E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখাতে পারেনি অজিত

২০১৪ ডিসেম্বর ০৬ ১৯:৪৭:১২
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখাতে পারেনি অজিত

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে বাবা-মা ভাই বোনকে অরক্ষিত রেখে শত্রুর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীন করতে দেশ মাতৃকার টানে জীবন বাঁজি রেখে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আগৈলঝাড়া উপজেলার পশ্চিম বাগধা গ্রামের মৃত লক্ষ্মী কান্ত মধুর ছেলে অজিত মধু।

দেশ শত্রু মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছে। সন্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা এই যোদ্ধার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুব শিবির নিয়ন্ত্রণ পরিষদ সভাপতি অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী (এমএনএ) স্বাক্ষরিত সনদ, ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়া হাসনাবাদের টাকি ক্যাম্প সনদ, প্রতাপপুর টাকি ক্যাম্পে এমএ জলিল স্বাক্ষরিত সনদ, ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস সনদ, একই সেক্টর কমান্ডার এমএ জলিলের রিকমান্ডেশন কার্ডসহ পাঁচ-পাঁচটি সনদপত্র থাকার পরেও স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখাতে পারেননি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সন্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত মধু। তার প্রশ্ন-আর কত সার্টিফিকেট থাকলে তাকে মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখাবেন স্ব-গোষ্টির যোদ্ধারা ? “শত্রুমুক্ত করতে ৯ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছি, এটা মনে হয় কোন যুদ্ধই ছিলনা ! এখন ইউনিয়ন কমান্ডারকে খুশি করিয়ে তার প্রত্যয়ন নিতে হবে। বিচিত্র স্যলুকাস এই দেশে!

মুক্তিযোদ্ধা অজিত মধুর ছেলে এসএসসি পরিক্ষার্থী সুমন জানায়, কষ্ট লাগে, যখন আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আমরা সমাজে তার স্বীকৃত পরিচয় দিতে পারি না। অথচ বিশেষ বিশেষ দিনে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রিয় সন্মানে ভূষিত হয়।

এতসব সার্টিফিকেট প্রাপ্তির পরেও তার নাম স্বাভাবিক নিয়মেই তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও লাল বই, মুক্তি বার্তা বা কোন গেজেটেই অজ্ঞাত কারণে তার নাম ঠাই পায়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের জন্য সকল জাতি ভেদাভেদ ভুলে কাজ করেছি। দেশ স্বাধীনের পরে “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক” বিবেচনা করে বঞ্চিত করা হয়েছে আমাদের। এভাবে তার এলাকায় আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলেও তিনি জানান।

সাংবাদিকদের সাথে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম না থাকার কারণ জানতে চাইলে প্রথমে তিনি কথা বলতে না চাইলেও এক পর্যায়ে স্ত্রী-সন্তানদের সামনে আক্ষেপ করে বলেন, “দেশে অ-মুক্তিযোদ্ধাদের টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়া হয়েছে, সেভাবেই আমার কাছেও সনদের জন্য বিশ হাজার টাকা চেয়েছিলেন বাগধা ইউনিয়ন বর্তমান কমান্ডার মজিদ সরদার। টাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখাবেন না বলেই আজও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠেনি তার ”।

এ সময় তিনি আরও বলেন, “তালিকায় কোন দিন নাম না উঠলেও টাকা দিয়ে তিনি তালিকাভুক্ত হবেন না। তার সার্টিফিকেট গুলো তিনি পেরেক মেরে ঘরে রাখবেন, যা ছেলে মেয়ে ও নাতী নাতনীসহ পরবর্তী প্রজন্ম দেখবে।”

দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে জেনে শুনে মৃত্যুর মুখে ঝাপিয়ে পড়া আত্মমর্যাদায় বলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা অজিত মধু অভিমানে আরও বলেন, “১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করি। ১৯৭১ সালে বরিশাল পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র। দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনে মনে মনে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকি। পরিবারের স্বজনদের ফেলে রেখে আগস্ট মাসে একই গ্রামের (বাগধা) দেবদাস রায় (বর্তমানে ভারত), উত্তর বাগধা গ্রামের লাল মিয়া মোল্লা, সাবেক মাস্টার সুলতান, বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আইউব আলী মিয়াসহ ১১ জন মিলে পালিয়ে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি গিয়ে উঠি। সেখান থেকে পালিয়ে যশোহরের গঙ্গারামপুর-মল্লিকপুর যাই। সেখান থেকে মল্লিকপুর ক্যাম্প কমান্ডার অদুদ তাদের নিয়ে যান ভারতে। যাবার পথে বন গাঁ’ এ দেখা হয় একই এলাকার সদ্য প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লব সমদ্দারের সাথে। বিপ্লব সমদ্দার তাকে পাঠিয়ে দেন হাসনাবাদের টাকি ক্যাম্পের ট্রেনিং সেন্টারে। টাকি কেন্দ্রে ৩ মাস কমান্ডার কবির হোসেনের কাছে অস্ত্র চালনাসহ যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল আয়ত্ব করেন তিনি। দীর্ঘ প্রশিক্ষণের সময় ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল প্রায়ই তাদের ক্যাম্পে যেতেন প্রশিক্ষন দেখতে। সেখান থেকে আরও উন্নত প্রশিক্ষনের জন্য তাকে পাঠানো হয় উরিষ্যার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানে ভারতীয় বশোংদ্ভুত একজন শিখ সম্প্রদায়ের কমান্ডারের কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন তিনি।

প্রশিক্ষণ শেষে মল্লিকপুরের ক্যাম্প কমান্ডার অদুদ ওই কেন্দ্রের ১৩ জন প্রশিক্ষিত যোদ্ধা তার ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। মল্লিকপুর থেকে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় বরিশাল সদরে। সেখানে পরিচিত হন অদুদ বাহিনী হিসেবে।

বরিশালে এসে ক্যাপ্টেন বেগ ও ক্যাপ্টেন ওমরের নেতৃত্বে প্রতাপপুর থেকে বরিশাল সদরে বর্তমান ওয়াপদা এলাকায় সন্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন তিনি। সারাদেশে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পন করা শুরু করে। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্র বাহিনীর কাছে পাক সেনারা আত্মসমর্পন করে। তবে বরিশালে আত্মসমর্পন করেনি তারা। ১৯ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সাথে শুরু হয় ভয়ানক যুদ্ধ। ওই দিন তাদের সাথে সন্মুখ যুদ্ধে ১৭ জন পাক সেনা মারা যায়। এরপর তারা ওয়াপদা এলাকা দখল করে বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন উপলক্ষে বিজয়ের বেশে বাড়ি ফিরে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত মধু।

এরপর জীবিকার প্রয়োজনে চলে যান ঢাকায়। এক সময় চাকুরি নেন তিতাস গ্যাসের ট্যাকনিশিয়ান পদে। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন সাভার অফিসে। তিন ছেলে, তিন মেয়েকে লেখা পড়া করিয়ে এখন অর্থনৈতিক দৈন্য দশার মধ্যে রয়েছেন তিনি।

তার স্ত্রী সুকৃতি মধু জানান, ৮/৯ বছর আগে নাম তালিকাভুক্তির জন্য লোকজন স্থানীয় বাজারে আসে। ওই দলে মুক্তিযোদ্ধা বিডিআর মজিদ (বর্তমানে মৃত) স্থানীয় তৈয়ব আলীও ছিল। তাদের কাছে কাগজপত্র গুলো দেখালে তারা বলে দেন “ এ কোন মুক্তিযোদ্ধাই না”। পরে দু’বছর আগে স্বামীর সহপাঠি বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আইউব আলী মিয়ার কাছে দু’বার গিয়েছিলাম। তারা সারা দিন উপজেলা সদরে ঘুরিয়ে বলে দেন তালিকা ভুক্তির জন্য ২০ হাজার টাকা লাগবে। তারা টাকা দিতে অস্বীকার করায় আর তালিকাভুক্তি হতে পারেননি। উপয়ন্ত না পেয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শুশান্ত বালার কাছে ছুটে যান এ দম্পতি।

সমাজসেবা কর্মকর্তা শুশান্ত বালা জানান, অজিত মধুর সকল কাগজপত্র দেখে তার আবেদন শুপারিশ করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করেছেন তিনি। তবে তদ্বিরের অভাবে আজও কোন সারা পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনলাইনে আবেদন করেছেন তিনি।

এ ব্যাপারে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আইউব আলী মিয়া বলেন, অজিত মধু “প্রকৃ মুক্তিযোদ্ধা”। কমান্ডের নেতার টাকা চাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা সঠিক সময়ে যোগাযোগ না করায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সরকারের সর্বশেষ দেয়া সুযোগ অন লাইন আবেদন করে থাকেন তবেই যাচাই বাছাইতে তালিকাভুক্তি হতে পারবে।


(টিবি/এটিআর/ডিসেম্বর ০৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test