E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মহান মুক্তিযুদ্ধে এক কিশোর

২০২২ ডিসেম্বর ১৯ ১৫:৪৮:৩৭
মহান মুক্তিযুদ্ধে এক কিশোর

চন্দনা সান্যাল


১৯৭১ সাল। দেশে তখন ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। পাকবাহিনীর নির্মমতা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। তারা হত্যা করছে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ। রেহাই পায়নি নারী, শিশু, বৃদ্ধও। এ নির্যাতন প্রতিরোধ জীবনপণ লড়ে যাচ্ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পাকবাহিনী নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, যে কোনো মানুষের পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন ছিল। বয়সে যারা তরুণ তাদের পক্ষে যুদ্ধে না যাওয়াটাই তখন অস্বাভাবিক ছিল। যারা কোনোদিন হয়তো পাখিও মারেনি তারাও হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। মা-মাটি আর দেশকে রক্ষা করার জন্য।

সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার রতন কান্দি গ্রামের দেবেশ চন্দ্র সান্যল এক জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমার পিতৃদেব। তাঁকে এক দিন মুক্তিযুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ২৩ জুলাই’৭১ আমি মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ট্রেনিং ও অস্ত্র গোলা বারুদ নিয়ে একটি গ্রুপের সাথে ৬ সেপ্টেম্বর দেশের অভ্যন্তরে আমি। আমাদের গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন এম.এ মান্নান। আমাদের গ্রুপটি ছিল ১০ জনের। বাসও ট্রেনে ভারতের আসামের মানিকার চর হয়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার রেীমারী মুক্তিযোদ্ধা প্রাথমিক ট্রেনিং ক্যাম্পে এলাম। ৬ সেপ্টেম্বর’৭১ রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯.০০ টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। নৌকা বাহাদূরবাদ ঘাটের সম্মূখ দিয়ে আসতে হয়। রৌমারী ক্যাম্পে থেকে আমরা জানতে পেরে ছিলাম বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা। ঘাটের অদূরে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার ক্যাম্প আছে। তারা ভয়ানক খারাপ। তারা স্পিড বোট দিয়ে রাতে নদী টহল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। আমাদের কমান্ডার স্যার নির্দেশ দিলেন। আমরা সবাই ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকবো। পাকিস্তানি হায়েনারা ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না। যুদ্ধ করবো। যুদ্ধ করে শহীদ হবো। কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিব না ।

রাত ২.০০ টার দিকে আমরা (বাহাদুরাবাদ) ঘাট এলাকা অতিক্রম করতে থাকলাম। ঘাট থেকে হানাদারদের সার্চ লাইটের আলো এসে বার বার আমাদের নৌকার উপর পড়ছিল। ভগবানের কৃপায় ওরা আর স্পীড বোট নিয়ে ধরতে এলো না। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করলাম। আমাদের সাথে চিড়াও গুড় ছিল। ভোরে এক কাইসা খেতের মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে দিল। আমরা সবাই খেতের মাঠে প্রাতঃক্রিয়া সারলাম। চিড়া গুড় দিয়ে সকালের খাবার খেলাম। তারপর মাঝিরা নৌকা চালনো শুরু করলেন। দেখে শুনে নৌকা চালাতে থাকলেন। নৌকাতেই ডালভাত রান্না করে আমাদের খাওয়ালেন। ৪ দিন ভর নৌকা চলার পর ৫ দিনের দিন মধ্য রাতে আমরা বেলকুচি থানার সম্মুখ ভাগে যমুনার চরে পৌছালাম। এই চরটি ছিল হানাদার মুক্ত এলাকা টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলির চরের নিকটে। পরের দিন রাতে যমুনা নদী পার হয়ে চলে এলাম বেলকুচি-কামার খন্দ নিবার্চনী এলাকার এম.এন.এ এ্যাড. জনাব মো: আব্দুল মোমিন তালুকদারে গ্রামের বাড়িতে এম.এন.এ স্যার বাড়িতে ছিলেন না। তিনি ভারতে গিয়ে ছিলেন। তার ভাই জনাব মো: আব্দুর রশিদ তালুকদার আমাদের কে সহযোগীতা করলেন। তিনি আমাদের থাকা খাবার ব্যবস্থা করলেন। আমরা আজ রাতে এ গ্রামে কাল রাতে ও গ্রামে শেল্টাল নিয়ে নিয়ে থাকতে থাকলাম। প্রতিদিন সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম। অস্ত্র পরিস্কার করে তেল দিতাম। তখন গুটি কয়েক স্বাধীনতা বিরোধী ছাড়া অধিকাংশ মানুষ ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে। তবুও অনেকেই পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের ভয়ে আমাদের থাকার জায়গা ও খাবার দিতে চাইতেন না। অধিকাংশ গ্রামেই ছিল শান্তি কমিটির লোক ও রাজাকার।

আমাদের সন্ধান জানলে পাকিস্তানের দালাল ও রাজাকার ক্যাম্পে খোঁজে দিয়ে নিয়ে এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিবে, লুটতরাজ করাবে, বাড়ির মালিককে ধরে নির্যাতন করবে। গ্রামে হত্যা, গণহত্যা, নারী, নির্যাতনের প্রভৃতি মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড চালাতে পারে আবার কিছু বাড়ির মালিক ছিল নির্ভীক। তাঁরা আশ্রয় ও খাবার দিতেন। আমরা কখনও কখনও স্কুলে আশ্রয় নিয়ে থাকতাম। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গোপনে আমাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করতেন। আমাদের সাথে সব সময় চিড়া গুড় থাকতো। কোন দিন খাবার পেতে সমস্যা হলে আমরা চিড়াগুড় খেয়ে থাকতাম। রাত দিন আমরা নিজেরা পর্যায়ক্রমে নিজেদের কে পাহাড়া দিতাম। এই ভাবে কয়েক দিন বয়ড়া মাসুম ও অন্যান্য গ্রামে থাকলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে ইচ্ছুক কিছু যুবককে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ করিয়ে আমাদের সাথে নিলাম। তারা রেকী ও অন্যান্য কাজে আমাদের কে সহযোগীতা করতো। আমরা কোন থানা, পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্প, রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন করার পূর্বে রেকী করতাম। আমরা ৩টি হিট এন্ড রান ক্রমসূচিতে অংশ গ্রহন করেছি। আমরা ১. বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ ২. কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশণ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস ৩. বেলকুচি থানার কল্যাণপুর যুদ্ধ ও ৪ শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক ভয়াবহ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। সকল যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার ও বাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে করে বিজয়ী হয়েছি। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমাদের গ্রুপ শেল্টার নিয়ে ছিলাম জামিরতা হাই স্কুলে। অস্ত্র জমা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এই স্কুলে আমরা ক্যাম্প করে ছিলাম।

১৪ ডিসেম্বর কোন সংঘাত ব্যতিরেকে শাহজাদপুর থানা শক্র মুক্ত হয়। দীর্ঘ সংগ্রাম ও নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পর আসে ১৬ ডিসেম্বর’১৯৭১। সবার বাধভাঙ্গা আনন্দ। তবে এ আনন্দ অর্জিত হয় লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আর এর সঙ্গেই সমাপ্ত ঘটে মহান মুক্তিযুদ্ধের। পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, লাল-সবুজের বাংলাদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিধ্বস্ত বাংলাদেশের শাষণ ভার গ্রহণ করে। মুক্তি যোদ্ধাদের নিয়ে ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২৪ জানুয়ারী রবিবার আমাদের গ্রুপের সবাই সিরাজগঞ্জ সদরস্থ ইব্রাহীম বিহারী বাসায় অস্ত্র ও গোলা বারুদ রবীন্দ্র নাথ বাগচীর নিয়ন্ত্রনে জমা দিয়ে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমরা দুই সহোদর একই গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোদ্ধা রতন কুমার দাস, আব্দুল হামিদ তালুকদার, মুক্তি মো: শামসুল হক, মো: নজরুল ইসলাম ও অন্যান্যরা। আমারা দুই ভাই একসাথে বাড়ি পৌছে গেলাম। শুধু বাড়ির লোকই নয় গ্রামের অনেক লোকই আমাদের দেখতে এলো, আদর করল, প্রশংসা করল। সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানের পদলেহী ব্যক্তি ছাড়া দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকাংশ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। ১৬ ডিসেম্বর’৭১ মহান বিজয় দিবসের পর আমি ভারতে গিয়ে আমাদের কারণে রাজাকারদের আলটি মেটামে ভারতের আসামের মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া আমাদের পরিবার কে দেশে ফিরিয়ে আনলাম।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test