনা কেন্দ্র, ১ টি সুপারভেশন অফিস ও ৩০টি ডুপ্লেক্স ভবন নির্মিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর জন্য প্রায় সাড়ে ৪ শত বিঘা জমি অধিগ্রহন করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। যার আয়তন দৈর্ঘ্যে ১ হাজার ১ শত মিটার এবং প্রস্থ সাড়ে ৫ শত মিটার। মূল ভুমি থেকে প্রায় ৩০ ফিট উচু করে উল্লেখিত এলাকাটি বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এতে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি ঘন ফিট বালুর প্রয়োজন হবে। যে বালুর পুরোটাই উত্তোলন করা হচ্ছে অবৈধভাবে।

সেতু বিভাগ জানিয়েছে, পদ্মা সেতুর শরীয়তপুর-মাদারীপুর-মুন্সিগঞ্জ অংশে প্রয়োজনীয় বালু উত্তোলনের জন্য মূল পদ্মা নদীর ১২ কিমি এলাকা থেকে প্রায় ১০০ ফিট গভীর করে বালু তোলার জন্য বিআইডব্লিউটিএ এর সহায়তায় সেতু বিভাগ বিশেষ এলাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার আব্দুল মোনেম লি: স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও সেতু বিভাগের কিছু কর্মকর্তাদের হাতে রেখে নদী ভাঙ্গনের শিকার অসহায় মানুষের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে প্রায় ৩০টি ড্রেজার দিয়ে ৫০-৬০ ফিট গভীর করে বালু উত্তোলন করছে। ফলে, অপরিকল্পিত ভাবে ভারী ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারনে সেতু প্রকল্পের তীর, অধিগ্রহনকৃত জমি, পূনর্বাসন এলাকা, বেরী বাধ সহ তিনটি গ্রামের প্রায় শতাধিক বসত বাড়ি নদী ভাঙ্গনের মুখে পরেছে।

এলাকাবাসী দাবী করেছে ঠিকাদার যেখান থেকে বালু উত্তোলন করছে তা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। সম্পূর্ন অবৈধভাবে এ বালু তোলা হচ্ছে। বিনিময়ে সরকারও কোন রাজস্ব পাচ্ছে না এমনকি জমির মালিক হিসেবে তারাও কোন অর্থ পাচ্ছেনা। বালু তোলায় বাধা দিতে গেলে তাদের সেনা বাহিনী সহ প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের। এলাকার লোকেরা ধারনা করছে এত ভারী খননযন্ত্রের সাহায্যে এতটা গভীর করে বালু কাটার ফলে অচিরেই এলাকা ভাঙ্গনের কবলে পরবে।

হাছেন বয়াতির কান্দি, সমর আলী মৃধার কান্দি ও হাজী গফুর মোল্যার কান্দি এলাকার বাসিন্দা মাওলানা মজিবুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম বয়াতি, রিনা বেগম, মো. বাদশা শেখ ও মো. দাদন বয়াতি বলেন, ঠিকাদার যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছে তা আমাদের সাত পুরুষের পৈত্রিক সম্পত্তি। গত ৭/৮ মাস যাবৎ ঠিকাদার অবৈধভাবে বালু তুলছে। আমরা বার বার বাধা দিলেও নানা ভয় ভীতি দেখিয়ে বালু তুলেই যাচ্ছিল। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে গত ১৬ জুন এলাকার সকল মানুষ ফুঁসে উঠলে সেতু কর্তৃপক্ষ আমাদের জমি অধিগ্রহন করে নেয়ার কথা বলে। শরীয়পুরের জেলা প্রশাসন আমাদের ৩ ধারার নোটিশ দিয়েছে। কিন্তু জমি অধিগ্রহনের প্রক্রিয়া এখনো অনেক বাকি। তার পরেও ঠিকাদার জোর করে আমাদের জমি থেকে বালু কেটে যাচ্ছে। এত গভীর করে বালু তুললে এই বর্ষা মৌসুমের পর আমাদের এলাকা ভাঙ্গনের কবলে পরবে।

জমির মালিক আব্দুল মান্নান উকিল ও তৈয়ব আলী মাদবর বলেন, শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন ঠিকাদারকে অবৈধভাবে বালু তোলার অনুমতি দিয়েছে, তাই প্রশাসনের ওপরে কোন কথা বলার সাহস আমাদের নেই। এভাবে বালু তোলার ফলে সরকারও একটা পয়সা পাচ্ছে না আর আমরাও কোন মূল্য পাচ্ছি না। জোর করে বালু কাটা বন্ধ না করলে আমরা আবার এই ড্রেসার বন্ধ করে দেব।

ড্রেজার মালিক ও বালু কাটার সাব ঠিকাদার মেসার্স জাকির ট্রেডার্স এর মালিক এর কাছে অবৈধভাবে বালু কাটার কথা জানতে চাইলে তিনি নিজেকে ৬ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী দাবী করে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হয়নি।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনম লিমিটেড এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন এর কাছে অবৈধভাবে বালু কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গণমাধ্যমকে যে কোন ধরনের তথ্য প্রদানে তার সীমাবদ্ধতা আছে। তারা কোন অনিয়মের আশ্রয় নিচ্ছে না বলেও দাবী করেছেন তিনি।

নাওযোবা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লায়ন অধ্যাপক ফজলুর রহমান বলেন, আমি বার বার এলাকার লোকজন নিয়ে অবৈধ বালু তোলায় বাধা দিয়েছি। আমাদের বাধা ও অনুরোধ উপেক্ষা করে সেনা বাহিনীর ভয় দেখিয়ে ঠিকাদার অন্যায়ভাবে বালু উত্তোলন করছে।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রাম চন্দ্র দাস বলেন, বালু উত্তোলনকৃত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের জমি সরকার অধিগ্রহন করে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। কেউ নিয়ম ভেঙ্গে বালু তুললে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদার অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বালু তুলছে বলে আমাদের জানা নেই। এই প্রকল্পের জন্য আমরা পদ্মা নদীর ১২ কিমি এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের জন্য এলাকা নির্ধারণ করেছি। অবৈধভাবে বালু কাটা হলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে স্থানীয় জেলা প্রশাসন।


(কেএনআই/অ/জুলাই ২২, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test