E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অবৈধ ক্লিনিকের কার্যক্রম : অকাল গর্ভপাত

২০১৫ জুন ০১ ২২:০২:১৫
অবৈধ ক্লিনিকের কার্যক্রম : অকাল গর্ভপাত

শোভন সাহা : সমগ্র বাংলাদেশ জুড়েই চলছে অবৈধ ক্লিনিকের রমরমা ব্যবসা। গর্ভপাত মাতৃত্বজনিত একটি ঘটনা হলেও তা যদি অস্বাভাবিকভাবে হয় তখন এটাকে অনেকে ভিন্ন চোখে দেখে। আর সেই সুযোগে বিভিন্ন ক্লিনিক রোগীকে তাদের অর্থ বানানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকে।

সমাজের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী একজন মানুষ বিয়ের মাধ্যমে তার জীবনকে আরো রঙিন করে তোলে, সন্তান জন্ম দিবে, তাদেকে যত্ন নিয়ে বড় করে তুলবে।

২০ বছর আগের জীবন আর এখনকার আধুনিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমানে মানুষ অনেক আধুনিক ও গতিশীল জীবন কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। প্রতিনিয়ত ঘরের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন ধরনের কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

কর্মক্ষেত্রের সাথে সাথে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির কারণে বাড়ছে বন্ধুত্ব। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্ষেত্রেই আজ নারী-পুরুষ একত্রে কাজ করছে আর একই সাথে তাদের মধ্যে গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের গভীর সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের শেষ পরিনতিতে অবৈধ গর্ভপাতের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গর্ভের সন্তান নষ্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোন সুষ্ঠু আইন না থাকায় গর্ভপাত একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে। গর্ভপাতের এই সামাজিক ব্যাধি থেকে যুব সমাজ, ছাত্রসহ সকল বয়সের নর-নারী প্রত্যেকেই কম বেশি জড়িত।

গর্ভপাতের বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুল মনসুর বলেন, বর্তমানে ভ্রুন হত্যার জন্য চারটি কারণ ব্যাপকভাবে আলোচিত। অতিরিক্ত বয়সে বিয়ে করা, অসচেতন অভিভাবক ও কর্মক্ষেত্রে তাদের ব্যস্ততা, স্বামী-স্ত্রীর সংসারে অশান্তি ও ঝগড়া-বিবাদ, অনিরাপদ অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান যুগে অনেক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা অবাধে মেলামেশা করছে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা অসাবধানতার কারনে গর্ভধারণ করছে।

নগর জীবনে জীবিকার পেছনে ছুটতে থাকা অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের খোঁজ-খবর ঠিকভাবে রাখতে পারছে না, কখন তাদের সন্তানেরা কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মেলামেশা করছে- এই সকল খোঁজ-খবর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাছাড়া অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের উপর নিয়ন্ত্রনও হারিয়ে ফেলছে।

আমাদের সমাজে আমরা এখন পশ্চিমা বিশ্বের ধ্যান-ধারণা মিশিয়ে নতুন সমাজের কথা বলি। এজন্য এখন একটি ছেলের মেয়ে বন্ধু থাকবে, তার সাথে মেলামেশা ও চলাফেরা থাকবে- এটা খুবই স্বাভাবিক। এখন অনেক পরিবার বিষয়টিকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই দেখছে। শুধু ঢাকা শহর নয়, সমগ্র বাংলাদেশে আজকাল ছেলে মেয়েরা যেভাবে চলাচল করছে তা নব্বইয়ের দশকে চিন্তাও করা যেত না।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরন্নবী বলেন, আজকাল মেয়েরা অনেক সচেতন। তাদের পড়াশুনা শেষ করতেই বয়সের সীমা ৩০ বছর পার করে থাকে সেটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। তাছাড়া পরিবারের বাইরে তার এমন একজনকে প্রয়োজন যার সাথে সে তার অনেক কথা শেয়ার করতে পারে। আর তার পরিনতিতে আস্তে আস্তে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যার ফলে অনেক সময় অসচেতনতার কারণে অনেক মেয়ে প্রাগন্যান্ট হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে অবৈধভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গর্ভপাত করাতে বাধ্য হচ্ছে।

তিনি মনে করেন সমাজ ব্যবস্থার এই করুণ পরিনতির জন্য আমাদের মূল্যবোধই দায়ী। এখন আধুনিক ফোন, ফেসবুক, ই-মেইল এর যুগ। কিন্তু আমাদের অভিভাবকদের সবসময়ই সতর্ক থাকতে হবে যাতে আমাদের সন্তানেরা এগুলোর অপব্যবহার করতে না পারে।

রোগ হলে মুক্তি আছে, কিন্তু এটাতো সমাজের অবক্ষয়। হাতের নাগালেই এখন আধুনিক চিকিৎসা। তাই গর্ভপাত করানো এখন এমন কোন কষ্টসাধ্য বিষয় না। কয়েক মিনিটের মধ্যে গর্ভপাত করানো যায়। আর এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে গড়ে উঠা শত শত মেটার্নিটি ব্যবসাও বেশ জম-জমাট।

মেহাম্মদপুরের ‘নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র’ গিয়ে দেখা যায় সেখানে প্রচুর গর্ভবতী মহিলারা অপেক্ষা করছে উক্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডা. সেলিনা হোসেনের জন্য। রোগীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে তারা বিভিন্নভাবে এড়িয়ে যেতে থাকেন।

তবে ডা. সেলিনা হোসেন নিজে থেকেই কথা বলতে এগিয়ে আসেন এবং বলেন, আমরা শুধু ১ম থেকে ১০ম সপ্তাহের মধ্যে এম.আর গর্ভপাত করিয়ে দিয়ে থাকি। তিনি আরও বলেন, অনেক বিবাহিত ও অবিবাহিত মেয়েই এখনই তাদের সন্তান নিতে চান না, তাই তারা করিয়ে থাকে এই এম.আর। তাছাড়া তার কথাতেই পরিস্কার হয়ে যায় অনেক উঠতি বয়সী তরুণীরা ছাড়াও অবিবাহিত মেয়েরাও এখানে এসে অনায়াসে এম.আর করিয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি একটি এনজিও দ্বারা পরিচালিত। ঢাকাতেই আমাদের প্রায় ১০টি শাখা আছে। প্রত্যেকটি শাখায় কোন না কোন ভাবে মাতৃত্বকালীন বিভিন্ন চিকিৎসা সহ এম.আর করানো হয়। সুনামের দিক দিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠান অনেক এগিয়ে এবং প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০টি গর্ভপাত করিয়ে থাকি আমরা।

১ম থেকে ১০ম সপ্তাহের মধ্যে এম.আর করাতে কেমন খরচ হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫০০-১০০০ টাকার মধ্যেই সব হয়ে যায়। মাঝে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ রোগী থাকে তথন বেশি লাগে। তাছাড়া সামান্য টাকার কিছু মেডিসিন লাগে।

রাজধানীর গ্রীন রোড়ের আর একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র জুড়ি মেটারর্নিটিতে গিয়ে দেখা যায় ৪ জন মহিলা গর্ভপাত করাতে এসেছে। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে যুথিকা (ছদ্দনাম) বলেন, আমার এই বাচ্চাটিকে আমি এখন নিতে চাই না। তাছাড়া এখন আমাদের সন্তান লালন পালন করার জন্য আমরা স্বামী-স্ত্রী কেউই উপযুক্ত না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে হাসপাতালে এসেছি গর্ভপাত করাতে। জুড়ি মেটারর্নিটির ডা. মরিয়ম বলেন ‘মেয়েরা চায় না তাই ফালাইয়া দেই আমরা।’

মেরিস্টোপস প্রিমিয়াম-২ এর গাইনি ডা. দ্বীপা বলেন, ১ম থেকে ১০ম সপ্তাহের মধ্যে সকল গর্ভপাত করানো বৈধ। তাছাড়া ১০ম সপ্তাহের বেশি হলে আমরা তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে থাকি তারা যেন গর্ভপাত না করায়, কারণ এটা অনেক ঝুঁকিপূর্ন হয়ে যায়। তবে যারা অকাল গর্ভপাত করাতে আসে তাদেরকেও আমরা বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকি। সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের রোগীদের সেবার জন্য ১৭০টি শাখা আছে। তবে এর বাইরে জটিল কোন অবস্থা দেখলে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মা ও শিশু হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে থাকি।

(এসএস/পিএস/জুন ০১, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test