E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্যার, কিছু একটা করুন: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

২০১৪ মে ২৯ ১৩:১২:২১
স্যার, কিছু একটা করুন: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

নিউজ ডেস্ক : এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, আমি এখন সেটা নিশ্চিতভাবে জানি। আমার কাছে তার প্রমাণ আছে। সারাদেশ থেকে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগেই সেগুলো আমাকে পাঠিয়েছে।

আমি তাদেরকে অনুরোধ করেছি- সত্যি সত্যিই যদি এগুলো পরীক্ষায় চলে আসে তাহলে তারা যেন আমাকে জানায়। পরীক্ষার পর তারা আমাকে জানিয়েছে, পরীক্ষার প্রশ্ন স্ক্যান করে আমাকে পাঠিয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানের ফাঁস হওয়া এবং সত্যিকারের প্রশ্নগুলো আমি সংবাদ মাধ্যমে ছাপিয়ে দিয়েছিলাম। অন্যগুলো করিনি, রুচি হয়নি, প্রয়োজন মনে হয়নি। ফেসবুকে এবং ইন্টারনেটে সারা পৃথিবীর মানুষ যেটা জানে, আমাকে কেন আলাদাভাবে সেটা জানাতে হবে? তারপরও বলছি- পরীক্ষার আগেই যে প্রশ্নগুলো আমার কাছে এসেছে, আমার কাছে তার প্রমাণ আছে, কেউ চাইলে দেখতে পারে।

প্রশ্ন ফাঁসের একটি বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে, কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে সংবাদ মাধ্যমে সেটি একেবারেই গুরুত্ব পায়নি। আমি ভেবেছিলাম এটি সংবাদপত্রে হেডলাইন হবে, হয়নি। ভেবেছিলাম টেলিভিশনে রিপোর্টের পর রিপোর্ট হবে, হয়নি। ভেবেছিলাম দেশের শিক্ষা বিষয়ের এনজিওগুলো সোচ্চার হবে, তারা মুখ খোলেনি। আমার মনে হচ্ছে- আমি বুঝি একা চিৎকার করে যাচ্ছি, শোনার কোনো মানুষ নাই। আমি অনেক আশা করে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলাম, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি, প্রশ্ন ফাঁসকে ‘সাজেশন’ বলে উড়িয়ে দিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত যে বড় বড় কর্মকর্তারার প্রশ্নটা ফাঁস করলেন, তাদের বিরুদ্ধে একটা কথা না বলে যারা এটা একে অন্যের কাছে বিতরণ করল, শুধু তাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন।

সমস্যা হচ্ছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরোটা ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। যে এগারো লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তারা আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ছেলেমেয়ে, তারা আমাদের স্বপ্নের ছেলেমেয়ে। তারা একটা প্রজন্ম, একটু একটু করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে তারা এতোদূর এসেছে। আমরা তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারব না।

এদের ভেতর কিছু ছেলেমেয়ে আছে, তারা প্রশ্ন পেয়েও সেটি দেখেনি। নিজের মতো করে পরীক্ষা দিয়েছে। প্রশ্ন কঠিন ছিল বলে পরীক্ষা ভালো হয়নি। তারা ক্ষুব্ধ, কারণ যারা ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে, ভবিষ্যতের সকল সুযোগ এখন তাদের জন্যই উন্মুক্ত হয়ে আছে। যারা নিজের কাছে সৎ থেকেছে, তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। যখন স্বপ্ন শুরু হয়, তখনই তাদের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে।

যারা ফাঁস করা প্রশ্ন পড়ে পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের ভেতর এখন তীব্র অপরাধবোধ। তারা এই অনৈতিক কাজটা মোটেও করতে চায়নি, প্রশ্ন ফাঁস না হলে তারা সেটি করতো না। প্রলোভন দেখিয়ে তার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, অনেক সময় শিক্ষক, এমনকি বাবা মা তাদেরকে এখানে ঠেলে দিয়েছে। এই অপরাধবোধ একেকজনের ভেতর একেকভাবে কাজ করেছে কিন্তু একটি বিষয় সত্য, কারো ভেতরে কোনো আনন্দ নেই। যারা অর্থ এই দেশের এগারো লক্ষ পরীক্ষার্থীর কারো ভেতরে কোনো আনন্দ নেই। পুরো একটি প্রজন্মকে এতো পরিপূর্ণভাবে ক্ষুব্ধ আর হতাশাগ্রস্ত কি এর আগে কেউ কখনো করতে পেরেছে? রাষ্ট্রীয়ভাবে এর আগে কী কেউ কখনো একটা তরুণ প্রজন্মকে অন্যায়কে দেখেও না দেখার ভান করে দূর্নীতির পাঠ দিয়েছে? মনে হয় না।

এই ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন ফাঁস করেনি। কোনো রিকশাওয়ালা প্রশ্ন ফাঁস করেনি, গার্মেন্টসের কোনো মেয়ে প্রশ্ন ফাঁস করেনি, কোনো শ্রমিক, কোনো চাষী, কোনো দিনমজুর প্রশ্ন ফাঁস করেনি। প্রশ্ন ফাঁস করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থার খুব ওপরের দিকের মানুষ, যারা প্রশ্ন প্রণয়ন করেন, যারা প্রশ্ন ছাপন, যারা সেগুলো বিতরণ করেন, তারা। এই দেশের এতো বড় সর্বনাশ করেছে কারা, আমরা কী সেটা কখনোই জানতে পারব না? ‘প্রশ্ন ফাঁস হয়নি’- বলে এই দেশের সবচেয়ে বড় অপরাধীদের কেন রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে?
এই দেশের শিক্ষার্থীরা আমাকে শুধু একটা কথাই বলছে- ‘স্যার, কিছু একটা করুন!’

আমি কী করব? যা করতে পারি, একটুখানি লেখালেখি- সেটা তো যথেষ্ট করছি, কোনো লাভ হয়নি। এর আগের লেখায় কথা দিয়েছিলাম- যদি কিছুই করতে না পারি, তাহলে অন্ততঃ প্রতিবাদ হিসেবে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে শহীদ মিনারে বসে থাকব, তাই ঠিক করেছি। এই শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকব। (খুব আশা করছি তখন যেন আকাশ কালো হয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভালো লাগে।) অপরাহ্নে আমাকে একটা সংগঠন পুরষ্কার দেবে, তা না হলে সারাদিন বসে থাকতাম।

কেন আমি এটা করতে যাচ্ছি? না, আমি মোটেও আশা করছি না কিছু একটা হবে। যদি হওয়ার থাকতো, এতোদিনে হয়ে যেতো। তবুও আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত এই প্রতিবাদটি করব আমার দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য। তাদেরকে বলব, তোমরা আশা হারিও না, স্বপ্ন হারিও না। আমরা এই দেশের স্বপ্ন দেখি তোমাদের সুখের দিকে তাকিয়ে। তোমরা যদি স্বপ্ন না দেখো, আমরা তাহলে কী নিয়ে স্বপ্ন দেখবো? আমি তাদেরকে বলব, তোমরা নিজেকে অপরাধী ভেবো না, তোমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ো না। তোমরা হতভাগা নও। হতভাগা আমরা, যারা তোমাদেরকে এখনো স্বপ্ন দেখার সুযোগও করে দিতে পারিনি। ফরিদপুরের সেই পরীক্ষার্থী তরুণিটি যে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে পাগলের মতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছে, যাকে সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, আমি তার কাছে এই দেশের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাই। আমি তাকে বলতে চাই, আমি তোমার ক্ষোভটুকু অনুভব করতে পারি, একদিন এই দেশে নিশ্চয়ই তোমার মতো তরুণিদের এই তীব্র ক্ষোভ নিয়ে পাগলের মতো পথে পথে ছুটতে হবে না। আমরা পারিনি, তোমরা ভবিষ্যতের প্রজন্মকে সেই দেশ উপহার দিতে পারবে।

সরকারের উদ্দেশ্যে কী কিছু বলব? জানি কোনো লাভ নেই, তবুও বলছি। এটি কোনো দাবি নয়, এটি বিনীত একটি অনুরোধ। প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে সেটি স্বীকার করুন। সমস্যাটা আছে, সেটা মেনে নিলেই শুধু সেই সমস্যা সমাধান করা যায়। সমস্যাটা অস্বীকার করলে সেই সমস্যার সমাধান কেমন করে হবে? প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে মেনে নেওয়ার পর এই ভয়াবহ বিপর্যয় দেখে মুক্তি পাওয়ার জন্যে কী করতে হবে সেটা বের করার জন্য একটি পাবলিক হিয়ারিংয়ের ব্যবস্থা করুন। দেশের মানুষের কাছে, ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদদের কাছে জানতে চান কী করা যেতে পারে। আমি নিশ্চিত, তারা সঠিক বাস্তব একটা সমাধান বের করে দেবে।

আমরা জেনে গেছি, মন্ত্রণালয়ে বা শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে অনেক মানুষ আছে যাদের এই দেশের জন্যে কোনো মায়া নেই। কিন্তু এই দেশের সাধারণ মানুষের বুকের ভেতর দেশের জন্যে গভীর ভালোবাসা রয়েছে। তারা এই দেশটাকে ধ্বংস হতে দেবে না।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test