E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে অর্ধ লক্ষাধিক শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা অনিশ্চিত !

২০১৪ নভেম্বর ২৯ ১৬:৫৮:৩৪
শরীয়তপুরে অর্ধ লক্ষাধিক শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা অনিশ্চিত !

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : নানা সমস্যায় জর্জরিত শরীয়তপুরের চরাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষা। নদী ভাঙ্গা সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে স্কুলের সংখ্যা। হাজার হাজার শিশুর পাঠদান চলছে খোলা আকাশের নিচে, গাছ তলায়, রাস্তার উপরে ও মানুষের বাড়ির আঙ্গিনায়। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। জেলার মোট প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহনযোগ্য শিশুদের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার শিশুরই অবস্থান চরাঞ্চলে। চরের অনেক এলাকায় এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে না তোলায়, বহু স্কুলে একজন মাত্র শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করানো এবং বিলীন হওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনঃস্থাপন না করায় অন্তত ৫০ হাজার শিশুর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিপন্ন হতে চলেছে।

যে দিকে দৃষ্টি যায় শুধু পানি আর পানি। মাথার ওপর অখন্ড আকাশ আর পায়ের নিচে তপ্ত বালু। এরই মাঝে গড়ে উঠেছে নদী ভাঙ্গায় সর্বস্ব হারানো মানুষের বসতি। যাকে এক কথায় বলা হয় চর-চরাঞ্চল। শরীয়তপুর জেলার ১১ হাজার ৮১ বর্গ কিলোমিটার ভূখন্ডের ৩৭ শতাংশই চরাঞ্চল। আর এই চরাঞ্চলে বসবাস করে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষা গ্রহন সামর্থ প্রায় ৭০ হাজার শিশু। এদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার শিশুই বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে সরকারের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। কারন, জেলার চারটি উপজেলার অন্তত ১৫টি চরে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ না থাকায় মা বাবা তাদের শিশু-কিশোর সন্তানদের গড়ে তুলছেন কৃষি কামলা, জেলেসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমিক হিসেবে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় কোন কোন চরে এনজিও পরিচালিত দুই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তার মান নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন এবং প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল।

শরীয়তপুর জেলায় প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য সম্প্রতি শরীয়তপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু জেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শরীয়তপুর জেলার প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ চিত্র। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার ৬টি উপজেলায় ৬ শত ৬১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বর্তমানে শিশু শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৯৬ হাজার। এ হিসেব মতে প্রায় ৭০ হাজার শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে সুবিধাবঞ্চিত চরাঞ্চলে। এর মধ্যে মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অন্তত ১৫টি বিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৬ হাজার শিশু শিক্ষার্থীকে মাত্র ১ জন করে শিক্ষক দিয়ে পাঠদান পরিচালনা করা হচ্ছে। যেখানে ৪-৫ জন শিক্ষক থাকার কথা সেখানে রয়েছে মাত্র ২ জন শিক্ষক এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যাও প্রায় অর্ধ শতাধিক। সরেজমিনে গোসাইরহাট উপজেলার পূর্ব চরজালালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরজানপুর আবুল হাশেম প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার এই চিত্র। শিক্ষক স্বল্পতার কারনে একসাথে একই কক্ষে দুই/তিনটি করে শ্রেনীর পাঠদান করছেন একমাত্র শিক্ষক।


গেল বর্ষায় সর্বগ্রাসী রাক্ষুসী পদ্মার ছোবলে বিলীন হয়ে গেছে শরীয়তপুরের চরাঞ্চলের ৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভবন ভেঙ্গে গেছে আরো ১০টির। কোথাও ঠাই না পেয়ে এসব বিদ্যালয়ের অন্তত ৩ হাজার শিশুর পাঠদান চলছে খোলা আকাশের নিচে, পাকা সড়কের উপর, গাছ তলায় এবং মানুষের বাড়ির আঙ্গিনায়। গত বর্ষায় জেলার জাজিরা উপজেলার ৬নং নজুমদ্দিন বেপারীর কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নড়িয়া উপজেলা সুরেশ্বর-চরমোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোসাইরহাট উপজেলার ৭৭ নং চরমাদারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয়, একই উপজেলার দক্ষিন কোদালপুর আনন্দবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখনো ভাঙ্গন ঝুঁকিতে পদ্মা নদী থেকে মাত্র ২০ ফিট দুরে রয়েছে ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছুরিরচর প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাজিরা উপজেলার নওপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, নড়িয়া উপজেলার চরনড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত ২৫টি স্কুল।

গত এক দশকে শরীয়তপুরে বন্যা ও পদ্মা-মেঘনার অব্যাহত ভাঙ্গনে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে অন্তত ৬৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জেলার মোট ৬ শত ৬১ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর মধ্যে অতি প্রাচীন, জরাজীর্ণ, অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে ৩৩৫ টি বিদ্যালয়। এর বেশিরভাগই চরাঞ্চলে। দূর্যোগের কারনে প্রতি বছর শত শত শিশু ঝরে পরছে স্কুল থেকে। স্কুল ভেঙ্গে গিয়ে ঠিকমত পাঠদান না হওয়ায় চরাঞ্চলের হাজার হাজার শিশু এ বছর প্রাথমিক সমাপনি ও বার্ষিক পরীক্ষার আগে তাদের পূর্নাঙ্গ প্রস্তুতি গ্রহন করতে পারেনি। মাত্র ক‘দিন বাদেই নতুন বছরের নতুন শ্রেনীতে ভর্তি হতে গিয়ে শিশুরা খুঁজে পাবেনা অনেক স্কুলের অস্তিত্ব। তাই দুর্যোগ কবলিত এলাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিরা মারাত্মকভাবে শংকিত হয়ে পরেছেন তাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা জীবন নিয়ে।

নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া জাজিরার ৬ নং নজুমদ্দিন বেপারীর কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী শাহাদাদ হোসেন শান্ত, গোসাইরহাটের ৭৭ নং চরমাদারিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী সুমি আক্তার, দক্ষিন কোদালপুর স্কুলের শিক্ষার্থী রিয়াদ হোসেন বলেন, কয়দিন আগেও আমরা দোতলা স্কুলে পড়েছি। এখন গাছতলায় খোলা আকাশের নিচে পড়ি। আমাদের রোদে পুড়তে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। মাঝে মাঝে অসুস্থ্য হয়ে পরি। তারা সংবাদ কর্মীদের কাছে প্রশ্ন রাখে, নতুন বছরে নতুন ক্লাসে উঠেও কি আমাদের এভাবে রাস্তার ওপর ক্লাস করতে হবে?

চরজানপুর আবুল হাশেম বেপারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি খোকা মিয়া বেপারী বলেন, আমার স্কুলে সাড়ে ৪ শত শিক্ষার্থী। শিক্ষক মাত্র ১জন। তার দ্বারা কোন মতেই এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর পাঠদান সম্ভব না। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া না হলে এতগুলো শিশুর শিক্ষা জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। একই বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক ফারুখ হোসেন বলেন, আমার একার দ্বারা এতগুলো শিশুকে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। নতুন করে একাধিক শিক্ষক নিয়োগ না দিলে আমিও এখান থেকে চলে যাবার ব্যবস্থা করবো।

জাজিরা বড়কান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস. এম সিরাজুল ইসলাম বলে, গত বর্ষায় আমার ইউনিয়নের একটি দোতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় পদ্মা গর্ভে বিলীন হয়েছে। আরেকটি স্কুল থেকে নদীর দুরত্ব মাত্র ১৫ ফিট। এইটিও যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই, চরাঞ্চলেল শিক্ষা সহ মানুষের সহায় সম্বল রক্ষার জন্য একটি বেরী বাধ নির্মান করে দেয়া হোক।

গোসাইরহাটের দক্ষিন কোদালপুর গ্রামের অভিভাবক হাসিনা বেগম বলেন, প্রত্যেক বছরই নদীতে আমাদের ঘর-বাড়ি, জমি-জমা, স্কুল-মাদ্রাসা ভেঙ্গে নিয়ে যায়। এবছরও বাড়ির সামনের স্কুলটি নদীতে নিয়ে গেল। নতুন স্কুল না হলে আমরা ছেলে মেয়েদের কোথায় নিয়ে পড়াবো।

গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ নাসির উদ্দিন বলেন, আমর উপজেলার তিন দিকেই পদ্মা ও মেঘনা নদী পরিবেষ্টিত। সারা বছরই এই এরঅকার মানষ দূর্যোক ঝুকিতে থাকে। প্রতিবছরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীতে ভেঙ্গে নিয়ে যায়। এ বছরও দুইটি স্কুল ভেঙ্গে নিয়েছে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা মারাত্মক ঝুকিতে পরেছে। তারা গাছতলায়, খোলা আকাশের নিচে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। আমি গোসাইরহাটের দূর্যোগ ঝুকি কমানোর জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের অনুরোধ জানাবো।

শরীয়তপুরের প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক মানউন্নয়নের জন্য সম্প্রতি ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে পুরুস্কৃত হয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আলেয়া ফেরদৌসী শিখা, তিনি জানালেন, আমরা ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা নির্বাচিত হলেও সরকারের লক্ষমাত্রা অনুযায়ী মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জণ সম্ভব হচ্ছে না। জেলার চরাঞ্চলের ানেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর শিক্ষকশুন্য থাকছে। কাউকে নিয়োগ দিলে তারা রাজনৈতিক তদবির নিয়ে সুবিধামত স্থানে বদলি হয়ে যায়। এছারা অনেক এলাকায় এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি তাই শিশুরা শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

পুরুস্কারপ্রাপ্ত অপর কর্মকর্তা শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রাম চন্দ্র দাস বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলে শিক্ষার্থী ঝরে পরবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা ঝুকিপূর্ন স্কুলের ভবনগুলি মেরামত বা নতুনভাবে নির্মানের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের বরাবরে আবেদন করে যাচ্ছি। আশা করি অচিরেই এই সমস্যা গুলোর সমাধান সম্ভব হবে।

(কেএনআই/এএস/নভেম্বর ২৯, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test