E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তথ্যসেবায় অনন্য জাপান

২০১৪ আগস্ট ২৮ ১২:৫১:১৪
তথ্যসেবায় অনন্য জাপান

প্রবীর বিকাশ সরকার : একুশ শতক তথ্যের যুগ। তথ্য প্রযুক্তির যুগ। তথ্য জানার এবং আদানপ্রদানের যুগ। সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য জানানোর যুগ। তথ্যবিনিময়ের যুগ। অন্যান্য দেশের কী অবস্থা বলতে পারব না যেহেতু জাপানপ্রবাসী জাপানের কথাই শুধু জানি।

এদেশে কত বিভিন্ন পন্থায় যে তথ্যের আদানপ্রদান ঘটে চলেছে প্রতি মুহূর্তে তা স্বচক্ষে না দেখলে অবিশ্বাস্যই মনে হবে। তথ্যজানা ও জানানো গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান শর্ত। প্রাতিষ্ঠানিক স্বপ্রচারযন্ত্রে বা মাধ্যমে তথ্য প্রদান করা, তুলে ধরা আর গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য প্রচার করার মধ্যে বহু পার্থক্য এবং গড়মিল বিদ্যমান থাকে এটা উন্নত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও।

জাপানে তথ্য প্রচার ও প্রদানের ক্ষেত্রে অসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করা হয়ে থাকে। দেশ, জাতি এবং জনগণের স্বার্থে ভুল তথ্য প্রচার ও প্রদান এক কথায় অমার্জনীয় অপরাধ! এই দেশে মানগা তথা কমিকস্ এবং অ্যানিমেশনের মাধ্যমেও তথ্য প্রচার করছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে সর্ববয়সী নাগরিক সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয়। জাপানিদের এই সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার তুলনা মেলা ভার! বিশেষ করে সরকারি দপ্তর এবং নগর অফিসগুলোতে স্বচ্ছ তথ্যসেবার যে অনন্য ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের শিক্ষা নেবার দরকার আছে। তারপরও তথ্যগোপন করার উদাহরণ যে নেই তা নয়- কিন্তু ধরা পড়ছে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হচ্ছে। সদাজাগ্রত গণমাধ্যমের শ্যেন্ দৃষ্টি থেকে রক্ষা নেই।

এইদেশে বড় বড় বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুদ্রিত বুলেটিনের পাশাপাশি ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট রয়েছে, রয়েছে মেইল-ম্যাগাজিন, ফেইসবুক ইত্যাদি। ক্ষুদ্র-মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন এই প্রবণতার অনুসারী। রাস্তাঘাট, অফিসআদালত, হাসপাতাল, স্টেশন, উদ্যান, শপিংমল, যানবাহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খাবারের দোকান সর্বত্র তথ্যের ছড়াছড়ি, ওড়াওড়ি। হাজার লক্ষ পত্রিকা, সাময়িকী, প্রচারপত্র তো আছেই। ভালো করে তথ্য জেনে নিয়ে কাজ করাটাই এখন জাপানিদের সংস্কৃতি।

জাপানে ৪৩টি প্রিফেকচার বা প্রদেশ, ২টি ফু--ওসাকা ও কিয়োতো, একটি দোও- হোক্কাইদোও এবং একটি তো- মেট্রোপলিস টোকিও। জাপানের রাজধানী টোকিও মেট্রোপলিটান সরকার দ্বারা পরিচালিত। টোকিও নিজেই একটি প্রিফেকচার (প্রদেশ)। টোকিও মোট ২৩টি কু বা ওয়ার্ড, ২৬টি শি বা সিটি, ৫টি মাচি বা টাউন এবং ৮টি মুরা বা গ্রাম নিয়ে গঠিত। প্রত্যেকটির রয়েছে নিজস্ব প্রশাসন এবং নাগরিক দ্বারা নির্বাচিত নগর পরিষদ। অনুরূপ প্রত্যেকটি প্রদেশেরও রয়েছে ওয়ার্ড, সিটি, টাউন এবং গ্রাম। এবং সবগুলো নগর প্রশাসনই স্থানীয় স্বশাসন আইনের অধীন। কেন্দ্রিয় সরকার সবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কাজেই ফাঁকি-ঝুঁকির কোনো সুযোগ নেই, ধরা পড়লে জীবনের জন্য খতম!

এই নগর প্রশাসনগুলোর প্রথম কাজটিই হচ্ছে নাগরিকদের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরা। ওযেবসাইট, চিাঠপত্র প্রেরণ, সিটি অফিস তথা নগর দপ্তরের অভ্যন্তরে তথ্যকেন্দ্র তো আছেই তারপরও প্রতিমাসে একটি নিয়মিত বুলেটিন প্রকাশ করে থাকে। (ছবিতে বামে টোকিও সরকার এবং ওয়ার্ড তথা স্থানীয় নগর দপ্তরের বুলেটিন।) সারাদেশব্যাপী প্রতিটি নগর দপ্তর থেকেই এই বুলেটিন প্রকাশিত হচ্ছে। সাধারণত ৮ পৃষ্ঠার এই বুলেটিনে কী রয়েছে? সব আছে নাগরিকদের জীবনযাপনসংক্রান্ত তথ্য ও সংবাদ। প্রশাসন কী কী প্রকল্প, পদক্ষেপ নিচ্ছে, কী কী সফলতা, কী কী ব্যর্থতা, কী কী অক্ষমতা সবই থাকছে। থাকছে প্রশাসনিক খরচাদির হিসাব, বিভিন্ন প্রদেয় কর, করের হিসাব, বিভিন্ন বীমা, পেশশন, বয়স্ক ভাতা, বাণিজ্য, নাগরিক পরিচিতিপত্র, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের সনদপত্র, শিশুশিক্ষা, শিশুভাতা, দুস্থসেবা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, আবর্জনা-পরিবেশ, স্বেচ্ছাসেবা, সেমিনার, গ্রন্থাগার, বার্ষিক মিলনমেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি, কোথায় কী হচ্ছে, কী হবে, চাকরির বিজ্ঞপ্তি, লোকসংখ্যা ইত্যাদি।

এসব স্বচ্ছতা থাকার পরও জাপানি রাজনীতিক, মন্ত্রী, সচিব, সাংসদ, গর্ভনর, মেয়র, কাউন্সেলররা সচেতন নাগরিক দ্বারা এই ভুল সেই ভুল, এটা খারাপ ওটা খারাপ, এটা হবে না ওটা হবে না, কেন হল না কেন হয়নি ইত্যাদি অভিযোগে প্রতিনিয়ত অভিযুক্ত হচ্ছেন। সম্পূর্ণ স্বাধীন সংবাদপত্র ও টিভি জনগণের বক্তব্য ও অভিমতকে তুলে ধরছে। গবেষক, শিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবী, মানবাধিকার কর্মী এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন আলোচনা, সেমিনার, সমাবেশে ধুয়ে ফেলছেন শাসকদেরকে! এইদেশে বিগত ৩০ বছর ধরে দেখে আসছি রাজনীতিক, পুলিশ আর ব্যবসায়ী সর্বক্ষণ দৌড়ের ওপর আছেন। গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে যারা দেশ পরিচালনা করবেন তাদেরকে অবশ্যই প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। ব্যক্তিগত চয়েস বলে কোনো জিনিস থাকতে পারবে না কারণ জনসেবা বলতে কথা! কর প্রদান ও জবাবদিহিতা আদায় করা জাপানি জনসাধারণের সবচে বড় শক্তি ও হাতিয়ার এই দুটি এনার্জির কারণে অর্থনীতি ঝিমুতে পারে না, রাজনীতি জটিল হতে পারে না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে সবই উল্টো। সঠিক তথ্য জানা বা জানানো তো দূরের কথা যারা পদে ও চেয়ারে আছে তাদের নিজেদেরই কোনো সঠিক তথ্য বা ডেটা নেই! এভাবে স্বাধীনতার পর একটি স্বাধীন-সভ্য জাতি ৪০ বছরের বেশি অতিক্রম করে চলে এসেছে এখনো সচেতনতার কোনো লক্ষণ নেই! জনগণের সবচে কাছের নির্ভরযোগ্য যে সেবাদান প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা একটিরও কোনো মানমর্যাদা নেই, শক্তি নেই, স্বচ্ছতাও নেই। যে কী অবস্থা বলে লাভ নেই! জনগণও সোচ্চার নয়, নয় সচেতন। যেমন নাগরিক তেমন নগর / কাজ নেই শুধু বগর বগর!

লেখক : জাপান প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test