E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

লক্ষ্মীপুরে পাঁচ মাসে ৩৬ খুন, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

২০১৪ মে ২৭ ১৪:৩৬:২৩
লক্ষ্মীপুরে পাঁচ মাসে ৩৬ খুন, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি : সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে লক্ষ্মীপুরে থামছে না খুন-হত্যা। প্রায় দিনেই রাজনৈতিক দলের কর্মী আর সাধারণ মানুষ খুন কিংবা অপহরণের শিকার হলেও খুনিরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। একটি হত্যাকাণ্ডের আড়ালে হচ্ছে আরেকটি হত্যাকাণ্ড। জেলা জুড়ে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মাঝে খুন আতঙ্কে ঘুম নেই চোখে।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলায় প্রায়ই সময় তাদের মধ্যে চলে বন্দুকযুদ্ধ ও খুনোখুনি। এ পরিস্থিতিতে লক্ষ্মীপুরে গত পাঁচ মাসে ৩৬ জন খুন হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কোনোভাবেই যেন সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না পুলিশ প্রশাসন।
সর্বশেষ মঙ্গলবার সকালে পৌরসভার লামচরী এলাকা থেকে শামিম হোসেন (২২) নামের এক ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এই নিয়ে চলতি বছরের ২৭ মে পর্যন্ত জেলায় ৩৫টি হত্যাকান্ড ও ছাত্র-বৃদ্ধ, নারী-শিশুসহ কমপক্ষে ২৫টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। অপহৃতদের মধ্যে বিএনপির চার নেতাকর্মীসহ ৭জন রয়েছেন বলে জানা যায়।
জানা যায়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অন্তর্কোন্দল, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, পারিবারিক ও জমি সংক্রান্ত বিরোধ, মুক্তিপণ আদায় ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড ও অপহরণ সংঘটিত হচ্ছে।
গত সপ্তাহেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দু’দলের ৫ নেতা খুন হন। সদর উপজেলার চরশাহী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে গলা কেটে ও রায়পুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়।

বৃহস্পতিবার ভোরে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে। সোমবার ভোররাতে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নে রোমান হোসেন (২০) নামে এক ইউনিয়ন যুবলীগ কর্মীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। গত রোববার রাতে সদর উপজেলার হাজিরপাড়ার সিয়াম পেট্রোলপাম্প এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন যুবদল কর্মী জাহাঙ্গীর (২৭) এবং ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. নোমান (৩০) নিহত হন।
এছাড়াও ২ মে দত্তপাড়ার করইতলা গ্রামে যুবদল কর্মী মো. রিপন, ৪ মে রায়পুরের শিবপুর গ্রামের বড় ভাই সানাউল্যার হাতে ছোট ভাই হারুন খুন হয়। ৮ মে রামগঞ্জের চাটখিল সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুভংকর শুভ নামে যুবলীগ কর্মীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার, ১৩ মে রামগতির চর পোড়াগাছায় সেকান্তর মিয়াকে কুপিয়ে হত্যা, ১৪ মে তেওয়ারীগঞ্জে কিশোর সোহাগকে পিটিয়ে হত্যা, ১৫ মে কমলনগরের মতিরহাটের মেঘনা নদীর সংযোগ খালে জেলে ইব্রাহিম, ও ২০ মে রায়পুরে ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মাহফুজের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৩ এপ্রিল রাতে সদরের হামছাদী ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামে ছাত্রলীগ নেতা রবিউল ইসলামকে (২৭) গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাতে লক্ষ্মীপুর জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোলাইমান ঢাকার উত্তরার ৬নং সেক্টর থেকে ডাক্তার দেখিয়ে রিকশায় খিলগাঁওয়ের বাসায় ফিরছিলেন। পথে উত্তরার জয়নাল মার্কেটের সামনে সাদা পোশাকধারী একদল লোক অস্ত্রের মুখে ছাই কালারের একটি মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে ২৭ এপ্রিল সদর উপজেলার চরশাহী ইউনিয়নের একটি খালপাড় থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ২১ এপ্রিল রাতে চন্দ্রগঞ্জে জিসান বাহিনীর সঙ্গে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নাছির বাহিনীর মধ্যে দফায় দফায় হামলা গোলাগুলি ও সংঘর্ষে অষ্টম শ্রেণির স্কুলছাত্র রবিউল হাসান শিমুল (১৪) ও ফরহাদ হোসেন (১৯) নামে দুজন নিহত হন। ২৮ এপ্রিল করপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগ কর্মী সাইফুল ইসলামকে (৩৫) অস্ত্রধারী ৮-১০ জনের একদল সন্ত্রাসী গুলি করে হত্যা করে। এর আগে ২০ মার্চ করপাড়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নূর হোসেনকে তার বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
৩১ মার্চ দিঘলীর দুর্গাপুর গ্রামে ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি কবির হোসেন (৩৪), ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে সদরের উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে যুবলীগ কর্মী শাহাদাত হোসেন টিপু (২৭), ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কুশাখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য মোহাম্মদ উল্যা (৪৫) সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। ১৭ মার্চ পার্বতীনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ মরকন্দজ গ্রামে যুবদল কর্মী বাবর হোসেন (৩০), ৬ ফেব্রুারি চন্দ্রগঞ্জ পশ্চিম বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে যুবদল কর্মী আবু হোসেন (৩২), ২২ জানুয়ারি সদরের ধন্যপুর গ্রামে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন যুবদল কর্মী ও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী দিদার হোসেন।
১০ এপ্রিল পাড়ার উত্তর চন্দ্রপুর গ্রামের খালপাড় থেকে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১২ এপ্রিল দত্তপাড়া ইউনিয়নের বড়আউলিয়া গ্রামে কামাল উদ্দিন নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৫ এপ্রিল রামগঞ্জ শহরে আবুল খায়ের পাটোয়ারী নামে এক বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা, ১২ মার্চ ঝাউডগী গ্রামে এক অজ্ঞাত যুবককে (২৫) গলা কেটে হত্যা, ১৮ মার্চ রায়পুরের কাজিরচর গ্রামে সাকিল হোসেন (১১) নামে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা, ১ ফেব্রুয়ারি দালালবাজার খোয়াসাগর দীঘিরপাড় থেকে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা হুমায়ুন কবিরের ছেলে রাকিব হোসেনকে (২৩) শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৬ ফেব্রুয়ারি কমলনগরের চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের একটি শস্যক্ষেত থেকে আবদুর রহিম নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সদরের রাধাপুর গ্রামে মুরাদ হোসেন (৩০) নামে এক মাইক্রোবাস চালককে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ১১ জানুয়ারি রাতে রায়পুর উপজেলার মোল্লারহাট এলাকায় সালমান শাহ (১৫) নামে এক মেধাবী ছাত্রসহ ২৬ মে পর্যন্ত মোট ৩৬টি হত্যাকান্ড ও খুন সংঘটিত হয়েছে। অপহরণের মাত্রা ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও খুনি ও অপহরণকারীদের গ্রেফতার এবং হত্যার রহস্যও উদঘাটন করতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সম্প্রতি সদর উপজেলায় র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পুলিশের তালিকাভুক্ত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও বিএনপি কর্মী আসাদুজ্জামান বাবুল, দিদার হোসেন, দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে নূর হোসেন শামীম ও ডাকাতিকালে যুবলীগ কর্মী মোসলেহ উদ্দিন মুন্না গণপিটুনিতে নিহত হয়। ওই চার বাহিনী প্রধানের পতন হলেও তাদের এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কমেনি। তাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র নিয়ে বর্তমানে বাহিনীর হাল ধরেছে দলের অপর সন্ত্রাসীরা। আর এসব সন্ত্রাসী বাহিনীকে রাজনৈতিক দলের নেতারা শেল্টার দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সদরের চন্দ্রগঞ্জ, দত্তপাড়া, মান্দারী, দিঘলী, বশিকপুর, পার্বতীনগর, উত্তর জয়পুর ইউনিয়ন ও রামগঞ্জ উপজেলায় বর্তমানে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয় রয়েছে।
এদিকে গত ১০ এপ্রিল রাতে দাবিকৃত চাঁদা না পেয়ে সদরের করইতলা গ্রামে বড় ভাইকে পিটিয়ে ধানক্ষেতে ফেলে রেখে ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন বাচ্চুকে (২৩) তুলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এখনও তিনি নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। একই দাবিতে ১৫ মার্চ দুপুরে দেওপাড়া গ্রাম থেকে জিনিয়া আফরোজ ও তার শিশুকন্যা সানজিদাকে মাইক্রোবাসে ১০-১২ জন মুখোশধারী অপহরণ করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় সদর থানায় মামলা হলেও এখনও তাদের উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় আত্মীয়ের বাসা থেকে সদর উপজেলার পাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক, সম্প্রতি রামগঞ্জের করপাড়া থেকে বিএনপি কর্মী আবদুল কাদের, ঢাকা থেকে লক্ষ্মীপুর আসার পথে কুমিল্লার নাথের পেটুয়া এলাকা থেকে বিএনপি কর্মী আলমগীর ও রাজুকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, গত কয়েক দিন আগে আমি এ জেলায় যোগদান করেছি। সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে বেশ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিগত সময়ে হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলাগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওইসব মামলায় আসামিদের গ্রেফতার ও প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে লক্ষ্মীপুরে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হবে। সে লক্ষ্যে পুলিশ দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে।
(এমআরএস/এএস/মে ২৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test