E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version


‘আমরা এখন লিখতে ও পড়তে পারি’

২০১৫ নভেম্বর ০৪ ১৮:২৮:৪০
‘আমরা এখন লিখতে ও পড়তে পারি’

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে মিলন কর্মকার রাজু : আমরা এখন রাস্তার সাইন বোর্ড পড়ে বলতে পারি কোন সড়কে আছি। বাংলা কোরআন শরীফ পড়তে পারি। ব্যাংক হিসাবেও সাক্ষর দেই। যোগ-বিয়োগ, পূরন-ভাগও পাড়ি। শুধু পাড়ি না ইংরেজী পড়তে ও লিখতে। আর কয়েকটা মাস শিখতে পারলে ইংরেজীটাও শিখে ফেলতাম।

সোমবার দুপুরে “সাক্ষর মা” স্কুলের সমাপনী কার্যক্রমে জীবনে প্রথম পাওয়া সার্টিফিকেট নিতে এসে এ কথা বলেন সত্তোরোর্ধ ফাতেমা বিবি। তার মতো “সাক্ষর মা” স্কুলের ২৬৪ মা পেল সার্টিফিকেট। জীবনের শেষলগ্নে সাক্ষর ও বর্ণমালা শিখে সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে তারা অনেকেই কেঁদে ফেলেন।

বয়স সত্তর পেড়িয়ে গেছে। মুখের মাত্র কয়েকটি দাঁতই অবশিষ্ট। এ কারনে কথা কবিতা ও গল্প বললেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মাথার চুল ধবধবে সাদা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয়। একই স্কুলে মেয়ের সাথে তিনি পড়েন। তাই পঞ্চাশোর্ধ মেয়ে নাসিমা বেগমের হাত ধরে এসেছেন সার্টিফিকেট নিতে এসছেন ফাতেমা বিবি। জীবনের শেষ বয়সে এসে সাক্ষর শেখার পুরস্কার সার্টিফিকেট পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন তিনি।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার অনন্তপাড়া স্কুল প্রাঙ্গনে এই সাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন মায়েদের হাতে সোমবার সার্টিফিকেট তুলে দেয়া হয়। স্টুওয়ার্ড শিপ ফাউন্ডেশন ইউকে’র অর্থায়ানে এফএইচ এ্যাসোসিয়েশন সংস্থা (বয়ষ্ক স্বাক্ষরতা কার্যক্রম) কলাপাড়ায় “স্বাক্ষর মা’ স্কুলের ধুলাসার ইউনিয়নের ৬ টি বিদ্যালয়ের ১৩৪ জন মায়ের হাতে এ সার্টিফিকেট তুলে দেন এফ এইচ এসোসিয়েসন’র এফ এইচ’র পরিচালক ও মিনিষ্ট্রি পার্টনার মিঃ ডিক মোহার, নির্বাহী পরিচালক টিমোথি ডোনাল্ডাল ড্যাঞ্জ, এমিয়া রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর আন্দ্রিয়া ড্যাঞ্জ, ইউএসএ’র প্রকল্প পরিদর্শক এম জে, মিসেস লরেন, পরিচালক পলিসি ও রিসোর্স বিভাগ মিজানুর রহমান, লিটারেসী অর্গানাইজার মিন্টু আহমেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এরিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর গৌতম দাস। একইভাবে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ১৩০ সাক্ষর মায়ের হাতে মঙ্গলবার সার্টিফিকেট তুলে দেয়া হয়েছে।

ষাটোর্ধ রাহিমা বেগমের ছোট মেয়ে বিপাসা এ বছর জেএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু তার অপেক্ষা কখন হাতে পাবেন সার্টিফিকেট। গত নয় মাস ধরে অনন্তপাড়া সাক্ষর মা স্কুলে তিনি শিখেছেন বর্ণমালা। গল্প ও কবিতাও পড়তে পারেন।

যোগ-বিয়োগ,পূরণ-ভাগও পারেন। শুধু পারেন না ইংরেজি পড়তে। কিন্তু সোমবার কলাপাড়া উপজেলার সাক্ষর মা স্কুলের কার্যক্রম শেষ হওয়ায় তার ইংরেজী লেখা ও পড়া আর শেখা হয়নি।

রাহিমা বেগম বলেন, আর কয়েকটা মাস এই স্কুল চালু থাকলে আমরা ইংরেজিটাও শিখে ফেলতাম। বাংলাতো সবই পড়তে পারি। অংকও পাড়ি। শুধু দুঃখ এ্যাহন ইংরেজী পারি না।

নাসিমা বেগম জানায়, চাইরডা পোলামাইয়া সবাই পড়ে। মুই আগে অগো বই খুইল্যা খালি ছবি দ্যাখতাম আর অগো (পোলামাইয়া) জিগাইতাম এইডা কি, কিসের গল্প। এ্যাহন আর জিগাইতে হয়না। তিনি বলেন, মুই আর মোর মা এই স্কুলে আইয়া বাংলা অংক শিখছি। এ্যাহন মোরা আর টিপসই দেইনা। সব জায়গায় সাক্ষর দেই।

সাগর ঘেষা কাউয়ার চর গ্রাম থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে এসেছেন নাসিমা বেগম, নাজমা বেগম, কুর্চিয়া বেগম। বৌলতলী গ্রাম থেকে এসেছেন রাহিমা বেগম, লাভলী বেগম,হনুফা বেগম। তারা জানালেন,“আমরা এ্যাহন রোগ দ্যাহাইতে গ্যালেও ডাক্তাররে কই বাংলায় ঔষধের নাম ল্যাকতে। বাংলায় ল্যাকলে আমরা নিজেরাই ঔষধের নাম দেইখ্যা কেনতে পারি।

পশ্চিম ধুলাসার গ্রামের মাহিনুর বেগম জানায়,“ আগে ঘরে কিকি বাজার লাগবে হেইয়া কর্তারে মুহে কইতাম। অনেক সময় কইতাম এক জিনিস,আনতো অন্য জিনিস। এ্যাহন আর হেই ভুল হয় না। আগেই লেইখ্যা ফর্দ কইর‌্যা দেই।

এফএইচ’র এশিয়া রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর আন্দ্রিয়া ড্যাঞ্জ বলেন, সাক্ষর মা স্কুলের মায়েদের শিকড়, সংযোগ ও প্রয়োগ নামের তিনটি পাঠ্যবই পড়ানো হয়েছে। এই তিনটি বই পাঠ করে তারা শিক্ষতে পেরেছে বর্নমালা, শব্দ পরিচিতি,গল্প-কবিতা ও ধারাপাত।

সাক্ষর মা স্কুলের সমাপনী অনুষ্ঠানে সাক্ষর শেখার গল্প শুনতে আমেরিকা থেকে এসেছেন এম জে ও লরেন। তাঁরা জানালেন, সাক্ষর মা স্কুলের নিরক্ষর মায়েদের সাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হওয়ার গল্প শুনে তারা আভিভূত। উপকূলীয় এলাকার এই মায়েদের গল্প আমরা আমেরিকা গিয়ে বলব। সাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হয়ে আপনারা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন দেখা বন্ধ করবেন না। এখন স্বপ্ন দেখবে নিজ পরিবার ও মাজের উন্নয়নের জন্য।

এরিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর গৌতম দাস জানান, গত নয় মাসে ২৬৪ মাকে তারা শিখাতে পেরেছেন বর্নমালা। তারা এখন লিখতে ও পড়তে পারছে। এটাই তাদের সফলতা।

(এমেকআর/এএস/নভেম্বর ০৪, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test