E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গৌরনদীর ১৩ গ্রামের মানুষ সন্ত্রাসী নান্নু বাহিনীর কাছে জিম্মি

২০১৪ অক্টোবর ২৮ ১৫:৫৭:১২
গৌরনদীর ১৩ গ্রামের মানুষ সন্ত্রাসী নান্নু বাহিনীর কাছে জিম্মি

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : ১৩  গ্রামের হিন্দু, মুসলমান ও খ্রীষ্ট সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক নিরীহ জনসাধারণ এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী নান্নু বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ করায় অতিসম্প্রতি ওই বাহিনীর প্রধান নান্নু মৃধা ও তার সহযোগীরা কুপিয়ে খাদেম সরদার নামের এক মুসুল্লীকে খুন করে তার ছেলে আসলাম সরদারকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছে। এ ঘটনার পর ওইসব গ্রামের নিরীহ বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতংক বিরাজ করলেও নির্যাতিতরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

সন্ত্রাসী নান্নু ও তার বাহিনীর সদস্যদের জুলুম, অত্যাচার, শারিরীক ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চারটি পরিবারের সদস্যরা। ভূক্তভোগী গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে “গ্রাম পরিচালনা কমিটি” গঠনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী মোকাবেলায় এখন রাত জেগে পাহারা বসিয়েছেন। এনিয়ে ওই এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনাটি জেলার গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের।

অনুসন্ধানে বার্থী ইউনিয়নের মাদকের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত রাজাপুর, নন্দনপট্টি, বেজগাতি, উত্তর ধানডোবা, গোরক্ষডোবা, দক্ষিণ ধানডোবা, উত্তর মাদ্রা, বাঙ্গিলা, দক্ষিণ মাদ্রা, ধুরিয়াইল, সাজুরিয়া, চেঙ্গুটিয়া ও রামসিদ্ধি গ্রামঘুরে ভুক্তভোগী গ্রামবাসীদের সাথে আলাপকরে জানা গেছে, সন্ত্রাসী নান্নু বাহিনীর ভয়ঙ্করসব অজানা কাহিনী। সূত্রমতে, নন্দনপট্টি গ্রামের মৃত সফিউদ্দিন মৃধার বড় ছেলে পান্নু মৃধা ১৯৯৬ সালে বার্থী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তার সহদর নান্নু মৃধা ও সেন্টু মৃধা। ফলে খুব সহজেই গৌরনদীর শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রার্থীর হাবুল প্যাদার সন্ত্রাসী গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব পান নান্নু মৃধা। বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে হাবুল প্যাদা নিহত হওয়ার পর তার অস্ত্র ভাণ্ডার নান্নুর কাছেই অক্ষত থেকে যায়। পরবর্তীতে নান্নু তার নিজ নামে ‘নান্নু বাহিনী’ নামের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করেন। ওই বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব পালন করেন নান্নুর সহদর সেন্টু মৃধা ও কটকস্থল গ্রামের হারুন সিকদারের ছেলে আল-মাদানী সিকদার।

এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ২০১১ সালে নান্নু মৃধা নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রভাবে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি তাকে ও তার বাহিনীর সদস্যদের। বরিশাল জেলার উত্তর জনপদে মাদক সরবরাহের একক আধিপত্য বিস্তার করেন নান্নু বাহিনী। প্রতিনিয়ত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বিভিন্ন কৌশলে মাদকের বড় বড় চালান আসতে থাকে বাহিনীর প্রধান নান্নুর কাছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একাধিকবার বিপুল পরিমান মাদকসহ নান্নু ও তার দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড সেন্টু মৃধা এবং আল-মাদানী সিকদারকে গ্রেফতার করেন। কয়েকদিন পর আইনের ফাঁক ফোকর পেরিয়ে তারা জামিনে বেরিয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজ গ্রামসহ পাশ্ববর্তী ১২টি গ্রামে মাদকের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিয়ে একক আধিপত্যের জন্য সন্ত্রাসী ওই বাহিনীর প্রধান ও তার সহযোগীরা পুরো ১৩টি গ্রামকে জিম্মি করে ফেলেছে। সন্ত্রাসী নান্নু ও তার বাহিনীর সদস্যরা গ্রামবাসীকে জিম্মি করে শুরু করেন জমিদখল, জুলুমবাজি, অত্যাচার, শারিরীক ও পাশবিক নির্যাতন।

এজন্য তারা গোরক্ষডোবা গ্রামের জনৈক সিদ্দিক সন্যামাতের নির্মাণাধীন পরিত্যক্ত বিল্ডিং দখল করে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে। ওই সেল থেকেই বিভিন্নস্থানে মাদক সরবরাহ ও নারীদের ইজ্জত হরণ করা হতো। গ্রামবাসী সন্ত্রাসীদের অপকর্মের প্রতিবাদ করলে ওই সেলে বসেই তাদের শারিরিক নির্যাতন করা হতো।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সন্ত্রাসী নান্নু ও তার বাহিনীর বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ভয়ে কখনো কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। সূত্রে আরো জানা গেছে, নান্নু ও তার আরেক সহযোগী নিত্যানন্দ মণ্ডলসহ অন্যান্যরা গোরক্ষডোবা এলাকার প্রায় চার’শ একর জমিতে জোরপূর্বক বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। এতে জমির প্রকৃত মালিকরা বাঁধা প্রদান করায় সন্ত্রাসী নান্নু ও তার সহযোগিরা বিভিন্ন সময় খ্রীষ্ট সম্প্রদায়ের সাইমুন হালদার, জ্যাকব হালদার, বাকপ্রতিবন্ধী রিপন হালদার, হিন্দু সম্প্রদায়ের গৌরাঙ্গ বালা, কালাচাঁদ বালা, মুসলিম সম্প্রদায়ের হারুন হাওলাদার, রিজিয়া বেগম, ছালাম সেরনিয়াবাত, আফজাল চৌকিদার, মাওলা চৌকিদার, মোকলেচ মৃধাকে মারধর করে গুরুতর আহত করে। এছাড়া বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় আরো প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হয়। ওই সন্ত্রাসীদের জুলুম, অত্যাচার, বাড়ির গৃহবধূ ও যুবতী মেয়েদের পাশবিক নির্যাতন কিংবা হুমকির মুখে ইতোমধ্যে স্ব-পরিবারে দেশ ত্যাগ করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গৌর বালা, কৃষ্ণ দাস, চিত্ত দাস ও নারায়ন দাস।

নন্দনপট্টি গ্রামের শাহ আলম সরদার অভিযোগ করেন, গত এক বছর পূর্বে থানা পুলিশ বেজগাতি গ্রাম থেকে নান্নু মৃধার ৯’শ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেন। ওইসময় পুলিশ স্বাক্ষী হিসেবে তার নাম অন্তভূক্তি করায় সম্প্রতিসময়ে সে আদালতে নান্নু মৃধার বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য প্রদান করেন। এছাড়া অতিসম্প্রতি যশোর থেকে নান্নু মৃধার কাছে মাদকের চালান নিয়ে আসা এক মাদক সরবরাহকারীকে তিনিসহ এলাকাবাসী আটক করে পুলিশের কাছে সোর্পদ করেন। তিনি আরো জানান, মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করার জন্য তার বাবা খাদেম সরদার (৬০) অন্যান্য মুসুল্লীদের নিয়ে স্থানীয় সরদার বাড়িআকছা জামে মসজিদে বসে একাধিকবার বৈঠক করেন।

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসী নান্নু মৃধা, ও তার সহযোগী সেন্টু মৃধা, আল-মাদানী সিকদার, কবির ওরফে কালা কবির, জাফর, ওয়াসিম প্যাদা, পান্নু মৃধা, আবুল কালাম, সবুজ মৃধা, ফানজু মৃধা, শিমুল সরদারসহ ২০/২৫ জন সন্ত্রাসীরা গত ১৩ অক্টোবর এশার নামাজ শেষে খাদেম সরদার ও তার ছোট ছেলে আসলাম সরদার (২৫) বাড়ি ফেরার পথে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় বসে তাদের উপর্যুপরি কুপিয়ে ঘটনাস্থলেই খাদেম সরদারকে হত্যা ও তার পুত্র আসলামকে গুরুতর আহত করে।

এ ঘটনায় শাহে আলম সরদার বাদি হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করার পর পুলিশ সন্ত্রাসী আল-মাদানী সিকদারকে গ্রেফতার করলেও অদ্যাবধি অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেননি। অভিযোগে আরো জানা গেছে, বর্তমানে পুলিশী গ্রেফতার আতংকে আত্মগোপনে থেকেও সন্ত্রাসী নান্নু ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন মাধ্যমে মামলার বাদি, স্বাক্ষীসহ গ্রামবাসীকে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বারন করে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে।

স্থানীয় আব্দুল হক জানান, সন্ত্রাসী নান্নু মৃধা গত একবছর পূর্বে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আল-মাদানী সিকদারের সহযোগীতায় কটকস্থল গ্রামের কালাম মাঝির স্ত্রীকে অপহরন করে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করেন। তার (নান্নুর) বড় ভাই পান্নু মৃধা ও ছোট ভাই সেন্টু মৃধা তিনটি করে বিয়ে করেছেন। নিরাপদে বিভিন্নস্থানে মাদক সরবরাহের জন্যই তাদের একাধিক বিয়ের মূল কারণ বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসী। স্থানীয় সেলিম সরদার অভিযোগ করেন, বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী নান্নু মৃধা এবং তার বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ অভিযানে আসলেও তাদের লাঞ্চিত হতে হয়েছে ওই বাহিনীর হাতে।

এ ব্যাপারে বার্থী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান প্যাদা জানান, সন্ত্রাসী ও মাদক সম্রাটদের প্রতিহত করার জন্য গ্রামের জনসাধারণকে সাথে নিয়ে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

গৌরনদী থানার ওসি আবুল কালাম জানান, নান্নু মৃধা ও সেন্টু মৃধার বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ১২টি, আল-মাদানী সিকদারের বিরুদ্ধে বাউরগাতির এক যুবককে হত্যাসহ মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ৮টি এবং সেন্টুর তৃতীয় স্ত্রী সামচুন নাহারের বিরুদ্ধেও মাদক সরবরাহের অভিযোগে মামলা রয়েছে। তিনি আরো জানান, হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী আল-মাদানী সিকদারের কাছ থেকে গুরুতপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে তা গোপন রাখা হয়েছে।

জেলা পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্লাহ বলেন, সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে কেহ অপর্কম করে পার পাবেন না। আইনের কাছে তাকে ধরা পরতেই হবে। তিনি আরো জানান, খাদেম সরদার হত্যা মামলার সকল আসামিদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

(টিবি/এএস/অক্টোবর ২৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test