E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কোম্পানীগঞ্জের বেড়ী বাঁধের যুদ্ধের রণাঙ্গন

২০১৪ সেপ্টেম্বর ০৪ ১০:৫২:০০
কোম্পানীগঞ্জের বেড়ী বাঁধের যুদ্ধের রণাঙ্গন

মোঃ মুজিবুর রহমান : আজ ৪ সেপ্টেম্বর । ১৯৭১ সালের এইদিনে কোম্পাীগঞ্জের বামনীর বেড়ী বাঁধের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাসহ নয় জন। আজকের দিনটি তাই কোম্পানীবাসীর কাছে স্মরণীয়। ১৯৭১ সালের  ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে কোম্পাীগঞ্জ উপজেলা  মুজিব বাহিনী বা  বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স ( বিএলএফ) কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একটি অপারেশন শেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চরফকিরা ইউনিয়নের বাঞ্চারাম বামনী বেড়ী বাঁধের মাঝামাঝি স্থান পৌঁছলেই রাজাকারদের নিদের্শনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।  মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালায়। মুখোমুখি যুদ্ধ চলে অনেকক্ষণ।

পুরো ১৫ নম্বর স্লুইসের যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণের শীতল বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠে। অন্যদিকে মেঘলা আকাশ। মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবু নাছের আহত অবস্থায় ক্রলিং করে গিয়ে বেড়ার টংঘরে আশ্রয় নেন। এদিকে আরেকটি টংঘরে আরও আশ্রয় নেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক, মুক্তিযোদ্ধা কেফায়েত উল্যা আর মুক্তিপাগল একজন খালেদ মুমিন। খালেদ মুমিন ছিলেন এলাকার একজন শিক্ষক। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ছিল আরও ক’জন মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ। বিএলএফ’র ডেপুটি কমান্ডার খিজির হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গ্রুপ আরেকটি অপােেরশন শেষ করে ১৫ নম্বর স্লুইসে প্রথমে অবস্থান নেয়। সেখানেই কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের একত্র হওয়ার কথা ছিল। সকাল দশটার দিকে ডেপুটি কমান্ডার খিজির হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি দেখতে পায় একটি পাকিস্তানি সেনা হেলিকপ্টার আকাশে টহল দিচ্ছে। হেলিকপ্টার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালাতে পারে এই ভেবে ১৫ নম্বর স্লুইসের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে ওই গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা ১৬ নম্বর স্লুইসে অবস্থান নেন। অন্যদিকে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী ১৫ নম্বর স্লুইসে অবস্থান নেয়। কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাকের দলটি পূর্বদিকে বেড়ী বাঁধের উপর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে আসতে থাকে। বেড়ী বাঁধকে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ ভাবেন। ওই গ্রুপের ( কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন ) মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিলেন তাদের সহযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার খিজির হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি অপেক্ষা করছে ১৫ নম্বর স্লুইসে। কিন্তু এর পূর্বেই যে ১৫ নম্বর স্লইস ত্যাগ করে খিজির হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি ১৬ নম্বর স্লইসে অবস্থান নিয়েছে তা জানা ছিল না। না জানার কারণেই কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটি রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর এমবুশের মুখোমুখি হয়ে যায।এমবুশের সামনে হঠাৎ পড়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা কিছু বুঝে ওঠার অগেই শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সেদিনের সম্মুখ যুদ্ধে ০৬ সহযোদ্ধাকে হারাতে হয়। সে সঙ্গে সেদিন মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ তিনজন শহীদ হয়েছিল। মোট নয় জন প্রাণ হারায়।

যুদ্ধ শেষে পাকিন্তানি দুই সৈন্যের মৃতদেহ নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে ১৬ নম্বর স্লুইসের অবস্থানকারী খিজির হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি আবার ১৫ নম্বর স্লুইসে এসে নিহতদের লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে। তন্মধ্যে বামনি বেড়ির ১৬ নম্বর স্লুইসে গেট এলাকায় দাফন করা হয় শহীদ সালেহ আহম্মদ মজুমদার , শহীদ আক্তারুজ্জামান লাতু ও শহীদ ইসমাইলকে। কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুরে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয় শহীদ মোস্তাফ কামাল ভুলুকে এবং শহীদ আব্দুর রব বাবুকে দাফন করা হয় রামেশ্বরপুর বেড়ীর দক্ষিণ পাশে ( বর্তমানে লামচি প্রসাদ )। এদিকে ঝড় বৃষ্টি রাতে সেদিন শহীদ আমান উল্যা ফারুকের লাশ পাওয়া যায়নি। ৪০ বছর পর্যন্ত তা কবরের তথ্য জানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর জানা যায় ১৫ নম্বর স্লুইসের রাখালরা শহীদ আমান উল্যা ফারুকের লাশ পেয়ে ৫ সেপ্টেম্বর ( যুদ্ধের পরদিন) ওই এলাকায় দাফন করে রাখে। ওই রাখালরা এখন বয়োবৃদ্ধ। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে।

শহীদ সালেহ আহম্মদ মজুমদার, শহীদ আক্তারুজ্জামান লাতু ও শহীদ ইসমাইলকে যে স্থানে ( ১৬ নম্বর স্লুইস ) দাফন করা হয় সেটি এখন মুক্তিযোদ্ধা বাজার নামে পরিচিত। ওই এলাকায় শহীদ ইসমাইলের নামে ১৯৮৭ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষের সহায়তায় শহীদ সালেহ আহম্মদ মজুমদার, শহীদ আক্তারুজ্জামান লাতু , শহীদ ইসমাইল ও শহীদ আমান উল্যা ফারুকের কবর সংস্কার করে টাইলস দিয়ে বাাঁধানো এবং ঘেরাও করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে বাস্তাবায়ন করেছে। অন্যদিকে শহীদ আমান উল্যা ফারুকের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শহীদ সালেহ আহম্মদ মজুমদারের নামে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে চৌমহনী কলেজের নাম চৌমুহনী সালেহ আহম্মদ কলেজের নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রক্তক্ষয়ী। আর বামনীর বেড়ী বাঁধের সেই রণাঙ্গন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযদ্ধের ইতিহাসে আরেক রক্তাক্ত প্রান্তর। নয় জন বীরের তাজা রক্ত দিয়ে লেখা ৪ সেপ্টেম্বর।

ওই যুদ্ধের শহীদদের কবর সংরক্ষণের যে উদ্যোগ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ গ্রহণ করেছে, সেই উদ্যোগের কারণে সাধুবাদ জানাই। এমন দিন আসবে কোনো মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে থাকবে না। তখন এ উদ্যোগ শহীদদের স্মৃতি বহন করবে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামে এলাকার সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ও সেতুর নামকরণের সুবাদে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম তাদের গর্বের ধন পুর্বসূরীদের সম্বন্ধে জানার সুযোগ পাবে বলে বিশ্বাস করি। পাশাপািশ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি ইতিহাস বিকৃতি করতে সাহস পাবে না।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং আর্কাইভস ৭১ এর প্রতিষ্ঠাতা।

(অ/সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test