E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সর্বরোগের দাওয়াই দেন আয়নাল ফকির !

২০১৪ অক্টোবর ২১ ১৬:১৫:৪০
সর্বরোগের দাওয়াই দেন আয়নাল ফকির !

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : আধুনিক যুগে কুসংস্কারের বার্তা নিয়ে সর্বরোগের দাওয়াইর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে আয়নাল ফকির চক্র প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ-লাখ টাকা। পুলিশ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চলছে এ প্রতারণার মহাউৎসব। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করে ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে ফকিরী কেরামতি দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য সাহাবুদ্দিন ও তার সহযোগীরা। ঘটনাটি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের কাজীরহাট থানার প্রত্যন্ত সাত হাজার বিঘা গ্রামের।

সূত্র মতে, কথিত ফকির আয়নালের প্রতারণার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন মুলাদী উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের মৃত হাসেম বেপারীর ছেলে আনিস বেপারী। আনিস অন্য সকলের মতো অন্ধ বিশ্বাসে এসেছিলেন ফকির আয়নালের দাওয়াই নিতে। তিনি ছিলেন ডায়াবেটিকসের রোগী। তাকে ফু দেয়ার পরে তিনদিন অষুধ খেতে নিষেধ করে ভন্ড ফকির আয়নাল। আনিসকে বলে দেয়া হয়, ঝাড়-ফুঁকে তার রোগ ভাল হয়ে যাবে। বিশ্বাস করে আনিস তিনদিন অষুধ না খাওয়ায় সে মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্রে আরো জানা গেছে, ভোর থেকে সকাল ১১টা এবং বিকেল তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চলে আয়নালের ঝাড়-ফুঁক দিয়ে কথিত চিকিৎসা। প্যারালাইসিস, হৃদরোগ, মানসিক, পেটের ব্যাথা, হাঁটুর ব্যথাসহ সর্বরোগের চিকিৎসা প্রার্থীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে ফকির আয়নালের ফুঁ ও পানি পড়া নিতে আসেন। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে মসজিদ ও মাদ্রাসার ফান্ডের নামে বোতল প্রতি ১০টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছেন তার পালিত প্রতারক চক্রটি।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৬০/৬৫ জন অনুসারী নিয়ে গঠিত হয়েছে ফকির আয়নালের স্বেচ্ছাসেবক দল। আর এ দলের মূলহোতা ইউনিয়ন আ’লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য মো. সাহাবুদ্দিন ও স্থানীয় প্রভাবশালী কাজল মাষ্টার। প্রতিদিন আগত হাজার-হাজার মানুষের কাছ থেকে উঠানো টাকা রাতের বেলায় গোপনস্থানে বসে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়। সূত্র মতে, গড়ে দৈনিক উত্তোলনকৃত তিন লক্ষাধিক টাকা চার ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ পায় মসজিদ কমিটির নামে ইউপি সদস্য সাহাবুদ্দিন ও কাজল মাষ্টার। দ্বিতীয় ভাগটি পায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, তৃতীয় ভাগ কথিত স্বেচ্ছাসেবকরা এবং চতুর্থ ভাগ রাখা হয় কথিত ভণ্ড ফকির আয়নালের নামে স্থানীয় এক মসজিদের মুয়াজ্জিমের কাছে।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, কথিত ফকির আয়নালের কেরামতির পুরো বিষয়টি একটি কাল্পনিক ও সাজানো কাহিনী দিয়ে আধ্যাত্মিকতার নাম করে সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়ে প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। সরেজমিনে চিকিৎসা নিতে আসা শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে তাদের সুস্থ হওয়ার কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। প্রত্যেকেরই একই কথা, লোকমুখে শুনে তারা চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তবে ফকিরের স্বেচ্ছাসেবক নামের নিজস্ব দালাল চক্রটি হরহামেশা প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন, তারা নিজেরাও ভালো হয়েছেন এবং তাদের নিকট আত্মীয়রাও চিকিৎসা নিতে এসেছেন। ভণ্ড ফকির আয়নালকে পাহারা দিয়ে রেখেছেন কাজীরহাট থানার চারজন পুলিশ সদস্য।

সর্বরোগের চিকিৎসক কথিত ফকির আয়নাল ঘটনার সূত্র তুলে ধরে কল্পকাহিনী রচনা করে বলেন, আমি পেশায় একজন জেলে, নদীতে মাছ ধরে আমার জীবিকা চলে। প্রায় দেড় মাস পূর্বে রাতে কদমতলা নদীতে মাছ ধরে নৌকায় ঘুমিয়ে ছিলাম। গভীর রাতে নদীর মাঝখান থেকে সাদা পোশাকধারী একজন লোক এসে আমাকে বলেন, তুই আমাকে ওপার পার করে দিয়ে আয়। এরপর আমি তাকে মাছ ধরার নৌকায় পার করে দেই। এ সময় ওই লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুই কি ভয় পেয়েছিস? আমি বলি, না-ভয় পাইনি। তাহলে তুই কি চাস? জবাবে আয়নাল বলেন, না আমি কিছু চাইনা। একপর্যায়ে আয়নালকে হা করিয়ে অলৌকিক ওই লোকটি তার মুখে ফুঁ দিয়ে বলেন, তুই অসুস্থ লোকের গায়ে ফুঁ দিলে সে সুস্থ হয়ে যাবে। একই সাথে প্রতি ফুঁয়ের জন্য ১০টাকা করে নিয়ে ওই টাকা নিজে ব্যয় না করে স্থানীয় মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় ব্যয় করতে বলেছেন। পরেরদিন আয়নাল পরীক্ষামূলকভাবে স্থানীয় এক অসুস্থ যুবককে ফুঁ দিলে সে সুস্থ হয়ে যায়। এছাড়া প্রতিবেশীদের কতিপয় পক্ষাগ্রস্ত রোগীকে ফুঁ দিয়ে সুস্থ করেছেন বলে আয়নাল উল্লেখ করেন।


আধ্যাত্মিক এ কল্পকাহিনী প্রতারক চক্রের মূলহোতা ইউপি সদস্য সাহাবুদ্দিন ও তার সহযোগীরা এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ায় কিছুদিনের মধ্যে গত দেড় মাস ধরে প্রতিদিন আয়নাল ফকিরের কেরামতি চিকিৎসা নেয়ার জন্য দিন-রাত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নেয়ার জন্য পাশ্ববর্তী এলাকা থেকে হাজার-হাজার মানুষ ভিড় করতে থাকেন। এরমধ্যে নৌ-পথে ট্রলার, নৌকা এবং সড়ক পথে মোটরসাইকেল, টমটম, মাহেন্দ্র, ঈজিবাইক ও গাড়িযোগে মানুষ আসতে থাকে। প্রতিদিন দু’শিপ্টে দেড় কিলোমিটার বিস্তৃত ৪/৫টি দীর্ঘ লাইনে মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে বোতলে পানি, ভাতের মার ও সরিষার তেলে ফুঁ নিয়ে যায়। সে হিসেবে দৈনিক প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ফুঁ নিয়ে ১০ টাকা করে জমা দিলে প্রতিদিন আয় হয় তিন লাখ টাকা।

এ টাকার ব্যাপারে আয়নাল ফকির বলেন, আমার নামে প্রতিদিন কিছু টাকা আমাগো মেম্বার সাব জমা রাখেন। এরবেশি কিছু আমি জানিনা।

প্রতারক চক্রের মূলহোতা ইউপি সদস্য মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, আগত রোগীদের কাছ থেকে উঠানো টাকা মসজিদ কমিটির কাছে জমা দেয়া হয়। এছাড়াও স্বেচ্ছাসেবকদেরকে দৈনিক খরচ হিসেবেও কিছু টাকা দেয়া হয়। তবে আয়-ব্যয় ও মসজিদ কমিটির কোন প্রকার বৈধ কাগজপত্র তিনি দেখাতে পারেননি। বরং তিনি (সাহাবুদ্দিন) প্রলোভন দেখিয়ে এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন।

ভাষানচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম চুন্ন বলেন, বিষয়টি স্রেফ একটি প্রতারণা। এ ধরণের ধোকাবাজি বন্ধ করতে আমি একাধিকবার নিষেধ করা সত্বেও তা বন্ধ হয়নি।

পুলিশকে টাকা দেয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন দাবি করে কাজীরহাট থানার ওসি মো. জাহিদুর রহমান বলেন, প্রতিদিন আয়নালের কাছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। এত লোকের ভিড় সামাল দিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধে কিছু সংখ্যক পুলিশ দেয়া হয়েছে।

জেলা পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্লাহ বলেন, ঘটনার তদন্ত করে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল আলম বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

(টিবি/এএস/অক্টোবর ২১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test