E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

আবারও সংকটে সুন্দরবন

২০১৫ মে ০৬ ১৯:০৩:৪৬
আবারও সংকটে সুন্দরবন

আহসানুল করিম, সুন্দরবন থেকে : বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেজ্ঞের ভোলা নদীর বিমলের চরে ডুবে যাওয়া সার বোঝাই এম ভি জাবালে নূর নামের লাইটারেজ জাহাজটি বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়নি। নেই ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধারের কোন তৎপরতা। অপসারন করা যায়নি জাহাজের খোলে পানিতে গলে যাওয়া অবশিষ্ট পাটাশ সার। জোয়ারের পানিতে জাহাজটিকে থাকা অধিকাংশ সার পানিতে মিশে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে ছড়িয়ে পড়েছে।

শত-শত মেট্রিক টন রাসায়নিক সার মিশ্রিত পানিতে অক্সিজেন কমে পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে বলে আশংকা করছেন বিষেশজ্ঞরা। সার বোঝাই জাহাজ ডুবির ফলে মাত্র ৫ মাসের মধ্যে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য আবারও সংকটে পড়েছে বলে তারা আশংকা করছেন। এদিকে র্দূঘটনাস্থ ও নদী-খালের পানিতে কতোটুকু অক্সিজেন রয়েছে তা এখনও পরিক্ষা করে দেখেনি সুন্দরবন বিভাগ। গতকাল বুধবার দিনভর সরেজমিনে ডরফিনের অভয়াশ্রম হিসেবে খ্যাত ভোলা ও শ্যালা নদীতে ঘুরে ডলফিনের দেখা মেলেনি।

ধারনা করা হচ্ছে ডরফিনের অভয়াশ্রমের পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ায় বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতি ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন সুন্দরবনের অন্য কোন নদী বা বঙ্গোপসাগর উপকূলে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে সুন্দরবনের শরণখোলা রেজ্ঞ কর্মকর্তা এসিএফ কামাল উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার মধ্য রাতে শরণখোলা থানায় ডুবন্ত জাহাজের মালিক বা অন্য কারোর নাম না পেয়ে অজ্ঞাতদের আসামী করে মামলা করেছে। শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ অতুল মন্ডল মঙ্গলবার মধ্য রাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে এই জাহাজের কিছু কাগজপত্র জব্দ করেন। এতে আমিনুল ইসলাম গং নামে মালিক পক্ষের একটি নাম পাওয়া গেছে। জব্দকৃত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। একই রাতে লাইটারেজ জাহাজের চালক মো. হাফিজু রহমান থানায় সাধারন ডায়েরি করছে।


এ র্দুঘটনা তদন্তে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসন ও সুন্দরবন বিভাগ পৃথক দুটি কমিটি গঠন করেছে। বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব মো. শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি ৭ দিনের মধ্যে ও পূর্র্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ( ডিএফও) মো. আমির হোসাইন চৌধূরীকে প্রধান করে ৪ সদস্যের কমিটি তিন দিনের মধ্যে তাদের রির্পোট পেশ করবে। র্দূঘটনাস্থল পরির্দশন কালে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাংঙ্গীর আলম এতথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, দুটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। লাইটারেজ কার্গো জাহাজটিতে থাকা পানিতে গলে যাওয়া অবশিষ্ট সার বালি উত্তোলনের ড্রেজার মেশিন দিয়ে অপসারনের করা হবে। তিনি আরো বলেন, বিকল্প রুট চালু না হওয়া পর্যন্ত সুন্দরবনের অভ্যন্তর থেকে সিমিত পরিসরে জাহাজ চলাচল করার নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। মংলার ঘষিয়াখালী নৌ-চ্যানেল চালু হলে সুন্দরবন থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ করা হবে।

বুধবার সকালে জেলা প্রশাসক ছাড়াও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) ড. সুনীল কুমার কুন্ডু, পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী ও বাগেরহাটের কৃষি বিভাগের উপ পরিচালক মো. জয়নুল আবেদীন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে,তলা ফেটে জাহাজটি এখনো পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। সারের লাল পুরু আস্তরণ নদীর পানিতে ভাসছে। সুন্দরবন বিভাগের কয়েকজন শ্রমিক বালতি ভরে গলিত সারের পানি তাদের ট্রলারে তুলছেন। ঘটনাস্থলে ওই জাহাজের মালিক পক্ষ বা মাষ্টার-নাবিক কাউকেই পাওয়া যায়নি। তারা ঘটনার পর পরই পালিয়ে গেছে। এছাড়া মঙ্গলবার আসা উদ্ধারকারী জাহাজ এমবি নুসরাত-ই-হক ও এমবি তছির উদ্দিনও ওই দিন রাতে ঘটনাস্থ থেকে পালিয়ে গেছে বলে সুন্দরবন বিভাগ জানিয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ দত্ত জানান, এমওপি একটি রাসায়নিক সার। এটি পানিতে সহজে দ্রবিভুত হয়। বিপুল পরিমাণ এই সার এক সাথে দ্রবিভুত হয়ে জলজ প্রান সম্পদের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। সুন্দরবন একটি স্পশৃকাতর এলাকা মন্তব্য কবরে তিনি বলেন, বিষয়টি মাথায় রেখে এখন সুন্দরবন বিভাগের সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেমনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, জোয়ারের পানিতে জাহাজটিকে থাকা শত-শত মেট্রিক টন সার পানিতে মিশে সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে ছড়িয়ে পড়েছে। রাসায়নিক এই সার মি¯্রত পানিতে অক্সিজেন কমে পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। র্দূঘটনাস্থ ও সুন্দরবনের নদী-খালের পানিতে কতোটুকু অক্সিজেন রয়েছে তা জরুরী ভিত্তিতে পরিক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। শ্রালা নদীতে অয়েল ট্যাংকারের খ্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সুন্দরবন সার বোঝাই জাহাজ ডুবির ফলে মাত্র ৫ মাসের মধ্যে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য আবারও সংকটে পড়েলো । সারের রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় বিরল প্রজাতির ডলফিন, শুশুক, বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণির মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলেও তিনি জানান।।

সিলেট শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়ো-টেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সুন্দরবনে এখন নদ-নদীতে মাছের প্রজজন মৌসুম চলায় সার বোঝাই জাহাজ ডুবিতে দীর্ঘ্য মেয়াদে ক্ষতির আশংঙ্কা আরো বেড়ে গেল।

অন্যদিকে বাগেরহাটের কৃষি বিভাগের উপপরিচালক (ডিডি) মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, পটাশ সার পানিতে মিশলেও চলন্ত মাছ বা ডলফিনের তেমন কোনো ক্ষতি হবেনা। তবে, শামুক, ঝিনুকসহ ক্ষুদ্র কিছু জলজ প্রানীর ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ডিএফও মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী দাবি করেন, পটাশ সার জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।

দূর্ঘটনা কবলিত লাইটারেজ জাহাজটি মংলা বন্দরের অদুরে পশুর নদীর হারবারিয়া এলাকা থেকে ৬শ ৭০ মেট্রিকটন পটাশ সার বোঝাই করে গত ১মে আশুগজ্ঞর উদ্যেশ্যে রওনা দেয়। প্রতিমধ্যে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেজ্ঞের ভোলা নদীর বিমলের চরে সোমবার সন্ধায় চরে আটকা পড়ে। মঙ্গলবার বিকেলে জাহাজটির তলা ফেটে কাত হয়ে ডুবে যায়। ফলে জাহাজে থাকা পটাশ সার সুন্দরবনের পানিতে মিশে একাকার হয়ে যায়।

এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েল বোঝাই ‘সাউদার্ণ স্টার সেভেন’ নামের একটি জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে সুন্দরবকে বাচাতে সে সময়ে ছুটে আসে জাতিসংঘের বিষেশজ্ঞ দল। ৫ মাস যেতে না যেতেই সার বোঝাই এ জাহাজ ডুবির ঘটনায় সুন্দরবন আবারও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ল।

(একে/এএস/মে ০৬, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test