E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পথের ধুলো থেকে : শেষ পর্ব

প্রশাসনিক মডেল হিসেবে এখনো সেরা একাত্তর বাহাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশাসন!

২০২১ সেপ্টেম্বর ২১ ১৪:১৮:৪৩
প্রশাসনিক মডেল হিসেবে এখনো সেরা একাত্তর বাহাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশাসন!

সাইফুল ইসলাম


মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের প্র্রশাসন’, যা এখনো অনালোচিত। পেশাদার ইতিহাসবিদদের এ অধ্যয়টি এখনো নজরেই আসেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা ইতিহাস লেখার চেষ্ঠা করেছেন তাদের লেখাতেও এ ব্যপারে তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা স্মৃতিচারণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তাদের লেখায় ছিঁটেফোটা এসেছে অবচেতন ভাবে। অনুসন্ধানী লেখক-সংগঠকদের এ বিষয়টি যখন নজরে আসে তখন তারা আরও খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করে। জানার চেষ্টা করে দেশের অন্যান্য স্থানের অবস্থা। অনুসন্ধানী লেখব সংগঠকরা জানতে পারেন, সারাদেশেই এমন প্রশাসনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. আলাউদ্দিনসহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, ১৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় সিরাজগঞ্জ শহর। থানার কাছাকাছি থাকা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলো বিপুল জনতাকে সাথে নিয়ে দখল করে নিতে থাকে বিভিন্ন থানা। তার আগেই ২৬ নভেম্বর চৌহালী থানার ক্যাম্প মালিপাড়ায় হামলা চালানো হয়। পরের দিন সেখান থেকে পাকিস্তান সেনারা সরে এলে এই থানা মুক্ত হয়। ৩ ডিসেম্বর কাজীপুর থানায় হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। সেখান থেকেও সরে আসে পাকিস্তান সেনা। ৪ ডিসেম্বর দখলে নেয় মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান দুদুর গ্রুপ। ১৩ ডিসেম্বর রাতে সিরাজগঞ্জ শহর ছেড়ে পালায় পাকিস্তান সেনারা। একে একে মুক্ত হয় কামারখন্দ, বেলকুচি, রায়গঞ্জ, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, সর্বশেষ শাহজাদপুর।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি প্রশাসনে কর্মরত ছিল বিপুল সংখ্যক বাঙালি। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সংগ্রহের কৌশল হিসেবে পাকিস্তানিদের দুর্বল ঘাটি অর্থাৎ পুলিশ ক্যাম্প ও রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালাতো। কোথাও কোথাও আপোষে অস্ত্র সমর্পণ করেছে তারা, আবার কোথাও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আর সেনাবাহিনীর উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পালিয়ে যেত মুক্তিযোদ্ধারা, যাতে ভীত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। নভেম্বর-ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযানে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী। এলাকা হানাদার মুক্ত হওয়ায় পাকিস্তানি প্রশাসনে জড়িয়ে থাকা বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা ভীত হয়ে এরা ভয় অথবা কেউ হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। সবচেয়ে বেশি ভীতি সৃষ্টি হয় সশস্ত্র ব্যক্তি অথাৎ কর্মরত পুলিশ, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। তারাও অস্ত্র ফেলে দিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্প বা থানা থেকে পালিয়ে যায়। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে থাকা আত্মীয়স্বজনকে হণ্যে হয়ে খুঁজতে থাকে, কারণ মুক্তিযোদ্ধারাই তাদের রক্ষা করতে পারে বলে তাদের ধারণা। খুব কম সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতো- তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এ সময় সিরাজগঞ্জ মহুকুমায় এসডিও হিসেবে এএম আলীমুজ্জামান এবং এসডিপিও হিসেবে আব্দুর জব্বার কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ে তারা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন।

হানাদার মুক্ত সিরাজগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। আমির হোসেন ভুলু সিরাজগঞ্জ কলেজ হোস্টেলে, ভিক্টোরিয়া স্কুলে ইসমাইল হোসেন (দোয়াতবাড়ি), কওমী জুট মিলে আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, খম আকতার, বাসেত মাষ্টার ও ফজলুল মতিন মুক্তারা ইসলামিয়া কলেজ, ইসমাইল হোসেন (রহমতগঞ্জ) স্পিনিং মিল, তৌহিদ-পান্না সিও অফিস, মোক্তারপাড়ার সাহারা ক্লাবে আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বাধীন পলাশডাঙ্গা যুব শিবির ক্যাম্প গড়ে তোলে। ন্যাপ মোজাফ্ফর গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দলীয় কার্যালয় মাড়োয়ারি পট্টিতে নিয়মিত বসতে শুরু করে।

বিভিন্ন থানায় বা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প গড়ে ওঠে। রায়গঞ্জ থানায় ধানগড়া ও নিমগাছীতে প্রধান দু’টি ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ধানগড়া ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন শেখ আলাউদ্দিন এবং নিমগাছীতে কবি সমুদ্র গুপ্ত ওরফে আব্দুল মান্নান। উল্লাপাড়ায় ক্যাম্প গড়ে তোলেন খোরশেদ আলম। একই ভাবে উল্লাপাড়ার মোহনপুর স্টেশনেও ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়্। শাহজাদপুর থানায় ক্যাম্প করেন খালেকুজ্জামান। উল্টাডাবের আব্দুল হাই তার বাহিনী নিয়ে বেলতৈল ইউনিয়নের ঘোরশালে ক্যাম্প করেন। মির্জা আব্দুল বাকী খোকন পলাশডাঙ্গার সদস্যদের নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেন শাহজাদপুর কলেজে।

সিরাজগঞ্জে কেন্দ্রীয় ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয় বাহিরগোলা পাওয়ার হাউজে। ‘বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সেখানে। বৈঠকে স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগি প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘প্রশাসন পূনর্গঠন কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক আলী জানান, ‘এই কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন আমির হোসেন ভুলু, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুল লতিফ মির্জা, ইসহাক আলী, ইসমাইল হোসেন (দোয়াতবাড়ি), ইসমাইল হোসেন (রহমতগঞ্জ) প্রমুখ। বৈঠকে আমির হোসেন ভুলুকে সিরাজগঞ্জ মহুকুমা মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক এবং আব্দুল লতিফ মির্জাকে সহ-সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। বেসামরিক মহুকুমা প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয় ইসমাইল হোসেনকে (দোয়াতবাড়ি।)’ আমির হোসেন ভুলু এসডিপিও এবং ইসমাইল হোসেন এসডিও অফিসে বসে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করতে থাকেন। অবস্থান ও কর্মপদ্ধতির কারণে তারা দুই জন সিরাজগঞ্জবাসীর কাছে এসডিও এবং এডিপিও হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোঃ আলাউদ্দিন জানান, প্রশাসন পূণর্গঠন কাউন্সিল থেকে সিরাজগঞ্জ সদর থানা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পান গোলাম কিবরিয়া। কাজীপুর থানার দায়িত্ব পান লুৎফর রহমান দুদু। এভাবেই কামারখন্দ থানা বিমল কুমার দাস, রায়গঞ্জে ইসহাক আলী ও শেখ আলাউদ্দিন, তাড়াশ থানা ইসহাক আলী ও আমজাদ হোসেন মিলন, বেলকুচি লুৎফর রহমান মাখন. চৌহালী নওশের আলী মাষ্টার, উল্লাপাড়া খোরশেদ আলম, একই থানায় উন্নয়নের দায়িত্ব লাভ করেন আব্দুল আজিজ মির্জা। শাহজাদপুর থানা প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন আব্দুল বাকী মির্জা খোকন। সেখানে খাদ্য ও শিক্ষার দায়িত্ব পান শাহেদুজ্জামান হেলাল।

কামারখন্দ থানার আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের দায়িত্ব পালন কালে মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার দাস সিও অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার দাস জানান, ‘ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু রাজাকারকে আটক করেন। কোনো কোনো রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য এসে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদের আটক রাখা হয় থানা হাজতে। এসব স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের দিয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা মেরামতের কাজে লাগানো হয়। কামারখন্দ সিও অফিস ক্যাম্প থেকে বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয় ঝাঐল ইউনিয়নে। উদ্দেশ্য যুদ্ধের সময় লুট হওয়া মালামাল উদ্ধার। মুক্তিযোদ্ধারা ওই এলাকায় গিয়ে বেশ কিছু মালামাল উদ্ধার করে তা মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়।’

মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই অনুসন্ধানী লেখক সংগঠকদের জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় কওমী জুট মিল, স্পিনিং মিল চালু করা হয়। চালু করা হয় ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকও। চালু হয় স্কুল-কলেজ। এই প্রশাসনের পক্ষ থেকে কলেজ শিক্ষকদের বেতন, কওমি জুট মিল শ্রমিকদের মজুরিও দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্বা দিতে নিয়োগ করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। ট্রেন যোগাযোগ চালু হলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ট্রেনে উঠে বক্তৃতা দিয়ে যাত্রীদের টিকিট কাটতে সহায়তা করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম জানান, ‘সদর থানার রতনকান্দি ইউনিয়নের গজারিয়ার সরকারি প্রাইমারি স্কুলটি গ্রামের ভিতর থেকে নদীর পাড়ে খোলামেলা জায়গায় নিয়ে আসা হয় ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার সুবিধার জন্য। সেখানে একটি ক্লাব ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। কমিটি গঠন করা হয় গ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়ন ও দূর্নীতি প্রতিরোধের জন্য। এ ভাবেই মহুকুমার প্রতিটি গ্রামে উন্নয়নের স্বতস্ফূর্ত উৎসব শুরু হয়। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠতে থাকে সমবায় সমিতি, ক্লাব, পাঠাগার।’ এভাবেই শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে শুরু হয় স্বাধীনতা পরবর্তী উন্নয়নের জোয়ার।

প্রবাসী সরকার ঢাকায় ফিরে তাদের প্রশাসন পূণর্গঠন শুরু করে। সিরাজগঞ্জে কর্মরত পাকিস্তানি প্রশাসনের এসডিও ও এসডিপিও এম. আলিমুজ্জামান এবং এসডিপিও আব্দুল জব্বারকে প্রত্যাহার করা হয়। সেখানে ১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দায়িত্ব নিয়ে আসেন ইপিসিএস কর্মকর্তা আজিজুর রহমান। ৩১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে অস্ত্র জমা দেয় বিএলএফ মুক্তিযোদ্ধারা, এর মধ্যে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকা মুক্তিযুদ্ধের সকল অস্ত্র হয়ে পড়ে বেআইনী।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক-সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test