E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কামারুজ্জামানের ফাঁসির চূড়ান্ত রায়

সোহাগপুরের শহীদ পরিবারের বিধবাদের চোখে আনন্দাশ্রু

২০১৪ নভেম্বর ০৩ ১৬:৪৬:৪৫
সোহাগপুরের শহীদ পরিবারের বিধবাদের চোখে আনন্দাশ্রু

শেরপুর  প্রতিনিধি : আপিল বিভাগে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহাল থাকায় সোমবার আবারো কাঁদলেন সোহাগপুরের বিধবারা। তবে এবার তাদের চোখে বিষাদের কান্না নয়, ঝরে পড়ে আনন্দের অশ্রু। একাত্তরে স্বামী, সন্তান-স্বজন হারানোর বেদনায় তারা কেঁদেছিলেন বুকে পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর সোহাগপুর ঘটনার নায়ক আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের মানবতবিরোধী অপরাধে চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসির সাজা হওয়ায় শত কষ্টের মাঝেও স্বামী-সন্তান-স্বজনহারা এই বিধবাদের চোখে ঝরেছে আনন্দাশ্রু।

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায় শেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৬ কি.মি. দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। সেদিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের ৬ ঘন্টার তান্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন।

এদিন ভোরে পাকবাহিনী সোহাগপুর গ্রামের ক্ষেতে-খামারে ও ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষদের। পাষবিক নির্যাতন গ্রামের নারীদের ওপর। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘বিধবা পল্লী’। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের নির্দেশে সোহাগপুর গ্রামে এ গণহত্যা সংগঠিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানাল সোহাগপুরে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে ফাঁসির রায় দিয়েছিল। ৩ নভেম্বর সোমবার আপিল বিভাগও সেই মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে।

আপিল বিভাগের কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়ের কথা জানানো হলে সোহাগপুর বিধবপল্লীর শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া বলেন, যারা আংগর বেডাইনরে (পুরুষ মানুষ) মারছে, ওগর নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির সাজা অইছে, হুইন্না আংগর কইলজাডা তাও ইট্টু জুড়াইছে। শহীদ খেজুর আলী স্ত্রী জরিতন বেওয়া বলেন, কামারুজ্জামানের ফাঁসির কতাডা হুইন্না খুশী খুশী লাগতাছে। যিদিন ওরে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলাইয়া মিত্যু (মৃত্যু) অবো, অদিন মুনের জ্বালা জুড়াবো। একথা বলেই তিনি কাঁদতে থাকেন।

একাত্তরের সেই দিনের বিভীষিকার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, আমার সোয়ামী (স্বামী), পোলা (সন্তান) সহ আমগর পরিবারের আটজনেরে (৮ জনকে) গুলি কইরা মারা (হত্যা) মারে। আমার সোয়ামীরে ঘর থেইক্যা টাইন্যা অবাইর কইরা আইন্না, উঠানে ফালাইয়্যা ছয়ডা গুলি করে। গুলি খাইয়্যা পানি চাইলে আরেকটা গুলি করে। ওই গুলিতে উডানেই তার জীবন যায়। পরে আমার সোনা মানিক বুকের ধন হাশেমরে ধইর‌্যা নিয়্যা বাপের লাশের উফরে ফালাইয়্যা গুলি করে। এর পর আমার দেওররে ধইর‌্যা নিয়্যা বন্দুকের নল দিয়্যা কেচাইতে থাহে, পরে মুহের ভিতরে বন্দুক দিয়্যা গুলি করে। তহনি তার পরান বাইরইয়্যা যায়।

করফুলি বেওয়া জানান, আইজকা মনে একটু শান্তি লাগতাছে। দেশেও বিচার আছে। যা আরাবার সবতো গেছেই। অহন কামরুজ্জামানের ফাঁসির কতাডা হুইন্না বুকের কষ্টডা কিছুডা নামলো। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, কামারুজ্জামানেরা পথ না দেহাইলেতো পাক বাহিনীরা আমগর গেরাম চিনতো না। তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, হেইদিন ওরা আমার স্বামীরে মারছে, আমার ইজ্জত নষ্ট করছে। মান হারানোর পর স্বামীর গুলি খাওয়া লাশ কাঁথা দিয়া ঢাইক্যা গোয়ালঘরে রাইখ্যা ভয়ে পলাইয়্যা গেছিলাম। চাইর-পাঁচদিন পর আইস্যা শেয়াল, কুকুরে খাওয়া স্বামীর হাড়গোড় টুকাইয়্যা কোনমতে মাটি চাপা দিয়া রাখি।

যুদ্ধদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন জোবেদা বেওয়া, গুলির আওয়াজে তিনবছরের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়েছিলাম। সেখানেই কোলের বাচ্চাকে ফেলে দিয়ে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে দু’জন পাক সেনা। খুন করে স্বামী বাবর আলীকে। জবেদা বেওয়া জানান, ইজ্জত হারানোর কষ্ট, স্বামী হারানোর কষ্ট, সন্তান হারানোর কষ্ট বুকের ভেতর আগুন হইয়্যা জ্বলতাছে। আমার দুইট্যা সন্তান ভাতের অভাবে মরছে। আমি নিজে ২২ দিন শুধু সামান্য আটার জাউ খাইয়্যা বাইচ্যা আছিলাম। এই কুলাঙ্গার কামরুজ্জামানদের জন্যই আমাদের এই দশা। আইজ ওর ফাঁসির রায় হইছে। তর ফাঁসি না হওয়ার আগে আল্লোয় যেন দুনিয়া থাইক্কা আমারে না নেয়, এই আশাই করি।

শহীদ ছফির উদ্দিনের দুই ছেলে জালাল উদ্দিন ও আলাল উদ্দিন বলেন, কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়ে আমরা খুশি। বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারের স্বজনরা সবাই খুশি।

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায় শেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি. দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। সেদিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের ৬ ঘন্টার তান্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন। এদিন ভোরে পাকবাহিনী সোহাগপুর গ্রামের ক্ষেতে-খামারে ও ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষদের। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘বিধবা পল্লী’। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের নির্দেশে সোহাগপুর গ্রামে এ গণহত্যা সংগঠিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালে এই সোহাগপুরে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। সোমবার আপিল বিভাগের রায়ে সেই মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখে।

(এইচবি/এএস/নভেম্বর ০৩, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test