E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমনের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি

২০১৪ নভেম্বর ১৯ ১৭:১৭:১৮
আমনের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি

বগুড়া  প্রতিনিধি : আবার জমবে মেলা বটতলা-হাটখোলা, অঘ্রানে নবান্নের উৎসবে, সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায় বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে... বিখ্যাত এই গানের সাথে তাল মিলিয়ে বলা যায় এ বছর উত্তরের অধিকাংশ জেলায় বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল তবুও বন্যা পরবর্তীতে সময়ে কৃষকরা সোনার ফসলে লোভে কাদমার্ঘ শরীরে দিনরাত পরিশ্রম মাধ্যমে আমন ধান রোপন করেছিল। প্রকৃতির বিরূপ আচরণেও কৃষকের ঘাম-শ্রমের ফল বিফলে না গিয়ে সবুজ মাঠে আমনে সোনার ফসলে পরিণত হয়েছে, এ যেন স্বপ্নের মত।

উত্তরের মঙ্গাপীড়িত এলাকা রংপুরসহ প্রায় সব কটি জেলার পাশাপাশি বগুড়ায় এবারও আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ, গ্রামে-গঞ্জে নতুন ধান কাটা-মাড়াই যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এবছর ধানের ফলন ও বাজার মূল্য ভালো পাওয়ায় কৃষকদের মুখেও হাঁসির ঝলক। কৃষাণিরা মিষ্টি হাসি মুখে গুনগুন সুরে গান গাইতে গাইতে গোলায় ধান তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কালো ধোঁয়া চোখেমুখে লাগা উপেক্ষা করে ধান সিদ্ধর পর বাড়ির উঠানে মাটির কাদার প্রলেপ শুকানোর উদ্যোগ গ্রহনের কমতি রাখছেনা গৃহিনীরা।

এই নতুন ধান ঘরে তুলে গ্রামের সব কৃষক-কৃষাণি নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নতুন ধানের হবে অন্ন (ভাত) নবান্ন । এ উৎসব দেশের প্রায় সব কৃষক পরিবারই কমবেশী পালন করে থাকেন। তবে হিন্দু ধর্মাম্ববলী কৃষকরা অঘ্রানের প্রথম দিন থেকে সপ্তাহব্যাপী এমনকি পঞ্জিকা অনুযায়ী দিনক্ষণ দেখে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী নতুন ধানের অন্ন, নতুন চিড়া-মুড়ি-মুড়কি, নতুন ফল, নতুন তরিতরকারী, নতুন বস্ত্র পরিধানসহ কমপক্ষে ৯ প্রকার খাবার তৈরী করে উৎসবের মাধ্যমে তা সেবন করে থাকেন।

তাছাড়া পিঠা-পায়েশের আয়োজনতো রয়েছে খাবার তালিকায়। এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনেক পরিবারে নাইড় আনা হয় মেয়ে-জামাই,নাতি-নাতনী ও আত্মীয়স্বজনদের। দিনের শেষে এ উৎসবটিতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাতে গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মিলিত হয় জারিসারি ও পালা গানের আসরে। তবে এখন আর আগের দিনের মতো সেই পুরানো গানগুলো অনেকটা কম শোনা গেলেও এ উৎসবে ডিজিটাল যুগে আধুনিকতার ছোয়ায় সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া,সিডি,ডিভিডি মাধ্যমে নানা গান বাজনার মাধ্যমে এ উৎসবের আনন্দের স্বাদ নিতে ভুলে যাইনি কৃষক পরিবারের নতুন প্রজম্মরা। কালের বির্বতে পালা গান,জারি সারি,ধুয়াগান ইত্যাদি প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে গেলেও আধুনিকতায় ছোঁয়ায় আবার ঘিরে আসুক এ নবান্ন উৎসবের চিরাচরিত গীতিরীতি প্রতিষ্ঠিত হোক নবান্ন উৎসবের খুশির বারতা প্রতিটি কৃষক-কৃষাণীদের হৃদয়ে,নাড়া দিয়ে যাক আগামী সোনার ফসল ঘরে তোলার নতুন স্বপ্ন-নতুন উদ্দীপনা।বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্র জানায়, প্রাকৃতিকভাবে সবকিছু অনুকূলে থাকায় গত কয়েক বছর ধরে এ জেলায় ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে।

এ বছর এক লাখ ৮৪ হাজার ৫৩৩ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য ছিল। সেখানে চাষাবাদ হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার হেক্টরে। গত বছর প্রতি হেক্টরে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২.৮০ মেট্রিক টন। এবার ২.৯০ থেকে ৩.০০ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। গত জুলাইয়ের শেষে উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় জাতের চারা রোপন করা হয়। এর মধ্যে আগাম জাতের বিনা-৭, ব্রি৩৩, ৩৯, ৬২ ও রনজিত এবং বিআর-১ ও ১১, লাল পাইজাম, সাদা পাইজাম, স্বর্ণা, মামুন স্বর্ণা, লাল গুটি স্বর্ণা উল্লেখযোগ্য।

অপরদিকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় চলতি আমন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ২০,৯’শ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হলেও ২১,৫’শ হেক্টর অর্জিত হয়েছে। তবে বি-৪৯ জাতের ধানের সবচেয়ে বাম্পার ফলন হয়ে গত বছরের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে বলে উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুর রহিম জানিয়েছেন।অক্টোবরের শেষ দিকে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। সোমবার সকাল পর্যন্ত সবমিলিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। বুধবার সকালে বগুড়ার জেলার শেরপুর উপজেলা সদর প্রায় থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ভাদড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, মাঠে কৃষক নিজে বা কামলা দিয়ে ধান কাটছেন। ধানের ভালো ফলন ও বাজার দর ভালো হওয়ায় সব কৃষক খুশি। জমিতে ধান কাটার সময় কথা হয় ভাদড়া গ্রামের কৃষক ইউনুস আলীর সঙ্গে। তিনি এবার শেরপুর-রানীরহাট সড়কের পাশে নিজস্ব পৌনে দুই বিঘা জমিতে আগাম ব্রি-৪৯ জাতের ধানের চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় (৩৩ শতক) ১৭-১৮ মণ (প্রতি মণ ৪০ কেজি) ধান পেয়েছেন।

তিনি জানান, বর্তমানে মির্জাপুর হাটে প্রতি মণ ধান ৭৫০ থেকে ৭৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রতি মণে তার ৪৫০ টাকা খরচ হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি মণে তিনি ২৫০ থেকে ৩’শ টাকা লাভ করছেন। এ কারণে তিনি খুব খুশি। তিনি জানান, সার, সেচ, বীজের কোনো সংকট না থাকায় ভালো ফলন হয়েছে। এছাড়া এ বছর একজন কামলার দিনমজুরি ২৫০ টাকা। গত বছর ছিল কমপক্ষে ৩০০ টাকা।

একই কথা বললেন, কেল্লা- পোশী গ্রামে সুবোধ দাস। তিনি এবার তার নিজের দেড় বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় ১৮ মণ ধান পেয়েছেন। গ্রামের হাটে প্রতি মণ ধান ৭৫০ টাকা করে বিক্রি করেন। চাষের খরচ বাদে তার প্রতি মণে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা লাভ হয়েছে। গত বছর এ সময় ধানের দাম কিছুটা কম ছিল। কৃষকরা প্রতি মণ ধান ৬০০ থেকে ৬৭০ টাকায় বিক্রি করেন।উপজেলা আমইন, কেল্লাপোশী, ভাদড়া, পানিসারা, বিশলাপুরসহ বেশ কয়েক গ্রামে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, রংপুর,গাইবান্ধা, নিলফামারীসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলার দিনমজুর (শ্রমিক) ধান কাটতে এসেছেন। গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার ভাঙ্গামোড় গ্রামের কামলা আক্কাস আলী (৫৮) জানান, এবার তারা প্রতি বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াইয়ের বিনিময়ে এক হাজার ৭’শথেকে এক হাজার ৮’শ টাকা পাচ্ছেন। গৃহস্থরা থাকার জায়গা না দিলেও তিন বেলা পেটপুরে খেতে দিচ্ছেন।

একইরকম কথা বললেন, নিলফামারীর জলঢাকার কামলা আজাহার আলী। তারা ১২/১৩ জন ধান কাটতে বগুড়ায় এসেছেন। ভাদড়া গ্রামের হিন্দুপাড়ার এক গৃহস্থের জমির ধান কাটছেন। তারা দল বেঁধে ধান কাটার পর আঁটি বেঁধে গৃহস্থের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে ধান মাড়াই করা পর্যন্ত তাদের কাজ। এ ব্যাপারে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক বজলুর রশিদ রাজা জানান, গত কয়েক বছরের মতো এবারও আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তিনি জানান, সার ও সেচের সহজলভ্যতা, ভালো উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ, কৃষি বিভাগের সার্বিক সহযোগিতা এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ভালো ফলন হওয়ায় কৃষকদের বাড়িতে নবান্ন ও পিঠা উৎসব চলছে।

(এএসবি/এএস/নভেম্বর ১৯, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test