E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

শেরপুরের গারোপাহাড়ে প্রাকৃতিক বন উজার

২০১৪ জুন ০৬ ১৭:৩৮:৫২
শেরপুরের গারোপাহাড়ে প্রাকৃতিক বন উজার

শেরপুর প্রতিনিধি : শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন কেটে উজার করার ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে।

কেবল বন উজাড়ই নয়, অবেধভাবে পাহাড় খুড়ে কাঁচবালি, পাথর, সাদা মাটি উত্তোলন করে ভুমির প্রাকৃতিক গঠনও পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ভারসাম্য দারুণভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। এমন অবস্থায় জলবায়ু ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন বলে স্থানীয় এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদীরা জানিয়েছেন।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮-৮৯ সালে বাংলাদেশ বন বিভাগ এডিবি’র অর্থায়নে প্রথম শেরপুরের গারোপাহাড় অঞ্চলে সামাজিক বনায়ন শুরু করে। তখন থেকেই নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় প্রাকৃতিক বনের গাছপালা কেটে পাহাড়ী বনাঞ্চল ন্যাড়া পাহাড়ে পরিনত করা হয়। এমনকি মাটি খুঁড়ে গাছের শেকড়গুলোও উপড়ে ফেলা হয়। শাল-গজারীর বাগান, প্রাকৃতিক বনের লতাগুল্ম কেটে, আগুন লাগিয়ে পুড়ে সাফ করে সেখানে সামাজিক বনায়নের নামে লাগানা হয় লাগানা হয় ইউকেলিপটাস, মিনজিয়াম, আকাশমনি, মিঞ্জিরির মতো দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশী গাছ। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়নের কারণে নি:শেষ হয়ে যায় প্রাকৃতিক গাছপাল-লতাগুল্ম। বনের পশুপাখি, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ হারায় তাদের বাসস্থান ও খাদ্যের উৎস। বনের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষের জীবনেও ধীরে ধীরে নানা পরিবর্তন আসতে থাকে। আগে বন ও পাহাড় থেকে তারা যে সকল প্রাকৃতিক সব্জী, পাহাড়ী আলু সংগ্রহ করে ক্ষুধা মেটাতো, সামাজিক বনায়নের ফলে তা থেকে বঞ্চিত হয়। কেবল তাই নয়, খাদ্যের সন্ধানে পাহাড় থেকে বন্য হাতির দল লোকলয়ে নেমে আসতে থাকে এবং মানুষের ঘরবাড়ী ও ফসলের ওপর বন্যহাতির আক্রমণও চলতে থাকে।

বন অধিদপ্তরের ২০১০ সালের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে শেরপুরের নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় মোট সংরক্ষিত বনের পরিমাণ ৬ হাজার ৩২৭ দশমিক ৬৬ একর। কিন্তু সংরক্ষিত বন থাকলেও সেখানে সংরক্ষিত গাছ নেই। বন বিভাগের সংরক্ষিত বনের ভেতরেই প্রাকৃতি শাল-গজারীর বাগান কেটে সামাজিক বনায়নের নামে আগর বাগান, রাবার বাগান করা হয়েছে।

পাহাড়ের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে সীমান্তবর্তী গারোপাহাড়ের বন বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, বানর, বনমোরগ, শুকরসহ নানা প্রজাতির পশু-পাখিতে ভরপুর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব বন্য পশু-পাখি বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখন আর আগের মতো এসব বন্য প্রাণী চোঁখে পড়েনা। প্রাকৃতিক বন উজার করার ফলে বন্যহাতি পাহাড়ী এলাকায় তান্ডব চালাচ্ছে বলে এলাকাবাসীরা জানান।

নালিতাবাড়ীর আন্ধারুপাড়া গ্রামের ছামাদুল হক বলেন, আমি ছোট সময় দেখেছি এই এলাকার গারো পাহাড়ে প্রাকৃতিক ঝর্ণা প্রবাহমান ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক বন কেটে সামাজিক বনায়ন করায় এখন পাহাড়ী ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। স্থানীয় হোসেন আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আলহাজ আলী বলেন, প্রাকৃতিক বন কেটে সামাজিক বনায়নের আকাশমনি, মিনজিয়াম ও ইউকিলিপটাশ গাছ লাগানো হয়েছে। এসব গাছ প্রয়োজনের তুলনায় পানি শোষন করে বেশি। যে কারনে পাহাড়ী ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। তাছাড়া এসব গাছের পাতা পচেনা। এই গাছে পাখিও বাসা বাঁধে না। তাই গারোপাহাড়ের জীববৈচিত্র এখন হুমকির সম্মুখীন। ঋতু বৈচিত্রে এখন গড়মিল দেখা দিয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া এর অন্যতম কারন। এসব গাছ জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারন। যার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষের।

আদিবাসী লেখক মিকরাল ম্রং বলেন, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পাহাড়ে প্রাকৃতিক সম্পদগুলো প্রকৃতির নিয়মেই বেড়ে ওঠতে দিতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছগুলো কেঁটে কৃত্রিম গাছ লাগানো পাহাড়ী জনপদের মানুষ ও বন্যপ্রাণীদের কোনোভাবেই সুবিধা দিতে পারেনি। বরং তাদেরকে সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছে। শ্রীবরদী ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রাঞ্জল এম. সাংমা বলেন, প্রাণবৈচিত্র রক্ষা চুক্তি অনুযায়ী দেশের শতকরা ২৫ ভাগ বনভুমি থাকার কথা। এর মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকার কথা থাকলেও আমাদের দেশে তা না থাকায় প্রাণবৈচিত্র এখন হুমকীর মুখে পড়েছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা’র সিনিয়র গবেষণা কর্মকর্তা সোমনাথ লাহিড়ী বলেন, বন বিভাগের সামাজিক বনায়নের কারণে শেরপুরের পাহাড়ী জনপদের অনেক ঝোড়ার প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ কমে গিয়ে সেই সব ঝোড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর ফলে পানির অভাবে এলাকায় চাষাবাদ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। বনের ভেতর প্রাণবৈবিচত্র কমে গেছে। তাছাড়া কোন নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে পাহাড়ী এলাকার বিভিন্ন নদী ও বসতভিটার মাটি খুড়ে শ্যালো মেশিনের সাথে দীর্ঘ পাইপ সংযোগ করে কাঁচবালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ভূমি ধ্বস সহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে।

এ ব্যাপারে শেরপুর বনবিভাগের বাতকুচি বিট কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, প্রাকৃতিক বন কেটে সরকারি সিদ্ধান্তে সামাজিক বনায়নের সুফল এলাকার গরীব-অসহায় মানুষ পেতে শুরু করেছে। তবে জলবায়ুর উপর কিছুটা বিরূপ প্রভাবও পড়েছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে সরকার জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলায় ইতোমধ্যেই সামাজিক বনে দীর্ঘ মেয়াদী মিশ্র বাগান সৃজনের পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। এর মধ্যে বনজ, ফলদ, ঔষধী ও কাঠ গাছের চারা লাগানো হবে। বিশেষ করে অর্জুন, চাপালিশ, গর্জন, চিকরাশি, গামারি, হরতকি, আমলকি, বহেরা, ডেওয়া, জলপাই, তুন, সিবিট, লোহাকাঠ, তেলসুর ইত্যাদি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষা পাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।


(ওএস/এটিআর/জুন ০৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test