E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শীত জেঁকে বসেছে আড়াইহাজারে

২০১৪ ডিসেম্বর ১১ ১৭:১৯:০২
শীত জেঁকে বসেছে আড়াইহাজারে

আড়াইহাজার থেকে ইমতিয়াজ আহমেদ : গোধূলী বেলায় গ্রাম্য মেঠো পথে ধূলোবালির জঞ্জাল আর দুরের ধানক্ষেত জুড়ে কুয়াশার আবরণ বলে দেয় প্রকৃতিতে ঋৃতুর পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত পেরিয়ে শীতের আগমনী বার্তা প্রকৃতির সর্বত্র। গেল সপ্তাহেও রাতে অনেকে পাখা ছেড়ে ঘুমোতে পেরেছেন। কিন্তু এখন সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে আকাশ। শীত জেঁকে বসেছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায়। গত দুদিন ধরে দিনের বেলায় সূর্যের মুখ দেখা গেলেও তাপমাত্রা কম।

সদর বাজার থেকে যার যার বাড়িতে ফিরতে গায়ে কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপন ধরায়। দিনে শীতের রূক্ষ্ম আবহাওয়ায় বৃক্ষ শাখায় ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি, ভোরের শিশির বিন্দুতে খুঁজে পাওয়া যায় চিরায়ত গ্রামবাংলাকে। বাজারে হরেক রকমের শাক-সবজিও বলে দেয় শীত এসেই গেল। সবাই প্রস্তুতি নাও শীত কিভাবে কাটাবে? রাতে গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিল কিম্বা বাউল গানের আসর বসে। গভীর রাতে দুর গ্রামের মাইকের হাই ভলিয়্যুমের আওয়াজ বাতাসে ভেসে আসে। কখনো ওয়াজ মাহফিলের বয়ান আবার কখানো উঁচু মার্গের বাউল গানের ঢোল , বাঁশি ও হারমোনিয়ামের আওয়াজ কানে সুধা বর্ষণ করে বৈকি !

অধিকাংশ বাউল গানের কথা স্পষ্ট বোঝা যায়না। গায়ক বা গায়িকারা এত উঁচু গলায় গান করেন যে , কখনো কখনো তা বিরক্তির ঠেকে। তবু ও তা আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশ। গ্রামের ছেলে বুড়ো সকলেই বাউল গান শোনেন রাত জেগে। যে গ্রামে বাউল গানের আসর বসে সে রাতে গ্রামটিতে উৎসবের ঢেউ লাগে। গানের মঞ্চের আশপাশে ছোটখাটো মেলা বসে যায়। বড় বড় কুপি নিয়ে বসে পিঠা , জিলাপী , গোলগোললা আর পেয়াজু বিক্রেতারা। ঝালমুড়ি ও ডিম বিক্রেতারাতো বিকেল থেকেই উপস্থিত । আমাদের প্রিয় উপজেলা আড়াইহাজারে শীত আসার সাথে সাথে এ সকল বিষয় নিয়মিত চোখে পড়ে।

পালাপার্বণ :
শীত ঝাঁকিয়ে বসেছে গ্রাম বাংলায়। রাতে কুয়াশা দেখে ঘুমোতে যাওয়া মানুষের ঘুম ভাঙ্গে সকালের শৈত্য প্রবাহ ও ঘন কুয়াশায়। সকাল ১০ টা অবধি সূর্য্যি মামার দেখা মিলেনা। গ্রামের কোননা কোন বাড়ীর উনুনে গরম ভাপা’র আয়োজন চোখে পড়ে। আড়াইহাজার উপজেলার সর্বত্র এখন উৎসবের আমেজ। ওয়াজ মাহফিল , উরস ও পালাগানের জমজমাট আসরের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামে বসছে মেলা । সবমিলিয়ে শীতের মৌসুমে জেগে উঠেছে আবহমান গ্রামবাংলা । ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। নতুন ধান উঠেছে। কৃষকের মুখে হাসি। পালা-পার্বনের মধ্যে দিয়ে কৃষাণ কিষাণী একটু আনন্দ পভোগ করার ফুরসত পায়। রাতের পর রাত কেটে যায় জারী সারি গানের আসরে। তারই পাশে ছোট মেলা। গরম জিলাপি। নিমকী ভাজা। ধোয়া তোলা ভাপা। সব দু:খ বেদনা ভুলিয়ে দেয় । এটাই চিরায়ত গ্রামবাংলার ঐতিহ্য।

জারী-সারি গানের আসরে রাত কাটিয়ে আনন্দ পান এমন একজন যুবক আনোয়ার হোসেন এর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন , ‘ আড়াইহাজারের প্রতিটি ইউনিয়নে একটা না একটা বুজুর্গ লোকের মাজার বা পীরের ভক্তদের আস্তানা আছে। ফলে শুকনো মৌসুম আসলেই উরস ও বাউল গানের আসর জমে উঠে। রাত জেগে গ্রামের মানুষ ওয়াজ শুনে আবার বাউল গান ও উপবোগ করে। শীতের দিন আসলে গ্রামে গ্রামে মাইকের শব্দ শোনাযায়। বাউল গানের শব্দ শুনলেই দল বেধে সবাই যায় গান শুনতে।’

এখানে অবশ্য নভেম্বর থেকেই শীত হাজির। ডিসেম্বরে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। বাউল গানের আসরে ঢোল-বাঁশির সাথে মাথা দুলিয়ে ছন্দে তাল মেলায় ছেলে বুড়োর দল। তাছাড়া অদ্ভুত ভাষা ও মিউজিকের শব্দ ও মাঝে মধ্যে কানে আসে। কলেজ পড়–য়া পাড়ার ছেলেরা হাই ভলিউমে মিউজিক ছেড়ে র‌্যাকেট খেলে পল্লী বিদ্যুতের আলোয়। রাত গভীর হতেই কোথাও খেকিয়ে উঠে খেক শিয়ালের দল। শীতের তীব্রতা যতই বাড়ছে বাজারে শীত বস্ত্রের চাহিদা বাড়ছে। সে সাথে বাড়ছে শীতবস্ত্রের দাম।

শীতবস্ত্র :
শীতাতুর লোকজন গরম কাপড় কেনার জন্য দোকানে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন। বাজারে বড় বড় শপিংমলের কাপড়ের দোকানের পাশাপাশি ফুটপাতের দোকানগুলোতেও শোভা পাচ্ছে বাহারি শীতবস্ত্র। ব্যবসায়িরা জানান , এবার গতবারের তুলনায় গরম কাপড়ের দাম একটু বেশি। তারা জানান , শীতবস্ত্রের দাম এবার প্রায় ৪০ শতাংস বেড়েছে। এর কারন হিসেবে তারা অবরোধের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তারপরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে , শীতের টুপি , চাঁদর , মাফরার , হাতমোজা , জ্যাকেটসহ দোকানে দোকানে শীতের বাহারি পোষাক।

লেপ তোষক :
শীত আসার সাথে সাথে জেগে উঠেছে ফতেহপুর ইউনিয়নের বৃহত্তর বগাদী গ্রাম। এই গ্রামটি লেপ তোষকের গ্রাম হিসেবে সমধিক পরিচিত। এখানে তুলা দিয়ে লেপ তোষক তৈরি হয়না। তুলার বদলে ব্যবহার করা হয় পাটের উচ্ছিস্ট। যাকে লেপ তোষকের কারিগরেরা জুট বা ফেউয়া বলে চিনে থাকে। তবে গ্রামের কয়েকজন পুরনো মহাজন পাটের উচ্ছিস্টের (ডাস্ট) বদলে গার্মেন্টেস্ এর জুট কাপড়ের তৈরি কৃত্রিম তুলা ব্যবহার করে। অধিকাংশ মহাজন পাটের ডাস্ট দিয়ে তোষক তৈরি করে। পাটের ডাস্ট দিয়ে তৈরি তোষকে লাভ বেশি। গার্মেন্টস্ এর জুটের তুলার তৈরি তোষকে পুঁজি বেশি লাগে অথচ লাভ কম। এ কারনে এই গ্রামের অধিকাংশ মহাজন পাটের ডাস্ট দিয়ে তোষক তৈরিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

পাটের উচ্ছিস্ট (ডাস্ট) দিয়ে তৈরি একটি তোষক এর পাইকারী দাম ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। তোষকগুরো সাধারণত ৪/৫ হাত ও ৫/৬ হাত সাইজের হয়ে থাকে। আবার কখনো জ্জ হাত সাইজের সবচেয়ে ছোট মাপের তোষক ও বিক্রি হয়। মহাজনের বাড়ী থেকে পাইকারী দামে কিনে খুচরো বিক্রেতারা ফেরিকরে লেপ তোষক বিক্রি করে থাকে। ৩৫০ টাকার লেপ তোষক সর্বোচ্চ ৫’শ থেকে ৬’শ টাকায় বিক্রি করতে পারে ফেরিওয়ালারা। তবে শীত ঝেঁেক বসলে পাটের ডাস্টের তৈরি এ সকল নিম্নমানের লেপ তোষক ৭/৮ ’শ টাকা বা কখনো ১ হাজার টাকায় ও বিক্রি হয়।


এ দিকে, গার্মেন্টস এর জুট কাপড়ের তুলা দিয়ে তৈরি লেপ তোষকের দাম পাটের ডাস্ট দিয়ে তৈরি লেপ তোষকের দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কাপড়ের তুলার তৈরি লেপ তোষক সাধারণত তিন সাইজের হয়। ৩/৪ হাত, ৪/৫ হাত ও ৫/৬ হাত সাইজের লেপ তোষকের চাহিদা সব সময়েই বেশি। ৩/৪ হাত সাইজের একটি লেপ তোষকের পাইকারী দাম ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। ৪/৫ হাত সাইজের দাম ৮০০ টাকা এবং ৫/৬ হাত সাইজের দাম ১০০০ টাকা।

একজন তোষক ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘আমি প্রথমে ১০ গজ করে কাপড় কেটে দিই। সেই কাপড় সেলাই করে লেপ বা তোষকের আকার দেয় একজন কারিগর। সুই সূতা আমাদের । একটি কাভার সেলাই করতে মজুরী মাত্র তিন টাকা। কাভার সেলাইয়ের পর তাতে তুলা ভরে পুণরায় ফিনিসিং সেলাই দিয়ে একটি লেপ বা তোষক তৈরি সম্পন্ন করেন একজন বা দুইজন কারিগর। এই ক্ষেত্রে মজুরি মাত্র ৩০ টাকা। দুইজনে মিলে কাজ করলে মজুরী সমানভাবে ভাগ করে নেয়। একজন কারিগর দিনে দেড়শ থেকে দুই’শ টাকা রোজগার করতে পারেন।


লেপ তোষকের চেয়ে জাজিমের কারিগর মজুরি সবচেয়ে বেশি। কাভার সেলাই ৩ টাকা হলেও কমপ্লিট করার মজুরি ১০০ টাকা। একজন কারিগরের পক্ষে দিনে দুইটির বেশি জাজিম তৈরি করা সম্ভব হয়না।’

আবু হানিফ,আবু সাঈদ (২৬), সফিকুল (২৩), শাহলম (২০), মামুন (২৮) ও ছাইদুল (৩২) এর মত বৃহত্তর বগাদী ও আশপাশের শতাধিক যুবক শীতের সিজনে ফেরি করে লেপ তোষক বিক্রি করে। বছরের অন্য সময়ে দিনমজুরি সহ নানা ধরনরে কাজকর্ম করে থাকেন। নভেম্বর থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত তারা নিয়মিত ফেরি করে লেপ তোষক বিক্রি করে । এদের মধ্যে কেউ কাঁচামাল ( পাটের ডাস্ট) কিনে এনে নিজেরাই রেপ তোসক তৈরি করে। আবার কেউবা মহাজনের বাড়ী থেকে পাইকারী দরে লেপ তোষক কিনে এনে ফেরি করেন।

কথা হয় বগাদী মোল্লাপাড়া গ্রামের মৃত আলাউদ্দিনের ছেলে আবু সাঈদের সাথে। আবু সাঈদ বলেন, ‘আমি নিজেই পাটের ডাস্ট রূপগঞ্জের কাঞ্চন থেকে কিনে এনে লেপ তোষক বানাই। আমার বড় ভাই ও একই ব্যবসা করেন। লেপ তোসক তৈরির পর তা ফেরি করে বিক্রি করে থাকি। এটাই আমাদের পেশা। সপ্তাহে ৪ দিন ফেরি করি। ৩৩টি মাল (তোষক) নিয়ে আমরা ৬ জন একটি ভটভটি ভাড়া নিয়ে মোকামে বের হই। মূলত শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে আমাদের মালের (লেপ তোষক) চাহিদা বেশি। সাভার, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, ভৈরব, নরসিংদীসহ অন্যান্য জেলাগুলোতে গিয়ে আমরা মোকাম করি। একটি ভটভটিতে ৩৩ টির বেশি মাল নেয়া যায়না। সকল খরচবাদে সপ্তাহান্তে ( ৪ দিন) ৪/৫ হাজার টাকার মত আয় হয়। এতে করে সমিতির কিস্তি চালিয়ে আমাদের সংসারটা ভালমতন চলে যায়। লেপ তোষক নিয়ে আমাদের বাকি জীবনটা কেটে যাবে।’

(আইএম/এএস/ডিসেম্বর ১১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test