E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব হুমকির মুখে

২০১৪ আগস্ট ০৭ ১৬:১৬:১৫
সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব হুমকির মুখে

বাগেরহাট থেকে আহসানুল করিম : আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে পালিত হচ্ছ বিশ্ব বাঘ দিবস। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস হিসাব পালন হলেও এবছর বাংলাদেশে ওই দিন ইদ থাকায় ৭আগস্ট বিশ্ব বাঘ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত  প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুন করার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারন করা হয়। সুন্দরবন সন্নিহিত জেলাগুলোসহ সরকারি ও বিভিন্ন পরিবেশবাদি সংগঠন সভা,সমাবেশ,র‌্যালীসহ নানান কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করছে।

বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ টিকে আছে এমন ১৩ টি দেশে বিশ্ব বাঘ দিবস হিসাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশে বাঘের প্রকৃত আবাস বলতে বোঝায় সুন্দরবনকে। এবনে মিষ্টি জলের অভাবে লবনের পরিমান বেড়েই চলেছে। সেজন্য বন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুন্দরী, গোলপাতাসহ অনেক ধরনের গাছপালা। উষ্ণতা, মানুষের উপস্থিতি, লবন জলের আধিক্য, বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় কারনে করুন অবস্থা সুন্দরবনের পাহারাদার বাঘের। তাপমাত্র হেরফেরে মৌসুমি বায়ু নিদিষ্ট সময়ে সক্রিয় হচ্ছে না। সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না পরিমান মতো। আবার কখনও কখনও অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে পরিমানের চেয়ে ঢের বেশি যার প্রভাবে সুন্দরবনের গাছ মরছে। এছাড়া গঙ্গা অববাহিকার যে মিষ্টি জল গড়াই ধরে সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ত তা আবশ্যিক সময়ে না পাওয়ায় এবনের জলে লবনের মাত্রা হঠৎ করে বেড়ে গিয়ে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে বন পরিবেশের সব পর্যায়ে। যার প্রভাবে বৃক্ষ, তরুলতা মাছ, জলজ অন্যান্য প্রাণী, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি ও সুন্দরবনের পাহারাদার প্রকৃত পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জীবনযাত্রায় অস্বাভাবিক অস্থিরতা এসেছে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমির হোসান চৌধুরী জানান, বর্তমানে সুন্দরবনে ৪৪০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। গত ১০ বছরে চোরা শিকারীসহ বিভিন্ন কারনে সুন্দরবনের ১৭টি বাঘ মারাগেছে। পরিবেশবিদদেও হিসেব মতে এর সংখ্যা ৩০টি। ২০০১ সাল থেকে ২০১২ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত ৩০ টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ১৬টি পূবর্ সুন্দরবনে আর ১৪ টি পশ্চিম বিভাগে মারা য়ায।
বাঘ রক্ষায় সরকার ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যায় সর্বোচ শাস্তি ১২ বছরের কারাদন্ড ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার বিধান করেছে।
বাংলাদেশের বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে যে পরিমাণ বাঘই থাকুক দ্রত এর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। আবার ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর হঠাৎ করে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে। কারণ, সিডর ও আইলায় নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানি বনের ভেতর প্রবেশ করে আর বের হতে পারছে না। এতে বনের মিষ্টিপানির পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভরে যাওয়ায় বাঘ মিষ্টিপানির আশায় লোকালয়ে প্রবেশ করছে।
তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরাশিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। ১৯৮০ থেকে বাঘের চামড়া সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর বিদেশে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জসংলগ্ন গ্রামগুলোয় একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়। বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা করে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার হয়। স্থানীয়ভাবে একটি চামড়ার জন্য শিকারিরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশের চোরা বাজারে একটি চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা গেছে।
বন বিভাগের হিসাব অনুযাযী ২০০১ সালের ২০ নভেম্বর শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী এলাকা থেকে ১টি স্ত্রী বাঘ ও একই বছরের ১২ ডিসেম্বর চাদপাই সদর রেঞ্জ এলাকায় ১টি পুরুষ বাঘ ও ২০০৫ সালের ২৬ অক্টোবর একই রেঞ্জের বলেশ্বর নদীর পাড় সংলগ্ন বন থেকে বাধর্ক্য জনিত কারনে তাদের মূত্যু হয়েছিল। ২০০২ সালের ৯ সেপ্টম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া টহল ফাড়ি এলাকায় ১টি পুরুষ বাঘকে দুষকৃতকারীরা গুলি করে হত্যা করে, ২০০৩ সালের ২৮ মে চাঁদপাই রেঞ্জের নলবুনিয়া গ্রামে, ১৯ অক্টোবর শরণখোলা রেঞ্জের চালিতাবুনিয়া গ্রামে, ২১ ডিসেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া গ্রামে ও ২০০৯ সালে ২ জুলাই শরণখোলা রেঞ্জের রাজাপুর গ্রামে লোকালয়ে ঢুকে পড়লে গনপিটুনিতে মারা যায় ৪ টি বাঘ। এছাড়া ২০০৮ সালের ২৫ আগষ্ট শরণখোলা রেঞ্জের কাঠালতলার বেলায়েত হোসেনের বাড়ী থেকে ১টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়। ২০০৬ সালের ২ নভেম্বর শরনখোলা এলাকার নুরুজ্জামানের বাড়ী থেকে ১টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়, ২০০৭ সালের ২মে চাঁদপাই রেঞ্জের হাড়বাড়ীয়া টহল ফাঁড়ীর পুকুর পাড় থেকে ১ টি মৃত বাঘ উদ্ধার করা হয় ও ১৬ নভেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারী স্টেশনের ঘাঘরামারী ক্যাম্প এলাকা থেকে ১টি সিডরের আঘাতে মারা যাওয়া বাঘকে উদ্ধার করা হয়।
(একে/এএস/আগস্ট ০৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test