E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নওগাঁর বধ্যভুমিগুলো আজো অরক্ষিত

২০১৪ ডিসেম্বর ১৮ ১৪:০৯:৩৯
নওগাঁর বধ্যভুমিগুলো আজো অরক্ষিত

নওগাঁ প্রতিনিধি : একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষা নওগাঁ জেলার বীরত্বগাঁথা অবদানকে বিন্দুমাত্র খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এখানকার শত শত মুক্তিকামী বাঙ্গালী  বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। তারা জীবন দিয়েছেন অকাতরে।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাঁরা ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের পাশাপাশি নওগাঁ সদরের দোগাছী ডাঙ্গাপাড়া পুকুরপাড়, ফতেপুর গড়েরহাট, রানীনগরের আতাইকুলা, আত্রাইয়ের মিরাপুর ও মান্দার পাকুড়িয়ায় যে কয়েক শ’ মুক্তিকামী মানুষের লাশ স্তুপাকারে শায়িত করে গনকবর দেয়া হয়েছিল, সেই বেদনা বিধুর স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভুমিগুলোর কথা অনেকেই ভুলতে বসেছে। এর মধ্যে দু’টির স্মৃতিচিহৃ কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও অন্য তিনটির কোন স্মৃতিচিহৃ নেই। নতুন প্রজন্মরা জানেই না, ওই স্থানে পাকি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর এদেশীয় রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় কি নির্মমভাবেই না নীরিহ মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়েছিল! শুধু তাদের স্বজনরাই মনে রেখেছে সেদিনের সেই নির্মমতার কথা।

একাত্তরের ২৫ এপ্রিল পাকি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় নওগাঁ সদরের পিরোজপুর ও খিদিরপুর গ্রাম (বর্তমানে পৌর এলাকা) থেকে প্রায় অর্ধশত মুক্তিকামী নীরিহ মানুষদের ধরে পাশ্ববর্তী দোগাছী ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের পুকুরপাড়ে হাত-চোখ বেঁধে লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। সেখানে ৩১ জন শহীদ হন। তারা হলেন, পিরোজপুরের আয়চাঁদ টিকাদার (৪৫), রশিদ তালুকদার (রশিক) (৪৫), চেরু প্রামানিক (৪৫), কুড়ানু সাহানা (৫২), ইউনুছ আলী (১৫), শামসুল হক (১৪), খিদিরপুরের আবুল কাশেম (৫২), জহির মুন্সী (৫০), নছির মুন্সী (১৮), গমন মুন্সী (৪০), রাজ্জাক সোনার (১৯), শমসের মুন্সী (২৩), খোয়াজ সরদার (২৭), কুশা টিকাদার (৩৭), আয়েজ সরদার (৪৫), রহমান মৃধা (১৮), কামেজ সোনার (৩৫), কবির সোনার (৪০), খুদু সরদার (৩৫), বেলায়েত হোসেন (৪৫), হাবিল প্রামানিক (৪৮), মোকাম্মেল প্রামানিক (১৮), জব্বার প্রামানিক (২৫), দিলার প্রামানিক (২৫), ফুলচাঁদ (৫০), রওশন আলী (৪৫), মেহের আলী (৪৮), ময়েজ প্রামানিক (৪৮), আয়েজ উদ্দিন (৩৫), আনছার প্রামানিক (২৮) ও আয়েন উদ্দিন প্রামানিক (৩৩)। এই বধ্যভুমি চিহিৃতকরনে বা রক্ষনা-বেক্ষনে কোন মহলই এগিয়ে আসেনি আজো। ফলে শহীদদের কোন স্মৃতিচিহৃই নেই সেখানে। একইদিন সদরের ফতেপুর গড়েরহাটে দেবীপুর, ফতেপুর ও কাদোয়া গ্রামের ১৩ মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। বধ্যভূমিটি আজও চিহিৃতকরন করা হয়নি। ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের।

রানীনগর উপজেলার আতাইকুলা গ্রামের বধ্যভুমিটি আজো অবহেলিত। একইদিন অর্থাৎ ৭১’ এর ২৫ এপ্রিল ঘাতকদের ব্রাশ ফায়ারে আতাইকুলা হিন্দুপাড়ার পাল সম্প্রদায়ের ৫২ মুক্তিকামী মানুষকে হত্যার পর বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন সেখানে একটি গর্ত খুঁড়ে স্তুপাকারে লাশ রেখে মাটিচাপা দেয়। ৯৭’ সালে তৎকালীন সংরক্ষিত আসনের এমপি শাহিন মনোয়ারা হক সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মানের উদ্যোগ নিয়ে কিছু গম বরাদ্দ দেন। যা দিয়ে প্রাচীর বেষ্টনী আর শহীদদের নামফলক তৈরি করা হয়েছে মাত্র। পরবর্তীতে এখন পর্যন্ত আর কোন অগ্রগতি হয়নি।

এছাড়া আত্রাই উপজেলার মিরাপুর গ্রামে আরেক বধ্যভূমির সন্ধান মিলেছে। ৭১’ এর ১০ জুলাই সেখানে আত্রাইয়ের মিরাপুর ও রানীনগরের কৃষ্ণপুর গ্রাম থেকে ধরে এনে কয়েক মুক্তিযোদ্ধাসহ ২২ মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। ওই বধ্যভূমিটি চিহিৃতকরণ বা সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

অপরদিকে, নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৭ কি.মি. পশ্চিমে মান্দা উপজেলার একটি নিভৃত গ্রাম পাকুড়িয়া। ৭১’ এর ২৮ আগষ্ট পাকি হানাদাররা স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে শান্তি বৈঠকের নামে গ্রামের নীরিহ শান্তিকামী মানুষদের ডেকে জড়ো করে গ্রামের ইউনাইটেড স্কুল মাঠে। সেখানে পাকি হানাদাররা গ্রামের লোকজনদের মাঝখানে বসিয়ে রেখে চারপাশ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছিল ১২৮ মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে। এদের মধ্যে ৭৩ জনের পরিচয় জানা গেলেও ৫৫ জনের কোন নাম-ঠিকানা মেলেনি আজো। হানাদার বাহিনী চলে যাবার পর এলাকাবাসী লাশের স্তুপ সারিবদ্ধ করতে গিয়ে ১৮ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে। মৃত ১২৮ জনকে তাদের পার্শ্ববর্তী হাজি সাহেবের জমিতে গণকবর দেয়া হয়। ইতিহাসখ্যাত এই বধ্যভুমিটি সংরক্ষণ বা এখানে কোন স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সরকারি কোন উদ্যোগ আজো নেয়া হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামীলীগ সরকারের শাসনামলেই জেলার বধ্যভূমিগুলো চিহিৃত করে সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি করেছেন নওগাঁবাসী।

(বিএম/এএস/ডিসেম্বর ১৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test