E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বরিশালের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্প আজ শুধুই স্মৃতি

২০১৫ ফেব্রুয়ারি ০২ ১৪:৪৯:৪৯
বরিশালের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্প আজ শুধুই স্মৃতি

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : হৈ হৈ কাণ্ড আর রৈ রৈ ব্যাপার। যাত্রা-যাত্রা-যাত্রা। সময়ের আলোচিত রোমান্টিক জুটি মার্শাল আর্ট হিরো সুপার স্টার কুমার দেবদাস ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত নায়িকা যাত্রা লক্ষ্মী ও চন্দ্রা ব্যানার্জী অভিনীত, বঙ্গোপসাগর বিধৌত উপকূলীয় অঞ্চল থেকে গঠিত বরগুনার পাথারঘাটার নিউ রাজমহল অপেরার আজকের ধামাকা রজনী সোহরাব-রুস্তম। এতে অভিনয় করবেন শক্তিমান অভিনেত্রী শেফালী রানী, শক্তিমান অভিনেতা সুকুমার বিশ্বাস, খ্যাতিমান খলনায়ক বিকাশ মন্ডল ও মমতাময়ী মা মমতা বিশ্বাস। সাথে রয়েছে আজকে রাতের মঞ্চ কাঁপানো ড্যান্সার জিরো জিরো সেভেন শিল্পী সাহা। বরিশালের মাঠে-ঘাটে, হাট-বাজারে ও গ্রাম-গঞ্জে প্রচারকর্মীদের এমন মন ভোলানো মাইকিং এখন কেবই স্মৃতি। 

এক সময়ের বিনোদনের প্রধান অবলম্বন যাত্রাগান গ্রামবাংলার মানুষকে উৎসবে মাতিয়ে রাখতো। এ শিল্পকে ঘিরে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিলো। শীত মৌসুমের শুরুতেই যাত্রাগানের ধুম পড়তো। তখন যাত্রার প্যান্ডেলে উপচে পড়তো সকল শ্রেণীর দর্শক-শ্রোতা। মঞ্চের দুইদিক ঘিরে বসে মিউজিশিয়ানরা বাজনা বাজিয়ে যাত্রার প্রারম্ভ ঘোষণা করতেন। বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক, শিশু-কিশোর ও মহিলারা সম্মোহনী আক্রান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকতেন মঞ্চের দিকে। যাত্রামঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হতো। করতালিতে রাতের নীরবতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেতো। দর্শকদের আনন্দ দেয়ার সে যাত্রা আজ চোখে পড়েনা। কালের আবর্তে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্প আজ শুধুই স্মৃতি। সেসব স্মৃতি এখনও শিল্প মনা মানুষে তাড়িয়ে বেড়ায়।

সম্প্রতি সময়ে জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার বাজারের সন্নিকটে উন্মুক্ত যাত্রাগান শেষে কথা হয় আটবছর বয়স থেকে এ শিল্পের সাথে জড়িয়ে থাকা গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাটকেলবাড়ি গ্রামের গ্রাম পুলিশ মন্টু বিশ্বাসের মেয়ে শক্তিমান অভিনেত্রী শেফালী রানী গাইন (৩৮) ও শিখা হালদারের (৪৫) সাথে। সম্পর্কে তারা দু’বোন। তাদের পরিবারের চার জন যাত্রাশিল্পের সাথে জড়িত। শেফালী ও শিখা রানী দু’জনেই সর্বপ্রথম শিশু শিল্পী হিসেবে যাত্রা শিল্পে প্রবেশ করেন।

পরবর্তীতে নায়িকা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বর্তমানে বয়স বেড়ে যাওয়ায় তারা বৌ-রানী কিংবা মায়ের চরিত্রে অভিনয় করছেন। তাদের রয়েছে বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ ও গোপ্তর গাতি জয়বাংলা সৌখিন নাট্যগোষ্ঠির পরিচয়পত্র। এছাড়াও চার হাজার যাত্রা শিল্পীদের নিয়ে গঠিত পাটকেলবাড়ি মা শিল্পী সাংস্কৃতিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেফালী রানী দীর্ঘদিন থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সমবায় অপেরার মাধ্যমে তারা যাত্রাশিল্পে প্রবেশ করলেও পরবর্তীতে তারা একে একে নিউ বাসন্তি অপেরা, ফাল্গুনি, রুপাঞ্জলী, চন্দন, রাজমনি, মধুছন্দা, স্বর্ণকলি অপেরায় দেশের লোকজ ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন। তারা একটি পয়সা, বাগদত্তা, চন্দ্রশেখর, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, রামপ্রসাদ, গরিবের মেয়ে, লোহার জাল, ময়ূর সিংহাসন, কোহিনুর, বেদের মেয়ে জোসনা, রাজা সন্যাসী, মায়ের ডাক, সমাজের বলি, বাঁশের বাঁশি, প্রায়শ্চিত্ত, সোহরাব রুস্তম, লাইলী মজনু, শিরি ফরহাদ, সূর্যসাক্ষী, টিপু সুলতান, শহীদ কারবালা, কমলার বনবাস, ফুলন দেবী, লক্ষ্মীর হাতে ভিক্ষার ঝুঁলি, নিহত গোলাপ, মুঘলে আযম, বধু চন্দনা সহ প্রায় দু’হাজারেরও অধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। যাত্রাপালায় অভিনয়ন করার সুবাধে তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ সুনামও কুড়িছেন। শিখা রানী ও শেফালী রানী জানান, বর্তমানে যাত্রা পালায় অশ্লীলতা প্রবেশ করায় তারা অভিনয় শিল্পীরা পড়েছেন মহাবিপাকে। ক্রমেই তাদের বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে। ফলে অর্থাভাবে তাদের অধিকাংশ শিল্পীদের অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। আক্ষেপ করে শেফালী রানী বলেন, বর্তমান সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গত কয়েক বছর থেকে বেকার হওয়া যাত্রা শিল্পীদের ভাতা প্রদানের প্রথা শুরু করা হলেও দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাত্রা শিল্পীদের বসবাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ এলাকা গোপালগঞ্জের কোন যাত্রা শিল্পীরাই এ ভাতা পাচ্ছেন না। জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার বারপাইকা গ্রামের প্রবীণ যাত্রাশিল্পী রবি হালদার, এক সময়ের ঝড় কাঁপানো যাত্রার নায়িকা কল্পনা রানী বিশ্বাস জানান, বেকার হওয়া যাত্রা শিল্পীদের জন্য সরকারি ভাবে বরাদ্দকৃত ভাতা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ফরমপূরনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পূর্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা সত্ত্বেও আজো তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এ ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

আশির দশকে গৌরনদীর আলোচিত বারোয়ারি অপেরার স্বত্তাধীকারি কবি শিকদার রেজাউল করিম জানান, ঊনিশ শতাব্দীর শেষভাগে বরিশালের জমিদার বাড়িতে কবিগান, পালাগান, শিবগান, কৃষ্ণগান প্রচলিত ছিল। ১৯২০ সালের দিকে হিন্দু অধ্যুষিত জমিদার বাড়িগুলোতে যাত্রাগানের সূচনা হয়। ওইসময় কলকাতা থেকে যাত্রাগানের দল আনা হতো। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরিশালেই একাধিক যাত্রাদলের সূচনা হয়। গৌরনদীর সরিকল, আশোকাঠী, চাঁদশীর জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজা যাত্রা ছাড়া কল্পনাই করা যেত না। ওই সময় বরিশালের মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে যাত্রাগান হতো। জমিদার বাড়ির পাইক পেয়াদারা যাত্রাগান দেখার জন্য ৩/৪ দিন আগে থেকে ঢেঁড়া পিটিয়ে এলাকাবাসীদের দাওয়াত করতো। ওইসময়ের যাত্রাগান মানে সুস্থ সংস্কৃতিক চর্চা-ই হোক সুস্থ সমাজ গড়ার হাতিয়ার। সেসময়ের বাঙালি সংস্কৃতির আবহমান স্রোতধারার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প মানুষের কথা, মুক্তির কথা ও কুষল মুক্ত সুন্দর সমাজের কথা বলেছে। তিনি আরো জানান, শুধু সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্প ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে এ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার-হাজার শিল্পীরা। এখনও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হারিয়ে যাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্পের সুনাম ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলেও শিল্পীরা উল্লেখ করেন।

(টিবি/এএস/ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test