E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে চাঁই বুনে বছরে আয় ৫ কোটি

২০১৪ আগস্ট ১৮ ১৭:০৮:৩৫
শরীয়তপুরে চাঁই বুনে বছরে আয় ৫ কোটি

শরীয়তপুর থেকে, কাজী নজরুল ইসলাম : শুধু মাত্র বাঁশের তৈরি মাছ ধরার উপকরণ চাঁই বুনে ভাগ্য ফিড়িয়েছে পুরো তিনটি গ্রামের মানুষ। বছরের বেশির ভাগ সময়ই গ্রামের সকল বয়সের নারী পুরুষ শিশু আবাল বৃদ্ধ বনিতা প্রচুর পরিমানের অর্থ উপার্জন করছে এই কাজ করে। ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাজ করে ভাগ্য ফিরিয়েছে শত শত পরিবার।

যেখানে জোয়ারের পানির উৎস আছে সেখান থেকেই চাঁই দিয়ে মাছ ধরার সুবিধে রয়েছে। মাছ ধরার এই বহুল ব্যবহৃত উপকরন চাঁই বুনে (তৈরি করে) স্বচ্ছল হয়েছে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের পশ্চিম রামকৃষ্ণপুর, পূর্বরামকৃষ্ণপুর ও উত্তর ডুবুলদিয়া কাজী কান্দি গ্রামের অন্তত ১ হাজার ৫ শতটি পরিবার। এ শিল্প থেকে বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকা আয় করছে উদ্যোক্তা, শ্রমিক, শিক্ষার্থীসহ পুরো গ্রামের মানুষ।
প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা বাঙ্গালীর আবহমান কালের কৃষ্টি। বিশেষ করে দরিদ্র মৎস্যজীবী এবং অ-মৎস্যজীবী পল্লীবাসীরা বছরের সব মৌসুমেই নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় ও বিভিন্ন জ্বলাশয়-জলাধার থেকে মাছ শিকার করে। মাছ ধরার জন্য তারা ব্যবহার করে নানা উপকরন। এর মধ্যে জাল, ভেসাল, পলো, বরশি, কোঁচ, টেটা, যুতি, বইচনা ও দোয়াইর বা চাঁই অন্যতম। পল্লী অঞ্চলে মাছ ধরার সবচেয়ে পুরোনো ও আদী উপকরনের একটি হচ্ছে চাঁই।


গ্রীষ্মের শেষ সময় থেকে গ্রামাঞ্চলের খাল-বিল ও নদী নালায় শুরু হয় চাঁই দিয়ে মাছ ধরা। বিশেষ পদ্ধতিতে বাঁশ দিয়ে নদী-খালে, বিল-বাওড়ে গড়া দেয়া হয়। ২০ ফুট থেকে শুরু করে একেকটি গড়া ১০০ ফুটেরও বেশি লম্বা হয়ে থাকে। এই গড়ার ফাঁকে ফাঁকে ৪/৫ ফিট পর পর বসানো হয় একটি করে চাঁই। বাবুই পাখির বাসার মতো চাঁই এর প্রবেশ মুখের ধরন (প্যাটান) তৈরি করা হয়। পানিতে চাঁই দিয়ে শিকার করা হয় পুটি, বেলে, টেংরা, চিংড়ি,বাইন, পাবদা সহ সকল প্রকারের ছোট মাছ।
সরেজমিনে রামকৃষ্ণপুর ও কাজীকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, এই গ্রামের ১০ বছর বয়সের শিশু থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ বনিতা সকলে মিলে চাই বুনছে। কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ শলা তুলছে, কেউ শলা চাঁছছে আবার কেউবা ব্যস্ত হয়ে পরেছে চাঁই বুনা ও বাধার কাজে। ঘরের বারান্দায়, উঠানে, গাছের ছাঁয়ায় যে যেখানে পারছে সেখানে বসেই করছে চাঁই বানানোর কাজ। তিনটি গ্রামের প্রায় ১ হাজার ৫’শ ৫০টি পরিবারের ৪ হাজার শিশু, নারী ও পুরুষ জড়িত চাঁই বুনার কাজে। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় থাকবেনা গ্রামের মানুষ কতটা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে তাদের এই উপার্জনের প্রধান কাজটি করে। প্রায় চার দশক ধরে এই গ্রামে চাঁই বানানোর কাজ চললেও ব্যাপক ভাবে শুরু হয়েছে ৮/১০ বছর যাবৎ।
রামকৃষ্ণপুর ও কাজীকান্দি গ্রামের আঃ রব মাদরব, শহিদুল কাজী, শুকুর মাদবর, লাল মিয়া মাদবর, দুলাল সরদার, তোতা মিয়া খান, ঠান্ডু দেওয়ান, জলিল ছৈয়াল, সান্টু কাজী, সিরাজ মাদবর, মোমিন বেপারী রিপন মাদবর, হারুন কাজী, মোশারফ মাদবর, আক্কাস কাজী সহ ৩০/৪০ জন উদ্যোক্তা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তাদের বাড়িতে চাঁই বুনার ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এ সকল ব্যবসায়িরা মুলধন খাটিয়ে গ্রামের সকল দরিদ্র পরিবারকে সম্পৃক্ত করেছে চাঁই বানানোর কাজে। প্রতি সপ্তাহে এই গ্রামে ৮-১০ হাজার টি চাঁই উৎপাদন করা হয়। চাই গুলো প্রতি বৃহস্পতিবার বিক্রি হয় স্থানীয় কাজীর হাটে। জেলার চাহিদা পুরণ করে মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালীর লক্ষীপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর ও বরিশালের পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় এই চাঁই।
চাঁই তৈরির জন্য তল্লা ও মাখোল বাঁশ সবচেয়ে বেশী উপযোগী। এই বাঁশ গুলো যশোর ও নড়াইল থেকে আমদানী করা হয়। প্রতিটি বাঁশে ৬টি চাই হয়। প্রতি ১০০টি চাই বানাতে খরচ হয় ১২-১৫ হাজার টাকা। বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। শ্রমিকরা প্যাকেজ আকারে চাঁই বানানোর কাজ করে। পরিমান বা মাপ মতো বাঁশ কাটা, শলা তোলা, শলা চাঁছা, সুতা দিয়ে খোল বাধা, পাতাইস বা চটা বাধা, পাড় বা মুখ বাধা, চাঁন্দা বা মাছ বেড় করার তলা তৈরী ইত্যাদি একেক জন শ্রমিক একেক ধরনের কাজ করে থাকে। এতে প্রতিজন শ্রমিক গড়ে দৈনিক আয় করে ২ থেকে আড়াই শত টাকা। রামকৃষ্ণপুর গ্রামের বাইরেও মানিক নগর, ডুবলদিয়া ও মোল্যা কান্দি গ্রামের ৩/৪ শত লোক চাঁই বুনার ছুটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে উপার্জন করছে হাজার হাজার টাকা।
পৌষ মাস থেকে এই গ্রামে চাই বুনার কাজ শুরু হয়। চলে কার্তিক মাস পর্যন্ত। বছরের ৯ মাসই গ্রামবাসী ব্যস্ত থাকে চাঁই বুনার কাজে। এক মৌসুমে প্রায় ৫ লক্ষ চাঁই বানানো হয়। প্রতিটি চাঁই এর নির্মাণ খরচ হয় সব মিলে ১৫০ টাকা। শ্রমিকরা পায় একটি চাঁই বানানোর বিনিময়ে ৭০-৮০ টাকা। এই পল্লীতে মৌসুমে মালিক ও শ্রমিক মিলে চাঁই উৎপাদন করে আয় করে প্রায় ৫ কোটি টাকা।


চাঁই বুনন শ্রমিক মনির হোসেন খান ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, আমরা স্বামী স্ত্রী রাত দিন করে চাঁই বুনি। সপ্তাহের শেষে আমরা ৬/৭ হাজার টাকা করে বিল তুলি। বছরের ৯ মাস চাঁই বুনার কাজ করে আমরা অনেক ভালো আছি। আমাদের সংসারে কোন অভাব নাই।
অজুফা বেগম (৪০) বলেন, আমি ও আমার স্বামী, দুই মেয়ে এক ছেলে সহ সংসারের সবাই মিলে চাঁই বাধাইয়ের কাজ করি। ছেলে মেয়েরা স্কুল থেকে বাড়ি এসে পড়ার ফাকে ফাকে আমাদের সাহায্য করে। সপ্তাহে ৮-৯ হাজার টাকা উপার্জণ করি। আমরা ছেলে মেয়েদের নিয়ে খেয়ে পরে অনেক ভালো আছি। গ্রামে চাঁই বানানোর কাজ না থাকলে আমরা সুখের নাগাল পেতামনা।
চাঁই বানানোর শিশু শ্রমিক ৪র্থ শ্রেনীর খুকি আক্তার, ৮ম শ্রেনীর শাকিল, ৬ষ্ঠ শ্রেনীর দুদু মিয়া, ৫ম শ্রেনীর শাফিন ও ৭ম শ্রেনীর রানা জানায়, আমরা চাঁই এর পাতাইস বাধার কাজ করি। একটি চাঁইতে ৭টি পাতাইস থাকে। একটি পাতাইস বাধতে পারলে ২ টাকা মুজুরী পাই। স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে আমরা এই কাজ করি। সপ্তাহে প্রতি জনে ৫/৬ শত টাকার কাজ করি। স্কুল বন্ধ থাকলে বেশি আয় হয়। আমাদের লেখা পড়া ও কাপড় চোপড় কেনার টাকা আমরাই রোজগার করি। এই চাই বুনে আয় করা কারনে আমাদের এলাকায় মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে।
চাঁই বানানোর উদ্যোক্ততা আ. রব মাদবর বলেন, ২ লক্ষ টাকা মূলধন নিয়ে চাঁই তৈরির ব্যবসা করেছিলাম। যশোর ও নড়াইল থেকে বাঁশ এনে চাঁই বানাই। গ্রামের সকল মানুষ এই কাজের সাথে যুক্ত। বছরে ৮-৯ মাস আমরা এই কাজ করি। শীত মৌসুমে শুধু নিজেদের জমিতে রবি শস্যের আবাদ করি। অন্য মৌসুমে জমিতে কাজ করার সুযোগ না থাকায় জমি বর্গা দিয়ে দেই। তিনি আরো জানান, প্রতি মৌসুমে আমি অন্তত ২০ হাজার চাঁই তৈরী করে বিক্রি করি। এতে সব খরচ দিয়ে বছরে লাভ হয় ৫/৬ লক্ষ টাকা। তিনি জানান, তাদের উৎপাদিত চাঁই জেলার চাহিদা পুরন করে মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুরের হাইমচর, মতলব, বরিশালের মুলাদী ও হিজলা, ফরিদপুরের সদরপুর, পিয়াজখালীর পাইকার এসে কিনে নিয়ে যায়।
কাজী কান্দি গ্রামের হারুন কাজী বলেন, আমরা কোন রকম সরকারি সুবিধা পাইনা। আত্মীয় স্বজনদের থেকে ধারকর্জ করে, এনজিও থেকে উচ্চ হারে ঋণ নিয়ে ও গ্রাম্য সুদ নিয়ে চাই বানানোর ব্যবসা করি। জৈষ্ঠ্য থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত চাঁই এর চাহিদা বেশী থাকে। এ সময় কোন সরকারি সহায়তা পেলে আমরা আরো লাভবান হতে পারতাম।
শরীয়তপুর বিসিক এর ব্যবস্থাপক শাহ মো. নুরুজ্জামান বলেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে জাজিরার তিনটি গ্রামের সহাস্রাধিক পরিবার চাঁই বুননের সাথে জড়িত। তারা নিজেরা একটি ক্ষুদ্র কুটির শিল্প পল্লী গড়ে তুলেছেন। আমরা আগামী দিনে সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে টিকিয়ে রেখে এর প্রসারতা বৃদ্ধির জন্য চাঁই উৎপাদনকারিদের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করবো।
(এএস/আগস্ট ১৮, ২০১৪)








পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test