E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

বিনা বেতনে ২৭ বছর কলেজের অধ্যক্ষ !

২০১৫ জুন ২৮ ২০:৪০:২১
বিনা বেতনে ২৭ বছর কলেজের অধ্যক্ষ !

বরিশাল প্রতিনিধি : কলেজ অধ্যক্ষর মাসিক আয় ১৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। সে হিসেবে তার বার্ষিক আয় ১৭৯৪ টাকা। তাও উত্তোলন করতে হয় বিলের মাধ্যমে এক বছর পর একত্রে।

দেশে সংস্কৃত কলেজ ও টোলগুলোর শিক্ষকদের অমানবিক জীবন যাপনের বিষয়টি অধিকাংশ লোকের অজানার কারণে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবে এটিই সত্য।

এই কলেজে কর্মরতদের নেই কোন বেতন-ভাতা। তারা শুধু পেয়ে আসছেন মহার্ঘ ভাতা! অবৈতনিক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় কর্মরত হাজার হাজার কর্মজীবীগণ এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত দেশ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ সম্মানসূচক ডিগ্রী গ্রহণ করলেও মানুষ তৈরির কারিগর ওই সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিক্ষক ও কর্মচারীদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি বৃটিশ আমল থেকে স্বাধীন বাংলার ১২২ বছরেও। “বাতির নীচে অন্ধকার” এই প্রবাদটি সংস্কৃত কলেজের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সত্য।

সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত দেশের সংস্কৃত কলেজ ও টোলগুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের জীবনের করুণ চিত্র দেখে অবাক না হয়ে উপায় নেই। এমনই একটি কলেজের দায়িত্ব পালন করছেন বরিশাল বিভাগের একমাত্র কলেজ গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বাকাই গ্রামের প্রতিষ্ঠিত “বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজ”।

অমানবিকতার মধ্যে থেকে চাকুরীর শেষ বয়সে এসে সত্য কথাটি বলেছেন দেশের বিভিন্ন কলেজের পক্ষে “বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজ” এর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সত্তোরোর্ধ নিখিল রায় চৌধুরী।

তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত পন্ডিত হরি গোবিন্দ রায় চৌধুরী ১২২ বছর পূর্বে ১৩০০ বঙ্গাব্দে (১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ) নিজের ১ একর ১০ শতক জমির উপরে নিজ নামে প্রতিষ্ঠা করেন “বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজ”। ওই যুগে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার জন্য পন্ডিত মহাশয়ের “টোল” বা পাঠশালায় দিতেন। কালক্রমে ওই সকল টোল থেকেই কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই কলেজ থেকেই পাশ করে যোগদান করতে হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে।

হরি গোবিন্দ কলেজে বর্তমানে পড়ানো হয় কাব্য, ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, পুরাণ, পুরোহিত্য ও স্মৃতি শাস্ত্রসহ ৬টি বিষয়ে। প্রত্যেক বিষয় ৩ বছর মেয়াদে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন করতে হয়। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্র নিয়ে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে জীবিকা নির্বাহ করছেন লক্ষাধিক শিক্ষক।

শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি এই কলেজে অধ্যয়ন করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করে সম্মানসূচক ডিগ্রী গ্রহণ করেন অনেক পেশার লোকজন। যাদের নামের পূর্বে সম্মানের সাথে সংযুক্ত করা হয়- আচার্য, পন্ডিত, শাস্ত্রবিদ ইত্যাদি।

সেই পন্ডিত আর শাস্ত্রবিদ তৈরির কারিগরেরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করলেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। বর্তমান সমাজে চরমভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত এই সকল কলেজের শিক্ষকরা। ফলে অর্থনৈতিক দৈন্য দশার কারণে বর্তমান সভ্যতায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।

চরম ক্ষোভ আর আপসোস নিয়ে অধ্যক্ষ নিখিল রায় চৌধুরী আরো বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে অধ্যক্ষর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এই সময়টুকুর মধ্যেই অনেক ছাত্র এখান থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে রাষ্ট্রের বড় পদে আসীন হয়েছেন। তারা জানেন যে কলেজের কি হাল। তারপরেও তারা নিজেদের অবস্থানে থেকে একটু নজর দেননি কলেজের দিকে। অথচ এই কলেজে অধ্যয়ন করে শিক্ষা সনদ গ্রহণ করেছেন অনেক মন্ত্রী, সচিব, ডিসি, উপমহাদেশের বিখ্যাত পন্ডিত থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ও উপমহাদেশের বিখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞরা। ক্ষোভে তিনি আরও বলেন, অনেক পন্ডিতরাই চান না যে সংস্কৃত কলেজের উন্নয়ন হোক। অবশ্য এর পিছনের কারণ তিনি বলেননি।

এমন অর্থনৈতিক দৈন্য দশার মধ্যেও কেন এই কলেজে চাকুরী করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পূর্ব পুরুষেরা প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছেন সমাজের হিতের জন্য। তাই তাদের সেই মহৎ চিন্তা চেতনার দিকে তাকিয়ে তাদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য বিনা বেতনে কাজ করছি। বিষয়টিকে তিনি নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানোর সাথেই তুলনা করেছেন।

কলেজ প্রতিষ্ঠাতার ছেলে বিমল রায় চৌধুরী বলেন, কেন যে বাবা এই প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছিলেন জানিনা! যে প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানী-গুনী ব্যক্তিরা শিক্ষার্থী হিসেবে সনদপত্র গ্রহণ করেন আর প্রতিষ্ঠানের কথা মনেই রাখেন না। তারা যদি প্রতিষ্ঠানের কথা মনে রাখতেন তবে দেশে বর্তমানে উচ্চ পদে আসীন থাকা অনেকের প্রচেষ্টায়ই একটু হলেও কলেজে কর্মজীবীদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটত।

একই ক্যাম্পাসে রয়েছে মাধ্যমিক ও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই সকল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আর্থিক সচ্ছলতা আর সংস্কৃত কলেজে কর্মরতদের আর্থিক অবস্থার বিপরীত চিত্র রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় বৈষম্যকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে তুলে ধরেছে।

কলেজ অধ্যক্ষ নিখিল রায় চৌধুরী আরও বলেন, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এই কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। পালি বোর্ড ঢাকার কমলাপুরের বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরে অবস্থিত।

কলেজগুলোতে অধ্যক্ষসহ ৩ জন শিক্ষক ও ১ জন অফিস সহকারী কর্মরত রয়েছেন। আর টোলগুলোতে ২ জন শিক্ষক ও ১ জন অফিস সহকারী দিয়ে চলছে শিক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমান শিক্ষা বর্ষে তার কলেজের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেবেন বলেও জানান তিনি। পরীক্ষায় কৃতকার্যদের সনদপত্র দেয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, বরিশাল বিভাগের একমাত্র কলেজ এটা। এছাড়া একটি টোল আছে বরিশাল সদরের ধর্ম রক্ষিনী সভায়। সারাদেশে ৮ থেকে ১০টি কলেজ থাকার কথাও জানান তিনি। হাতে গোনা কয়েকটা কলেজ থাকলেও সরকারের উদাসীনতার কারণে এর পাঠ্য বই পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায় না। পাঠ্য বই সংগ্রহ করতে হয় ভারত থেকে।

ক্ষোভ আর অভিযোগে তিনি আরও বলেন, সনাতন ধর্মের বিকাশের প্রতিষ্ঠানের কারণে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা কলেজের অবকাঠামোসহ তাদের পাড়ার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয়। অত্যাচারিত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরীও হয় অনেকে। তারপরেও দেশ স্বাধীন হবার পর কোন রকমে গড়ে তোলা হয় কলেজ অবকাঠামো। ২০০১ সালে ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ থেকে ৩ তলার একটি ভবন নির্মান করা হয়। ওই ভবনেই চলছে শিক্ষাসহ আবাসনের কাজ। আজ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠেনি কোন আলাদা ছাত্রাবাস। অথচ ছাত্রবাসে থেকেই শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন করার কথা থাকলেও সুযোগের অভাবে শিক্ষার্থীরা আবাসিক সুবিধায় থাকতে পারছে না।

অধ্যক্ষ নিখিল রায় চৌধুরী অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে দাবিদার সরকারের প্রধানমন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক সংস্কৃত কলেজের শিক্ষকদের অমানবিক জীবন থেকে পরিত্রানের জন্যে আশু সুদৃষ্টি কামনা করছেন।

বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজের গভর্নি বডির সভাপতি ও অগ্রনী ব্যাংকের পরিচালক এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার বলেন, তাদের সম্মানী নিম্ন থেকে অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে। আর্থিক কারণে তাদের জীবনযাত্রা সত্যিই অমানবিক। সরকার সকল শিক্ষাকে যুগোপযোগী, আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞানসন্মত করেছে। সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিকায়ন করে আলাদা বোর্ডের মাধ্যমে বেতন কাঠামো নির্ধারন করেছে।

দেশে সংস্কৃত কলেজগুলোর সংখ্যা খুব বেশী নয়। তাই তাদের জন্য সময়োপযোগী বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে তাদের অমানবিক জীবন থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়া উচিৎ। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নজর দেয়া একান্ত প্রয়োজন।

(টিবি/পিএস/জুন ২৮, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test