E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

বরিশালে নারিকেলের আইচার শো-পিস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

২০১৪ সেপ্টেম্বর ২৪ ১৭:৪২:৫২
বরিশালে নারিকেলের আইচার শো-পিস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে দেয়া নগদ ৩০ টাকা অনুদানে নারিকেলের ফেলে দেয়া অংশ আইচা দিয়ে বিভিন্ন শো-পিস তৈরি করে তাকে শিল্পরূপ দিয়ে আজ পুরোপুরি স্বাবলম্বী হয়েছেন আনোয়ার হোসেন (৬২)। ১৯৬৯ সালে সদ্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেই ৩০ টাকা না পেলে আজ এ পর্যায়ে আসা সম্ভব হতো না আনোয়ারের। তাই কৃতজ্ঞচিত্তে এখনো তিনি (আনোয়ার) স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুকে।

তার শো-পিস তৈরির কারখানায় প্রতিদিন ২০জন অসহায়, দুঃস্থ ও স্বামী পরিত্যাক্তা নারীরা কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকার বাসিন্দা মৃত মফিজ উদ্দিন আহমেদের পুত্র আনোয়ার হোসেন ও তার কুটির শিল্পের শ্রমিকদের নিপুণ হাতে তৈরি বাহারী সব পণ্য দেশ ছাড়িয়ে আজ বিদেশেও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। ভবিষ্যতে এসব বাহারি শো-পিস তৈরির জন্য একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে চান বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন। ১৯৬৮ সালে অস্টম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় তাকে দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামান্য আর্থিক অনুদানের ঋণ আজ শোধ করতে চান আনোয়ার। এ জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বারাক ওবামার জন্মদিন উপলক্ষে তার জন্য নিজ হাতে তৈরি করেছেন অসংখ্য বাহারী সব শো-পিস। কিন্তু কিভাবে তার এসব শো-পিস পৌঁছবে ওবামার হাতে তা নিয়ে আনোয়ার হোসেন পুরোপুরি চিন্তিত।


১৯৬৮ সালের শেষভাগে কিশোর আনোয়ার হোসেন নগরীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন স্কুলে অস্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় আলেকান্দা এলাকার বাসিন্দা মীর আনিস উদ্দিন আহমেদের কাছে নারিকেলের আইচা দিয়ে শো-পিস তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। অভাবী পিতার সংসারের হাল ধরার জন্য ১৯৬৯ সালের প্রথমাধ্যে আনোয়ার তার এক নিকট আত্মীয়ের কাছে ঢাকায় আশ্রয় নেয়। ওই আত্মীয় তৎকালীন পাকিস্তান বেতারের ড. দীন মুহাম্মদের বাসায় রঙ মিস্ত্রির কাজ করতেন। দীন মুহাম্মদের বাসার পার্শ্বেই ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন। একদিন আনোয়ার আইচা দিয়ে তার তৈরিকৃত বিভিন্ন শো-পিস সামগ্রী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশের পর তার সাথে দেখা হয় বরিশালের আ’লীগ নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুর। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য কারামুক্ত হয়েছেন।

আনোয়ার তার (মঞ্জুর) কাছে আইচা দিয়ে বানানো পণ্যসামগ্রীগুলো নিজহাতে বঙ্গবন্ধুকে উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য ইচ্ছে পোষন করেন। একপর্যায়ে আনোয়ারকে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের কাছে। আইচা দিয়ে বানানো নৌকা, বাংলাদেশের মানচিত্র, টেবিল লাইটসহ বিভিন্ন শো-পিস সামগ্রী দেখে মুগ্ধ হন বঙ্গবন্ধু। আনোয়ার হোসেন জানান, তার তৈরিকৃত আইচার শো-পিস দেখে খুবই আনন্দিত হয়ে বঙ্গবন্ধু তাকে একটি আদরের থাপ্পর দিয়ে বলেছিলেন, তুমি কী চাও? তখন তিনি (আনোয়ার) বঙ্গবন্ধুর কাছে এসব শো-পিস তৈরির যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ৩০ টাকা চেয়েছিলেন। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু দশ টাকার তিনটি নোট দিয়ে বলেছিলেন, যাও কাজ করে খাও। ওই টাকা দিয়েই আনোয়ার শো-পিস তৈরির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয় করে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আনোয়ার হোসেন। বঙ্গবন্ধুর আদরের থাপ্পর ও কাজ করার অনুপ্রেরণা আনোয়ার হোসেনকে আজো পীড়া দেয়।


দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে পুনরায় আইচা দিয়ে শো-পিস তৈরির কাজ শুরু করেন আনোয়ার। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই অনুপ্রেরণায় আনোয়ার হোসেন চালিয়ে যেতে থাকেন তার শিল্প সাধনার কাজ। ১৯৭৬ সালে নগরীর রূপাতলী এলাকার শেরেবাংলা সড়কের নিজবাড়িতে আনোয়ার হোসেন তার মায়ের নামে গড়ে তোলেন ‘হাসিনা কুটির শিল্প’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। একসময় তিনি একাই এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ২০ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজ করছেন। অতিসম্প্রতি এসব শো-পিসে প্রিন্টিংয়ের ছাঁপ দেয়ার জন্য একটি অত্যাধুনিক কালার লেজার প্রিন্টিং মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক কার্যক্রমে আনোয়ার হোসেনকে সহযোগীতা করছেন তার স্ত্রী রাশিদা বেগম, পুত্র এম.এ রশীদ আরিফ ও তরিকুল ইসলাম তারিক। আইচার শো-পিস তৈরিতে সাধারণত নারিকেলের আইচা থেকে শুরু করে শলা, বাঁশ ও কাঠ কাজে লাগানো হয়। আনোয়ার হোসেন জানান, নারিকেলের আইচা নগরীর বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয়। তবে বেশির ভাগ আইচা সংগ্রহ করা হয় স্বরূপকাঠী ও বাগেরহাট থেকে।

আনোয়ার হোসেন তার কুটির শিল্পের কারখানায় আইচা দিয়ে তৈরি করছেন-নৌকা, শাপলা ফুল, ফুলদানী, মোমদানী, চাবির রিং, বাংলাদেশের মানচিত্র, বিভিন্ন ধরনের পাখি, হাতি, মাকড়সা, ফুলের ঝাড়, বটবৃক্ষসহ প্রায় দু’শ ধরনের বাহারী শো-পিস ও গিফটসামগ্রী। তার এসব শো-পিসের মূল্য দশ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বরিশালের বাহিরে আনোয়ার হোসেন প্রথম পণ্য বিক্রি করেন রাজধানী ঢাকার চন্দন নামের একটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানে।


ওই প্রতিষ্ঠানে আইচার বাহারী মালামাল দেখে ঢাকার প্যারিস-সু হ্যান্ডিক্রাফট, বাংলাদেশ এজেন্সি এবং সিলেটের চন্দ্রিমা মার্কেটের বিসমিল্লাহ হ্যান্ডিক্রাফট ও কারুশিল্প আনোয়ারের কাছ থেকে মালামাল ক্রয় করা শুরু করেন। ১৯৮২ সাল থেকে প্রতিমাসে ঢাকার আড়ং কর্তৃপক্ষ আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে শো-পিস ক্রয় করে আসছে। এছাড়া নগরীর নামী-দামি দোকান থেকে শুরু করে দেশের কোথাও মেলা অনুষ্ঠিত হলে সেখান থেকেও আনোয়ার হোসেনের কাছে পণ্য নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা আসছেন। বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে আনোয়ার হোসেনের তৈরি বাহারী শো-পিস সামগ্রী। তার এ কুটির শিল্পের শ্রমিকেরা প্রতিদিন আট ঘন্টা কাজ করে আয় করছেন তিন হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩৬’শ টাকা পর্যন্ত। দীর্ঘ ২০ বছর এ কুটির শিল্পে কাজ করছেন স্বামী পরিত্যক্তা মোমেনা বেগম (৫০)।

তিনি জানান, এখানে কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়েই তিনি তার অভাবী সংসার পরিচালনা করে তিন কন্যা সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তার একমেয়ে উম্মে তাহরিনাকে পাত্রস্থ, অন্যমেয়ে উম্মে মমতাজকে মাষ্টার্স পাশ করানোর পর বর্তমানে সে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ও অপর মেয়ে উম্মে মোকারিমা বি.কম পাশ করেছে। কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে খুব শীঘ্রই নগরীর পাশ্ববর্তী কোন এলাকায় বাহারি শো-পিস তৈরির একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলবো। যেখানে দক্ষিণাঞ্চলের অসহায়, দুঃস্থ পরিবারের নারী ও পুরুষেরা এবং বেকার যুবক-যুবতীরা শো-পিস তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তুলবেন।

(টিবি/এএস/সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test