E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উত্তাল রেডিও বার্তা থেকে ঐতিহাসিক বিবিসি বাজার

২০২১ ডিসেম্বর ২৭ ০৯:২৪:৪৪
উত্তাল রেডিও বার্তা থেকে ঐতিহাসিক বিবিসি বাজার

রনি ইমরান, পাবনা : বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবান্বিত গল্পে অংশীদার হয়ে আছে পাবনার ঐতিহাসিক বিবিসি বাজার। মুক্তিকামী মানুষদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও মানুষদের উজ্জীবিত করতে রেডিও বার্তা পৌঁছে দেওয়া কাসেম মোল্লা এ গল্পের মহানায়ক। তিনি ঐতিহাসিক বিবিসি বাজারের প্রতিষ্ঠাতা। 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী মানুষ মুক্তির বার্তা পেতে জড়ো হতো কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে। সকাল ও সন্ধ্যার পর আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ রেডিওতে বিবিসির খবর শুনতে আসতো। রেডিওতে শোনা বৃটিশব্রডকাষ্টিং কর্পোরেশন বিশ্বের জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম বিবিসি রেডিওর সেই উত্তাল বাণীতে উজ্জীবিত হয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।

১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের পরে কাশেম মোল্লার নিজ গ্রাম পাকশীর রুপপুরে নিজের হাতে লাগানো কড়ই গাছের পাশেই ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই যখন উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাতো। দেশের খবর কেউ জানেনা। এমন একটি সময় মুক্তিকামী যোদ্ধারা অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকত একটি নির্দেশনার জন্য। তখন অনেক কষ্টের টাকায় কেনা রেডিও নিয়ে খবর শোনাতে হাজির হয় কাসেম মোল্লা।

হানাদার বাহিনীর পিস্তলের বাটের আঘাতে জখম হওয়া পা নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটা কাশেম থ্রি ব্যান্ডের একটি রেডিও কেনেন। সে সময় দশ গ্রামে খুঁজেও একটি রেডিও পাওয়া যেতোনা। দেশে যুদ্ধ লাগার পর দেশের সামগ্রিক অবস্থান নিয়ে বিবিসি বাংলায় খবর প্রচারিত হত। মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হয়ে খবরা-খবর শোনার জন্য তার চায়ের দোকানে অবস্থান নিত।

ধীরে ধীরে সকলের মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খবর শুনে দেশাত্ববোধে জাগ্রত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত মুক্তিকামী জনতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাসেম মোল্লা রেডিওতে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর শোনাতেন।

রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও কলকাতা বেতারের খবর শোনার জন্য আশপাশের মানুষ দু’বেলা নিয়মিত ভিড় জমাতো তার চায়ের দোকানে। চা খেতে আসা নানান লোক জনের নানা তথ্য থাকত কাশেম মোল্লার কাছে। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশীয় দোসর, রাজাকার ও পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সমন্ধে তথ্য দিতেন। ক্রমেই ভীড় বাড়তে থাকল তার চায়ের দোকানে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গড়ে উঠল সম্পর্ক।

অনেক সময় খবর পরিবেশন হয়ে যাওয়ার পর, যোদ্ধারা রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসলে তিনি সেই তথ্যগুলো শুনে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের শোনাতেন।

হঠাৎ একদিন দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগে রাজাকারদের খবরের ভিত্তিতে পাকিস্থানী সেনারা হানা দেয় কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে। কাশেমের কথায় তারা আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। হাতের রোলার আর রাইফেলের বাট দিয়ে তার পায়ে আঘাত করে। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাশেম মোল্লার সেই পা অকেজো হয়েছিল।

রুপপুর গ্রামের প্রবীণ দেলোয়ার হোসেন বলেন, দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা যে যেখানেই থাকতাম সন্ধ্যায় কাশেম ভাইয়ের দোকানে খবরা-খবর শুনতে জড়ো হতাম। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও রেডিও শুনিয়ে অনেক মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছেন। কাশেম ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই। আমরা তার অস্বচ্ছল পরিবারের সদস্যদের ভাতা দানের দাবী জানাই।

কাশেম মোল্লার চাচাতো ভাই রহমান বাবু মোল্লা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাজারে শুধু কাশেম ভাইয়ের চায়ের দোকানই ছিল। তিনি একজন দেশপ্রেমী মানুষ ছিলেন। সন্ধ্যে হলেই রুপপুর গ্রামে হাকডাক শুরু হতো। গ্রামের লোকেরা একে অন্যকে বলত, চল ‘বিবিসি শুনতে যাই’। এভাবেই কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বিবিসি’র খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আরো কয়েকশত দোকান, বিস্তার লাভ করতে থাকে পরিধি। যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরবর্তীতে ‘বিবিসি’ বাজার নামে নামকরণ হয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও তার আর কেউ খবর রাখেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাদানকারী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি আবুল কাশেম মোল্লা। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। না পাওয়ার এই ব্যাথা নিয়েই তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তবে কাশেম মোল্লারা আজও স্বীকৃতি পায়নি।

কাশেম মোল্লার ছোট ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেন, দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সামান্য সরকারি সহায়তা পেয়েছিলেন। এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চিকিৎসার জন্য ৩০ হাজার এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ৫০ হাজার টাকা পান। সেই রেডিও এখনো যত্ন করে রাখা আছে কাশেম মোল্লার আলমারিতে। সেটি নষ্ট হয়ে গেছে ২০ বছর আগে। কিন্তু সরকারিভাবে সেই রেডিও সংরক্ষণ করা হয়নি। কাশেম মোল্লার সন্তানরা তার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দানের জোড়ালো দাবি করেছেন।

কাশেম মোল্লার ছোট ছেলে জায়দুল ইসলাম বলেন, আমার বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার। আমাদের পরিবারের অনেকে এখনো অস্বচ্ছল। আমরা সরকারি সহযোগিতা চাই এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আমার বাবার রেডিও সংরক্ষনের দাবি জানাই।

পাবনা পাকশীর রুপপুরে আজো আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেই বিবিসি বাজার। শুধু কাশেম মোল্লা বেঁচে নেই। নতুন প্রজন্ম আজো জানে না তার গল্প ও প্রকৃত ইতিহাস। তবু ইতিহাসের মনিকোঠায় চির অম্লান হয়ে আছেন তিনি।

(আরআই/এসপি/ডিসেম্বর ২৭, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test